আবীরে লাল কলকাতার সেকাল

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

কলকাতার আদি পরিবারগুলির অন্যতম হল শেঠ পরিবার৷ এই শেঠ পরিবারের প্রথম যিনি কলকাতায় আসেন তাঁর নাম মুকুন্দরাম৷ মুকুন্দরামের ছেলে লালমোহন৷ খ্যাতিমান ব্যবসায়ী হিসেবে ইংরেজদের  কাছে বিশেষ সমাদর পেতেন এই লালমোহন৷ এই লালমোহন যে-দিঘি খনন করান তারই নাম লালদিঘি৷ লালদিঘি নামকরণের উৎস অবশ্য আরও আছে৷ দিঘির মাটি দিয়ে  ইঁট তৈরি করে  পশ্চিমদিকে একটা  ভদ্রাসন তৈরি করা হয়েছিল৷ লালমোহন একটা বাজারও তৈরি করেছিলেন৷ সেই বাজারটিই হল আজকের বিখ্যাত লালবাজার৷ ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দ অবধি বাজারটির অস্তিত্ব ছিল৷ পরে বাজারটি বন্ধ হয়ে যায়৷ এখন শুধু নামটিই আছে৷

শেঠেরা খুব আড়ম্বর করে লালদিঘিতে দোল  উৎসব করত৷ লালদিঘির উত্তর-দক্ষিণে দুটো দোলমঞ্চ নির্মাণ করা হত৷ দক্ষিণের দোলমঞ্চে স্থাপিত হতেন গোবিন্দজীউ আর উত্তরের দলমঞ্চে রাধারানী৷ আবীর বিক্রির জন্য এখানে একটা বাজার বসত৷ সেটাই পরবর্তীকালে হয় রাধা বাজার৷

মোগলদের বিরুদ্ধে বারো ভুঁইয়াদের বিদ্রোহদমনে  যাঁরা সাহায্য করেছিলেন মানসিংহ তাঁদের নতুন জমিদারি দিয়ে পুরসৃকত করেছিলেন৷ সেইসব নতুন  জমিদারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ভবানন্দ মজুমদার ও লক্ষ্মীকান্ত৷  কলিকাতার জমিদার  সাবর্ন চৌধুরীরা ছিলেন এই লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারেরই বংশধর৷ বড়িশা বেহালার বসতবাটি ছাড়াও, কলকাতায় তাঁদের একটা কাছারি বাড়ি ছিল৷ এই কাছারি বাড়িতে মজুমদারের গৃহদেবতা শ্যামরায়কে কেন্দ্র করে দোলযাত্রা হত৷ শ্যামরায় বিগ্রহের দোলযাত্রা উপলক্ষে লালদিঘিতে বেশ জাঁকিয়ে মেলা বসত৷ অনুমান করা হয়, শ্যামরায়ের দোলের  উৎসব ক্ষেত্র  হওয়ায় পার্শ্ববর্তী স্থানগুলোর লালদিঘি, লালবাজার, রাধাবাজার ইত্যাদি নামকরণ হয়৷

দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দে একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে৷ দোলযাত্রার সময় মজুমদারের কাছারি বাড়িতে কোম্পানির জনাকয়েক কৌতূহলী কর্মচারী উৎসব দেখার  জন্য বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করেন৷ সেই সময় অ্যানটনি কবিয়ালের পিতামহ ছিলেন মজুমদারের আমমোক্তার৷ তিনি কোম্পানির  ইংরেজ কর্মচারীদের  বাড়িতে প্রবেশ করতে বাধা দেন৷৷ ফলে একটা সংঘর্ষ হয়৷ খবরটা পৌঁছে যায় জব চার্নকের কানে৷ চার্নক তো খবরটা শুনেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন৷ ছুটে এসে ঘোড়ার চাবুক দিয়ে তিনি অ্যানটনিকে বেদম প্রহার করেন৷ অ্যানটনি অপমানের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে মজুমদারদের অধিকৃত জমিদারির মধ্যে কাঁচরাপাড়ার কাছে একটা গ্রামে  গিয়ে বসবাস করেন৷

১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ইস্ট ইন্ডিয়ার একটা বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায় যে দোলে, সেই সময় কলকাতার সরকারি অফিসসমূহ পাঁচদিন ছুটি থাকত৷ সেই তুলনায় দুর্র্গপূজোর চাইতেও দোল উৎসব বেশি গুরুত্ব পেত৷ এর কারণ হয়ত সেকালে কলকাতায় শাক্তদের চাইতে  বৈষ্ণবদের প্রাধান্য ছিল বেশি৷

কলকাতার উপকন্ঠে শ্রীরামপুরের গোস্বামীদের রাজবাড়িতে শ্রীশ্রীরাধামাধব ঠাকুরের দোলযাত্রায় যে জাঁকজমক, রোশনাই গানবাজানার মজলিশ, ব্রাহ্মণ-ভোজন ও পণ্ডিতদের পুরস্কার প্রদান করা হত সে খবর পাওয়া যায় ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই মার্চ তারিখের  ‘সমাচার দর্পণে’৷

কলকাতায় গাজনের মতো দোলেও সঙ বের হত৷ সে-সব সঙ ছিল অত্যন্ত কুৎসিত এবং যেসব গান গাওয়া হত তা ছিল অশ্রাব্য৷ রঙ দেওয়ার ব্যাপারে মেয়ে-পুরুষ বাছবিচার ছিল না৷ আবীর আর রঙে মানুষের জামাকাপড়ই শুধু নয়, কলকাতার পথঘাটও হয়ে যেত লালে লাল৷ সেকালের  প্রত্নতত্ত্ববিদ মি.এ.কে. রায়ের  মতে, শ্যামরায়ের দোলপর্ব উপলক্ষে এত আবীর খেলা হত যে লালদিঘির জল লালে লাল হয়ে যেত৷ সেই থেকেই দিঘির নাম লালদিঘি৷