তৃণভোজী জীব, মাংসাশী জীব, মানুষ

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

তোমরা জান জীবজন্তুরা মুখ্যতঃ তৃণভোজী (graminivorous) ও মাংসভোজী (carnivorous) –এই দু’টি মুখ্য শাখায় বিভক্ত৷ তৃণভোজীদের দাঁতগুলো থাকে মুক্তোর মত ধবধবে শাদা ও সাজানো৷ যারা মাংসভোজী জীব তাদের দাঁতগুলি হয় খোঁচা খোঁচা, ঈষৎ হল্দেটে অথবা লালচে মেশানো হলদেটে৷ মুখের দুই পাশে থাকে মাংস কাটবার কর্ত্তন দন্ত (canine teeth)৷

তৃণভোজী জীবেদের মধ্যে যারা প্রাচীনকালে অনিশ্চিত অবস্থায় বাস করত, অর্থাৎ কখনো খাদ্য পাচ্ছে, কখনো পাচ্ছে না, এমন হত তাদের মধ্যে জেবু বা বাইসন বর্গীয় জীবেদের পাকস্থলীর পরিশিষ্টাঙ্গে খাদ্য মজুদ রাখার একটা ব্যবস্থা থাকত৷ এ ব্যবস্থা বানরের, মানুষের, ছাগলের পুরো মাত্রায় ছিল৷ গোরু, মোষের তো ছিলই, আজও আছে৷ জীবন যত নিশ্চিত হয়ে আসে, ততই তাদের এই পরিশিষ্টাঙ্গের প্রয়োজন ফুরিয়ে আসে৷ যেমন ফুরিয়ে এসেছে মানুষের, বানরের ও অন্যান্য জীবজন্তুর৷ এই পরিশিষ্টাঙ্গ বা হ্মহ্মন্দ্বুস্তুন্প্র থেকে অবসর সময়ে খাদ্য কিছুটা টেনে এনে জীব তা লালার সাহায্যে হজমের উপযুক্ত করে নেয়। মানুষের ক্ষেত্রে এই প্রয়োজন না থাকায় তা যজ্ঞডুমুরের মত আকারে ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদন্ত্রের সংযোগস্থলে অব্যবহূত অবস্থায় থাকবে৷ এই সুযোগ মাংসাশী জীবেদের নেই৷ কারণ উদরাসাৎ করা মাংস দ্রুত পচে যায় ও অধিকতর দুর্গন্ধযুক্ত হয়৷ তা নিয়ে আর জাবর কাটা যায় না৷ মানুষ (মৌলিক ভাবে) অন্ত্রপরিশিষ্টাঙ্গ সমন্বিত নিরামিষভোজী জীব মানুষের canine teeth–ও নেই৷ তাই মাংসাহার তার শরীরে এ্যাপেন্ডিসাইটিস রোগ বয়ে আনতে পারে ও তা এনেও থাকে৷ মাংস ভক্ষণ মানুষের পক্ষে অপ্রাকৃত ব্যবস্থা যার ফল ভাল নয়৷

অতিরিক্ত আমিষ ভোজন ঃ যাঁরা অতিরিক্ত মাংস বা তামসিক ভোজ্য খায় তাঁদের মল নেড্য (ন  ঈড্য) নামে পরিচিত হয়৷ এই নেড্য থেকে বাংলায় ‘ন্যাড়’ শব্দটি এসেছে৷ যাদের মল সাধারণতঃ নেড্য পর্যায়ভুক্ত, তাঁরা কখনো অতিরিক্ত গুরুভোজ্য খাদ্য গ্রহণ করলে সহজেই কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে আক্রান্ত হয়৷ অন্যদের তুলনায় তাঁদের অর্শ, ভগন্দর রোগের প্রকোপ হয় বেশী৷ অতিরিক্ত আমিষভোজী মানুষ মলত্যাগের সময়ে যদি অতিমাত্রায় কুন্থন (কোঁথ) দেয়, তার ফলে তাঁদের অণ্ডকোষের শিরা স্ফীত হয়ে কোষবৃদ্ধি বা একশিরা রোগ দেখা দিয়ে থাকে৷ নিরামিষভোজী মানুষের একশিরা বা কোষবৃদ্ধি হয় যদি দাঁড়িয়ে স্নান করা তাঁদের স্বভাবে পরিণত হয়ে যায়৷ ঈলীশ মাছ, হাঙ্গর প্রভৃতি অতিরিক্ত পচা মাংসপ্রিয় মাছেরা কোষ্ঠবদ্ধতা ব্যাধিতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়৷ আর অতিরিক্ত আমিষ ভোজন ও তৎসহ অতিমাত্রায় কোষ্ঠবদ্ধতার দরুণ এদের মাংসে, অর্থাৎ ঈলীশ মাছ ও হাঙ্গরের মাংসে ও তেলে মাত্রাতিরিক্ত দুর্গন্ধ থাকে৷ তাই ঈলীশ মাছ খেয়ে মানুষ যে গেলাসে জল পান করে, সেই গেলাস যে নুড়ো দিয়ে মাজা হয়, সেই নুড়োয় অন্য গেলাস মাজলে, সেই গেলাস থেকে জল খাবার সময় ঈলীশের পচা দুর্গন্ধ নাকের কাছে দৌড়ে ছুটে আসে৷ রোগগ্রস্ত পশু বা পক্ষীর মাংস ভক্ষণেও বিপদ দেখা দেয়৷ এমনিতে পশুপাখীর মাংস ভক্ষণে মানুষের শরীরে নানান জটিলতা এসে যায়৷ রোগগ্রস্ত পশুপক্ষীর মাংস সেই জটিলতাকে আরো ক্ষাড়িয়ে দেয়৷ তাই যাঁরা অতি লোভের জন্যে মাংস ভক্ষণে বিরত থাকতে অক্ষম, তাঁদের উচিত কসাইখানায় (Slaughter house)  যে পশুকে বা পক্ষীকে বধ করা হচ্ছে, হত্যার পূর্বে সেই পশুটির স্বাস্থ্য যাতে ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয় তার ব্যবস্থা করা৷ পশুকে যদি সূচিকাভরণে (injection) হত্যা করা হয়, সেই ক্ষেত্রেও দেখে নেওয়া উচিত যে সূচিকাভরণে যে পশুর মৃত্যু হল তা বিষবাহক কিনা৷ কারণ সেই বিষ মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে৷ [আমিষ ভোজনের দোষ দূর করতে গেলে ভোজনান্তে জঙ্গী হরিতকী (চার ভাগের এক ভাগ) মুখশুদ্ধি হিসেবে খেলে উপকার পাওয়া যায়৷]

চিংড়ি 

অনেকে চিংড়িকে ভুল করে মাছ বলে থাকেন৷ মাছের সঙ্গে চিংড়ির কোন সম্পর্কই নেই৷ চিংড়ি একটি জলজ কীট৷ পচা জলে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়৷ রাঢ়ের কোন কোন অঞ্চলে ও অবশিষ্ট বাংলার কোথাও কোথাও একে ইচা মাছ বলা হয়৷ ইংরেজীতে বলা হয় lobster৷ চিংড়ি দুষ্পাচ্য ও ভক্ষণকারীকে নানান উপসর্গে ভুগতে হয়৷ ঙ্তাদের একটি প্রজাতি হ’ল সামুদ্রিক লাল চিংড়ি৷ তোমরা দীঘা থেকে বাখরগঞ্জ সীমান্তের সরণখোলা পর্যন্ত স্থানের সমুদ্রে এই লাল চিংড়ি দেখতে পাবে৷ এই লাল চিংড়ি খেয়ে অনেকে তাপস্ফোট রোগে (allergy) ভোগেন৷ অনেকেই তাই এই লাল চিংড়ি খান না৷      ((‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে)

ভ্রূণবর্জিত ডিম 

স্তন্যপায়ী জীবের ভ্রূণোৎপত্তির পূর্বে মাতৃগর্ভে ডিম (ovum) সৃষ্ট হয়৷ স্বাভাবিক অবস্থায় এই ডিম্ব প্রসূত হয় না, প্রসূত হয় ভ্রূণাবস্থায়৷ অণ্ডজ প্রাণীর জগতে, বিশেষ করে পক্ষীর জগতে কিন্তু এর ব্যতিক্রম আছে৷ তাদের ভ্রূণবর্জিত ডিম্ব প্রসূত হয়ে থাকে৷ বিশেষ করে কয়েকটি প্রজাতির হাঁস প্রায়শই এই ধরনের ভ্রূণবর্জিত ডিম প্রসব করে থাকে৷ এই ডিমের মধ্যে সন্তান–সম্ভাবনা থাকে না৷ অর্থাৎ তা দিলে তার মধ্যে থেকে সন্তান বহির্গত হবে না৷ সাধারণতঃ এই ডিম পচে নষ্ট হতে একটু বেশী সময় নেয়৷ যাঁদের ডিমের প্রতি দুর্বলতা আছে অথচ ভ্রূণ হত্যা করতে চান না, তাঁদের অনেকেই এই ধরনের অভ্রূণ ডিম খাওয়ার পক্ষপাতী৷ বলেন–এতে তো ভ্রূণ হত্যা হয় না৷ তাঁদের মনে রাখা উচিত এই অভ্রূণ ডিম খেলে ভ্রূণ–হত্যা হয় না ঠিকই কিন্তু এই ধরনের ডিমে অবশ্যই আমিষ–ভক্ষণের দোষগুলি নিহিত থেকে যায়৷   (‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে)