৫ই মার্চের মর্মান্তিক ঘটনা

লেখক
প্রভাত খাঁ

মনে পড়ে ৫ই মার্চে ১৯৬৭ সালের সেই দিনের কথা৷ আমি কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে একটি সেমিনারে গিয়েছিলাম দক্ষিণ কোলকাতার একটি স্থানে৷ এদিকে ৫ই মার্চেই পুরুলিয়ার আনন্দনগরে আনন্দমার্গের কেন্দ্রীয় আশ্রমে স্থানীয় হামলাকারীরা আশ্রম আক্রমণ করে আমাদের ৫জন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে প্রকাশ্যে দিবালোকে বেলা ১০টার মধ্যে তাঁদের জোর করে জঙ্গলে টেনে নিয়ে গিয়ে! ৬ই মার্চ সংবাদপত্রে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রকাশিত হয়৷ আমাদের পাড়ায় হইচই পড়ে যায় আমরাও হয়তো নিহত হয়েছি বলে কারণ আমরা পাড়ায় ছিলাম না৷ এই দিন আনন্দনগর থেকে  একজন দাদা নাম আচার্য মাধবানন্দজী এলেন আমাদের  সেমিনার  যেখানে হচ্ছে সেইস্থানে ও সেমিনার বন্ধের নির্দেশ দেন, আমরা বাড়ি ফিরে আসি৷ এদিকে আজকে যে নোতুন পৃথিবী পত্রিকা তাঁর কার্যালয়ে প্রতিদিনই প্রায় আসতাম আমাদের পত্রিকায় সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিয়ে কাগজ প্রকাশ করার ব্যবস্থা করি৷৷ তখন বাম সরকার পশ্চিমবাংলার শাসনে৷ তাঁরা আনন্দনগরে আনন্দমার্গের আশ্রমের বিস্তারে প্রথম থেকেই বাধা দান করে ও স্থানীয় লোকদের আশ্রমের বিরুদ্ধে উষ্কে দেন৷ নানা কুৎসা ও মিথ্যা রটনা করে৷ তখন আমাদের আশ্রমে প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততার মধ্যে কাজ চলছে৷ পরমারাধ্য বাবা আনন্দনগরে বর্তমান৷  ৪ঠা মার্চ আচার্য মাধবানন্দজী বাগলতা থেকে যখন রাত্রে আশ্রমে ফিরছিলেন তখন লোকের মুখে শোণেন যে পরের দিন অর্থাৎ ৫ই মার্চে ওখানকার লোকজন মিলিত হয়ে আশ্রমে একটা হামলা করবে৷ সে ঘটনা আমি পরে  শুণেছিলাম  আমার  স্ত্রীর  কাছ থেকে ৷ কারণ আমার স্ত্রী  তখন আনন্দনগরে থাকতেন তাঁর বাবা ডাঃ শচীনন্দন মণ্ডল এর সাথে স্বপরিবারে৷ ডাঃ বাবু আমাদের আনন্দমার্গের প্রতিষ্ঠিত আভা সেবা সদনের ডাক্তার ছিলেন৷ আচার্য মাধবানন্দজী সেই কথা ডাঃ বাবুকে বলেন৷ পরবর্ত্তীকালে এইদিনের  যে প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে আমার স্ত্রী নোতুন পৃথিবীতে ঘটনা তুলে ধরেন৷

এদিকে আমরা কলকাতার নোতুন পৃথিবী কার্যালয় থেকে সকল ঘটনা প্রকাশের ব্যবস্থা করি কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে  আমাদের ঘটনা প্রকাশ করায়  বাধা দান করে৷ আমরা যে ম্যাটার ছাপাতে নিকটস্থ্‌ এশিয়ান প্রিন্ট্রার্স প্রেসে নিয়ে  যাই সেটা পুলিশ আটক করে৷ আমরা তীব্র প্রতিবাদ করি৷ কলকাতার পত্র-পত্রিকায় আনন্দনগরে নিষ্ঠুরতম ঘটনা প্রকাশ পায়৷ আমরা পরে সকল ঘটনা নোতুন পৃথিবীতে ছাপিয়ে দিই৷ তখন আমরা মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জীর সঙ্গে তাঁর বেলভেয়ার্স রোডের  আবাসে যাই কয়েকজন৷ তাঁকে সকল ঘটনার বিবরণ দিই৷ তিনি আমাদের  বলেন--- সন্ন্যাসীদের কাছে লাঠি, ছোরা থাকে কেন? আমি তাঁকে বলি এটাতো তাঁদের একটি প্রতীক চিহ্ণ হিসাবে থাকে৷ তাতে হয়েছে কী? তাঁরা কি কারোর খুন করেছেন? তাঁদেরই জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ জঙ্গলে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে৷ তিনি দেখছি! বলে  ঘরে ঢুকে গেলেন! আমরা ফিরে আসি৷ পুরুলিয়ায় যেমন কোর্টে পিটিশান মামলায় দায়ের হয়৷ সংঘটনের পক্ষ থেকে৷ আমরা মেদিনীপুর সেসন কোর্টে মামলা স্থানান্তর এর আবেদন করি৷ মহামান্য আদালত সেটা করেন কারণ পুরুলিয়া কোর্টে সঠিক বিচার না পাওয়ার সম্ভাবনার জন্য৷ এই মেদিনীপুর কোর্টে বিচার হয়৷ মহামান্য আদালতে তীব্র ভৎর্সনা করেন স্থানীয় থানার কর্মকর্র্ত্ত গাফিলতির জন্য ও সরকার কে৷  স্থানীয় বিডিও কিছু দোষীদের  শাস্তি হয়৷ কয়েকজনের যাবৎজীবন কারাদণ্ডও  হয়৷ এই পিটিশন মামলা করেন আচার্য পুন্যানন্দ অবধূত তৎকালীন সময়ের৷

যারা আদর্শের জন্য মৃত্যু বরণ করে মহান দধীচি হন তাঁরা হলেন তৎকালীন জি.এস মাননীয় আচার্য অভেদানন্দ অবধূত, আচার্য সচ্চিদানন্দ অবধূত, আচার্য ভরত কুমার, প্রভাস কুমার অবোধ কুমার৷ পুরাণে বর্ণিত  কাহিনী হল ভয়ংঙ্কর বৃত্রাসুরকে নিহত করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্রের অনুরোধে মহান মুনি দধীচি আত্মোৎসর্গ করেন ইন্দ্রের অস্ত্র বজ্র সৃষ্টির জন্য নিজে স্বর্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন৷

ঠিক তেমনই আনন্দমার্গের ৫জন সর্বত্যাগী সন্ন্যসী নিজেদের জীবন, উৎসর্গ করে পাপশক্তির হাত থেকে মহান আনন্দমার্গের আশ্রম ও আদর্শকে রক্ষা করেন৷ সংঘটন এঁদের  স্মরণে এইদিনটিকে পবিত্র দধীচি দিবস হিসাবে অরন্ধন দিবস হিসাবে  ও সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত নিরম্বু উপবাস হিসাবে ঘোষণা করেন৷  সকল আনন্দমার্গের ১২ বছরের ঊর্দ্ধে বয়স্করা শ্রদ্ধার সঙ্গে  এই দিনটিকে পালন করেন ৷

স্বার্ত্তব্য তৎকালীন সরকার  আনন্দমার্গের তীব্র আন্দোলনের  কারণে ৫জন সন্ন্যসীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের  ঘটনাকে কেন্দ্র করে  বিচার বিভাগীয় তদন্ত এর জন্য কমিশন বসান, কিন্তু পরবর্তীকালে কমিশনের তদন্ত  বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ এই হলো এদেশের গণতন্ত্র! আজ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার অনেক মর্মন্তুদ ঘটনাকে এই ভাবেই চাপা দিয়ে চলেন!

পুলিশকে বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও আশ্রম রক্ষায় দৃষ্টি দেননি৷ অনেক পরে পুলিশ আসে যখন সব শেষ হয়ে যায়৷ জঙ্গল থেকে মৃতদেহগুলি উদ্ধার করে রাঁচী নিয়ে যাওয়া হয় ও সেখানে তাঁদের  বিকৃত মৃতদেহের সৎকার  হয়৷ আশ্রমিক মহানগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর পরিবারবর্গ ও আশ্রমিকদের অস্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত করা হয় রাঁচীতে৷ পরে আবার আশ্রমের  কাজকর্ম, সমাজ সেবামূলক কাজ আরম্ভ করা হয়৷ কিন্তু আশ্রমের কোন ক্ষতিপূরণের চিন্তা এদেশের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার করেন নি৷ যেটা করা উচিত ছিল কারণ এটা সেবামূলক সংঘটনকে রক্ষা করার দায় হল জনগণতান্ত্রিক সরকারের কারণ এ দেশের সরকারগুলি কথায় জনগণ জনগণ বলে গলা ফাটান৷ তখন কেন্দ্রতে ছিলেন ইন্দিরা সরকারের কংগ্রেস শাসন!

রাজ্যের তখন অজয় মুখোপাধ্যায়ের জোড়া তালি সরকার৷ জ্যোতি বসু উপমূখ্যমন্ত্রী পুলিশ দায়ভার তার হাতে৷ ভারতের  ৭৪ বছরের গণতন্ত্রের কেন যে এমন দশা চির কাল সেটা কিন্তু  সচেতন জনগণের ভাবনা চিন্তা করা বিশেষ প্রয়োজন কারণ রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ বছর ধরে নোংরা দলবাজীতে যুক্ত হয়েছে৷ এতে দেশের ভবিষ্যৎ একেবারেই ভয়ঙ্কর৷