সুন্দরবন কেন সুন্দরবন

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

বাঙলায় দক্ষিণে অবস্থিত সমুদ্র উপকূলবর্তী জঙ্গলময় ভূখণ্ডকে বলে সুন্দরবন৷ এ বনের নাম যে সুন্দরবন হল তার কোন মানে খুঁজে পাওয়া যায় না৷  এখানে না আছে ফলবান বৃক্ষ, না আছে পুষ্পতরু৷ যে সব ফল এখানকার গাছে হয় তার বেশির ভাগই মানুষের খাওয়ার অযোগ্য৷ এ বনে অশ্বত্থ বট ইত্যাদি স্নিগ্দ সুনিবিড় ছায়া সৃষ্টিকারী বৃক্ষের সমাবেশ দেখা যায় না৷ নিবিড় কন্টকাকীর্ণ কর্দমাক্ত, হিংস্র জন্তু জানোয়ারে পরিপূর্ণ দুর্গম এই বনের নাম তবু সুন্দরবন৷  কিন্তু কেন? সুন্দরবনে প্রচুর সুন্দরী বৃক্ষ জন্মায়৷ এই সুন্দরী বৃক্ষের কাঠের রঙ লাল৷ তাই দেখতেও সুন্দর৷ এই সুন্দরী বৃক্ষের আধিক্য হেতুই বনের নাম হয়েছে সুন্দরবন৷  অনেকে আবার এ ব্যাখ্যা মানেন না৷ তাঁদের মতে সুন্দরবনের সর্বত্র এই সুন্দরী বৃক্ষের অস্তিত্ব নেই৷ তাই সুন্দরী বৃক্ষের মধ্যে সুন্দরবনের নামের উৎস খুজতে যাওয়া নিরর্থক৷ তাঁরা বলেন, সমুদ্রবন থেকে ‘সুন্দরবন’ নামের উৎপত্তি৷ সাধারণ লোক সমুদ্রকে সমুন্দর বলে৷ ‘সুন্দরবন’ এই সমুদ্রবনেরই অপভ্রংশ৷ আবার এরকম মতও শোনা যায় যে, পূর্বে বাখরগঞ্জ জেলা ছিল চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অন্তর্গত৷ চন্দ্রদ্বীপের বনভূমিকে বলা হত চন্দ্রদ্বীপ বন৷ এই ‘চন্দ্রদ্বীপ বন’ থেকে হয়েছে ‘চন্দ্র বন’ ‘চন্দ্রবন’ থেকে ‘সুন্দরবন’৷

বিভারিজ সাহেব বলেন অন্য কথা৷ বাখরগঞ্জ জেলায় ‘সুগন্ধা’ নামে একটি নদী আছে৷ এই সুগন্ধাই লোক মুখে হয়েছে ‘সুন্ধা’ এই সুন্ধার তীরের বনভাগই ‘সুন্ধার বন’ ধীরে ধীরে উচ্চারণ বৈষ্যম্যের ফলে ‘সুন্দরবন’৷ কিন্তু সুন্দরবনের সম্পূর্ণ অঞ্চলটাই তো আর সুগন্ধা নদীর তীরে নয়৷ এই সুন্দরবন পশ্চিমে ভাগীরথীর মোহানা থেকে পূর্বে মেঘনার মোহানা পর্যন্ত বিস্তৃত৷ প্রকৃতপক্ষে গঙ্গা ও মেঘনার অন্তর্বর্তী ভূভাগই ‘সুন্দরবন’ নামে পরিচিত৷ পূর্ব-পশ্চিমে সুন্দরবনের দৈর্ঘ্য ১৬০ মাইল৷ উত্তর-দক্ষিণে প্রস্থ পশ্চিম দিকে ৭০ মাইল থেকে পূর্ব দিকে অনধিক ৩০ মাইল৷ গড় বিস্তৃতি ৫০ মাইল৷ অতএব, সুন্দরবন অঞ্চলটা হল ৮০০০ (আট হাজার) বর্গ মাইল৷ এই আট হাজার বর্গ মাইল বন নিশ্চই সুগন্ধা নদীর তীরে অবস্থিত নয়৷ তাই সুগন্ধা নদীর সঙ্গে সুন্দরবনের নাম জড়ানো সমীচীন হবে না৷

বরং সুন্দরী বৃক্ষ সুন্দরবনের সর্বত্র প্রচুর সংখ্যায় না পাওয়া গেলেও অল্প-বিস্তর সবখানেই এই বৃক্ষ জন্মায়৷ তদুপরি এই বৃক্ষের কাঠ অত্যন্ত শক্ত ও ভারী৷ ফলে মূল্যবান৷ এই বৃক্ষ খুব লম্বা---বেশি ডালপালা হয় না৷ সুন্দরী কাঠে গৃহের  আসবাবপত্র ও  নৌকা তৈরী হয়৷ এই কাঠ সুন্দরবনের একটি প্রধান অর্থকরী সম্পদ৷ অতএব,এই সুন্দরী বৃক্ষের জন্যই এই বন-ভাগের নাম  সুন্দরবন হয়েছে---একথা আমরা সহজেই বিশ্বাস করতে পারি৷