ত্রিপুরার রাজনীতিঃ রাজ্যের ‘‘এডিসি’’ বিষ-লতায় মুকুল এসেছে

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

পৃথিবী গ্রহের বুকে সুদীর্ঘকাল ধরে যে প্রাণী-জগৎ বিরাজমান, সেই প্রাণী জগতে মন-প্রধান জীবরূপে শীর্ষস্থান অধিকার করে রয়েছে মানুষ৷ উচ্চ-মননশীলতার অধিকারী বলেই আর তারও চেয়ে আরও বড় কারণ বিশ্বশ্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলেও মানুষ বিচারশীল ও বুদ্ধিমান জীববলেই জগতে খ্যাত৷ কিন্তু, কথাটি শ্রুতি কটু ও অপ্রিয় হলেও সর্বাংশেই নিখুঁত, সত্যি যে, মানুষের রচিত মনুষ্য-সমাজে বৃহদংশের মানুষরা---নির্বিচারে শোষিত,বঞ্চিত, নিপীড়িত,লাঞ্ছিত একশ্রেণীর দুষ্টবুদ্ধিবিশিষ্ট,হীনবৃত্তি সম্পন্ন,আত্মকেন্দ্রিক,স্বার্থপর,ভোগলোলুপ,  ক্ষুদ্রাংশের মানুষদেরই দ্বারা৷ সামাজিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই শ্রেণীর মানুষদের বৈশ্য-শ্রেণী তথা পুঁজিবাদী বা ক্যাপিটালিষ্ট বলা হয়ে থাকে৷ বস্তুতঃ এরাই সমাজে ‘হ্যাভস্‌’ অর্থাৎ ধনকুবের বা বিত্তশালী বলে খ্যাত৷ আবার, যেহেতু এরা ‘টাকার কুমীর হয়েও অজগর-বৃত্তি সম্পন্ন ধনীর দুলাল হয়েও বেলাগাম অর্থালোলুপ তাই স্বভাবগতভাবেই ওদের কাঙালীপনার অন্ত নেই, যদি মহাভারতের  দুর্র্যেধনীয় বৃত্তিতে ওরা গোটা মানব সমাজেই চ্যাম্পিয়ন৷ তাই ওরা দুনিয়ার সব কিছুরই মূল্যায়ন করে অর্থসম্পদের মাপদন্ডে নতুবা মানি পাওয়ারে খেয়ালখুশি চরিতার্থ না করতে পারলে মাস্‌ল পাওয়ারে৷ এক কথায় দুনিয়া ওদের চাই-ই চাই পায়ের তলায় --- যেনতেন প্রকারেণ৷ যুগ যুগ ধরে  ওদের দাপটেই সমাজের মেহনতি মানুষরা ওদের মর্জিতে শ্রম বিলিয়ে দিয়ে, বুদ্ধিজীবীরা মগজ খাটিয়ে আর পণ্ডিত প্রবরগণ বৈদগ্দ তাঁদের হেপাজতে বন্ধক রেখে দিয়ে দিনাতিপাত করা ছাড়া বিকল্প পথ নিতে সাহসী হন না৷ এর চেয়েও বড় কথা হল, এভাবেই পুঁজিবাদী শোষক-গোষ্ঠী ও তাদেরই দালাল-গোলাম সবাই মিলে সমাজে---বিচ্ছিন্নতাবাদ, বিভেদকামিতা, রক্তারক্তি ঘটিয়ে চলেছে৷ পুঁজিবাদীদেরই সর্বগ্রাসী চরম রূপ হচ্ছে--- ঔপনিবেশিকবাদ , সাম্রাজ্যবাদ যত আগ্রাসী চিন্তাধারা৷ অতীত যুগ থেকে--- তুর্কী, পাঠান, মোগল,ব্রিটিশ বিভিন্ন নামের এতসব দস্যু-লুটেরা-তস্কর-শোষকরা এসে ঐশ্বর্য-সমৃদ্ধা, ঐতিহ্যমণ্ডিতা, সম্পদশালিনী ভারতবর্ষকে তছনছ করে দিয়ে গেছে৷

কিন্তু, তারপরেও কি বর্তমানের বহুধা-খণ্ডিত ভারত স্বস্তিলাভের পথ খুঁজে পেয়েছে৷ আমার দৃঢ়বিশ্বাস রয়েছে---যাঁরা কোন না কোনভাবেই পুঁজিবাদী শোষক গোষ্ঠীদের দ্বারা উপঢৌকন প্রাপ্ত নন, অর্থাৎ যারা হাজারো অনটনের জ্বালা সয়েও আত্মমর্যাদাবোধ খুইয়ে বসেননি, একমাত্র তাঁরই--- শুধুই তাঁরা স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করতে পারবেন না যে, ব্রিটিশ-শাসনমুক্ত গোটা ভারত বিদেশী শোসকচক্রের কবলমুক্ত হবার সাথে সাথেই বিদেশী শোষকদের পরিবর্তে দেশীয় শোষকদের হাতে বন্দী হয়ে শোষনের অন্ধ-কুঠুরীতে দমবন্ধ অবস্থায় মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন৷ বর্তমান ভারতের কর্ষকরা বাঁচার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যা করছেন৷ পরিযায়ী শ্রমজীবীরা শুধু দেশের ভেতরেই রাজ্যান্তরে পাড়ি দিচ্ছেন তাই নয়, ‘‘দলে দলে অশিক্ষিত আর শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিতরাও দেশ ছেড়ে দেশান্তরে পাড়ি জমাচ্ছেন৷ দেশের অশিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত ও শিক্ষিত বেকারগণ হা-পিত্যেশ করতে করতে কেউ পর পারে পাড়ি দিচ্ছেন, কেউ বা বয়সোত্তীর্ণ হয়ে অর্ধোম্মাদ---উন্মাদের তালিকা বাড়িয়ে চলেছেন আবার অন্ধকারের জগতেও হারিয়ে যাচ্ছেন৷ তবে এই অন্ধকারের জগতে হারিয়ে যাওয়া কিন্তু ভারতীয় ব্যাংক থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার মত হারিয়ে যাওয়া নয়৷ আর অপরদিকে পঞ্জাব-হরিয়ানার  কৃষিপণ্য কুইন্টাল প্রতি বিরাশি টাকা মূল্যের চাল বিদেশে রপ্তানী করে আমাদের দেশেরই ধনকুবেরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চালাচ্ছেন, বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন ধনকুবেরদের বিজয়ীর তালিকায় কে কত উদ্ধারোহকে সক্ষম হতে পারেন বলে৷ এদের যারা মদত করছে, দেশবাসীর দুর্ভাগ্যক্রমে তারা আবার দেশ-নেতানেত্রী৷ তাই, খুবই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এযুগে ‘সেলুকাস’ নেই বলে!‘বড় বিচিত্র এই দেশ!’ কী তাজ্জব ব্যাপার!’---এসব কথা বলার মত কাছের মানুষ পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

হ্যাঁ, দু-চার কথা লিখতে বসেছিলুম আমাদের এ রাজ্যের ‘এডিসি’ নিয়ে৷ তবে এরই পটভূমিকা টানতে গিয়ে একটু দূরে এসে গেছি বলেও কেউ অনুগ্রহপূর্বক ভাবতে চাইবেন না যে আমি ঘুরপথ ধরে গন্তব্যস্থলই হারিয়ে ফেলেছি কিনা৷ তা আদৌ নয়৷ পুরো লেখাটা পড়া হয়ে গেলেই  বুঝতে পারবেন যে আমার এ পর্যন্ত বলা উপরের কথাগুলো মোটেই অবান্তর নয়৷ কেননা, ত্রিপুরাকে বুঝতে হলে ও সম্যকরূপে বিচার করতে হলেও ভারতকে জানতে হচ্ছে, বুঝতে হচ্ছে আবার ভারতের  কান্ডারীদেরও সম্পর্কেও কিছুটা অন্ততঃ বুঝবার রয়েছে অবশ্যই৷ তাই, উপরের ওই আলোচনা৷ এবারে  আসুন ত্রিপুরার এডিসির---চত্বরে৷

এরপূর্বে ত্রিপুরা সহ ভারতের উঃ-পূর্বাঞ্চলের কথাও বলতে হচ্ছে৷ উঃ-পূর্ব ভারতে গত কয়েকশ’ বছর ধরে যারা মূলতঃ মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূতরা বসবাস করে চলেছেন--- তাদের কথ্যভাষা বা বুলি, তাদের জীবনযাত্রা-প্রণালী, সংস্কৃতি-কৃষ্টি, সামাজিক গতি-প্রকৃতি ও রীতি-নীতি ইত্যাদি ছাড়াও নৃতাত্ত্বিক অন্যান্য দিকগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত, তিববত-বর্মী ভাষাভাসীর অন্তর্ভুক্ত বোড়ো,ব্রু-ভাষী, ককবরক ভাষী গোষ্ঠীভুক্তরা কেউই এ মাটির আদি সন্তান নয় ও তারা সকলেই এদেশের মাটিতে  বহিরাগত ---যাকে বাংলাভাষায় শাসকগোষ্ঠী বলে থাকেন ‘অনুপ্রবেশকারী বা হিন্দীভাষীরা বলে বেড়ান ‘ঘুষপেটিয়া’৷ এ প্রসঙ্গেই একথাটি বলে রাখতে হচ্ছে যে, উঃ-পূর্ব ভারতে দীর্ঘকাল ধরে বিদেশী খ্রীষ্টান মিশনারীরা ভারত সরকারেরই অনুমতিক্রমে ধর্মপ্রচারের নামে অতি সন্তর্পণে বিভেদ কামিতার ইন্ধন যুগিয়ে যে চলেছেন, একথা ‘ওপেন সিক্রেট’৷

দ্বিতীয়তঃ প্রকৃত অর্থে রাজনীতি ভিত্তিক কর্মধারা চালাতে হলে প্রথমেই চাই কতিপয় শর্তপূরণ --- যথা, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পূর্ণাঙ্গ দর্শন, অভ্রান্ত নেতৃত্ব,  প্রশিক্ষিত সামাজিক কর্মীবাহিনী ও সদাচারী পরিচালনাবৃন্দ৷ বস্তুতঃ, এই নিরিখে বিচার চালালে কিন্তু, কংগ্রেস, কম্যুনিস্ট, ডান-বাম-রাম, গান্ধীবাদী, মার্কসবাদী,মাওবাদী ইত্যাদি সর্ব-ভারতীয় বা আঞ্চলিক কোন রাজনৈতিক সংস্থার হাতেই যুগোপযোগী পূর্ণাঙ্গ ও প্রয়োগভৌমিক কোনতত্ত্ব বা দর্শন নেই৷ তাই, ওইসব রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি-চালনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতা দখল-ভোগ৷ যেজন্যে বোট পাওয়াটা হচ্ছে একমাত্র ‘পাখীর চোখ’৷ তাই বরং এই বোটবাজ রাজনীতিকে ‘‘রাজনীতি’’ না বলে ‘‘বাজনীতি’’৷ (মানে বাজপাখীর ছুঁমারা বলাই অধিকতর সঙ্গত বলে মনে করি)৷  এই জাতীয় রাজনীতি করতে গিয়ে ‘বিভেদনীতি’, ‘বিভাজন-কৌশল’ জাত-পাত -গোষ্ঠী-ভাগ ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষকে ভুলভাল বুঝিয়ে, মিথ্যের বেসাতির মাধ্যমে প্রলুদ্ধ করে, হিংসা---অসিষ্ণুতা -অবিশ্বাস---,সন্দেহ---ঈর্র্ষ ইত্যাদির মাধ্যমে পারস্পরিক বিভাজন করে, দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রেখে বোট-পাওয়ার স্বার্থে ঠোকাঠুকি লাগিয়ে রাখা ও মূল টার্গেট ক্ষমতা হাতে পাওয়া ও দখলে রাখাটাই হচ্ছে ওদের আসল কাজ৷

আশা করি, ত্রিপুরা তথা সমগ্র উঃ-পূর্ব ভারতের জাতি-জনজাতি-ভাষাগোষ্ঠী ও ধর্মমত নির্বিশেষে সকলেই এটুকু এতদিনে উপলদ্ধি করতে পেরেছেন যে, ---(১) অতীতে দেশের  কংগ্রেস-কম্যুনিষ্ট-মুশলিমলীগ ও ব্রিটিশের মগজ প্রসূত  ভারত বিভাজন কারোর জন্যেই শান্তি এনে দিতে পারে নি৷

(২) নেহেরুর ভাষাভিত্তিক রাজ্যভাগ উঃ-পূর্বাঞ্চলের সাত বোনের রাজ্যঘটন ও পরবর্তীকালে বিভিন্ন রাজ্যভাগ এসব দ্বারাও মানুষের সমস্ত-চাহিদার পূর্তি হয়ে ওঠেনি৷

(৩) আঞ্চলিকতা বা প্রাদেশিকতা, ও সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা বাড়ছে বই কমছে না৷

বস্তুতঃ এরই চাক্ষুষ পরিণাম এখন ফলতে শুরু করেছে এ রাজ্যের  এডিশি-র ক্ষেত্রে৷ বলা হয়েছিল, এরাজ্যে উপজাতিদের ‘স্বার্থে ও সার্বিক কল্যাণ সাধনের  উদ্দেশ্যে ভারতের সংবিধান সংশোধন করিয়ে  ৬ষ্ঠ তপশীল, মোতাবেক ‘‘এডিসি করা হয়েছিল৷ কিন্তু এর বিরুদ্ধবাদীদের স্পষ্ট অভিমত ছিল যে, উক্ত ‘‘এডিসি’’ ঘটনের মাধ্যমে রাজ্যবাসীদের মধ্যে এক বিভেদের প্রাচীর তুলে দিয়ে মানবিক সংহতি তথা ঐক্যের মূলেই কুঠারঘাত করা হয়েছে, যার পরিণাম ফল ভয়াবহ রূপ নেবে পরবর্তী সময়ে৷ এখন উক্ত এডিসি নিয়ে ‘রাজ্য পরিষদ ’ করার জল্পনা তুঙ্গে রয়েছে৷ একই সাথে চাওয়া হচ্ছে এডিসি/তথা ষ্টেট কাউন্সিলের (ত্রিপুরার মোট জমির ৭২শতাংশ, এলাকা নিয়ে ‘তিপ্রাল্যাণ্ড’ হয়ে যাক৷ পাশাপাশি কিন্তু চাক্‌মা, রিয়াং, লুসাইরাও নিজ নিজ স্বায়ত্ত শাসনের দাবী তুলেছেন৷ রাজ্যে মণিপুরীদের দাবীও অগ্রাহ্য করার মত নয়৷

আবার এসবের চাইতেও আরও ভয়াবহ সমস্যা দেখা দিয়েছে মিজোরাম থেকে বিতাড়িত হবার পর ত্রিপুরায় আশ্রিত বহু হাজার শরণার্থী রিয়াংদের পুনর্বাসন নিয়ে৷ মিজোরামের বাসিন্দা উক্ত রিয়াংদের মিজোরাম সরকার তাড়িয়েছেন ও এখন আর ফেরত নিতে চাইছেন না৷ দিল্লীতে কেন্দ্রীয় সরকার, মিজোরাম সরকার, ত্রিপুরা সরকার  ও রিয়াং প্রতিনিধিদের চতুষ্কোনী আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেবার পরও তাই ত্রিপুরা সরকার চেয়েছেন ওদের পুনর্বাসন দিতে৷ তবে কাঞ্চনপুর, দলদা, পাণীসাগর এলাকায় প্রতিবাদে দুটি প্রাণ হয়ে গেছে ও একজন পা খুইয়েছেন৷ এখন নোতুন করে স্থানীয় রিয়াংরাই প্রতিবাদে নেমেছে৷