আদর্শ জীবন

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি

                ‘‘যচ্ছেদ্ বাঙ্মনসী প্রাজ্ঞস্তদ্

                                যচ্ছেদ্জ্ঞান আত্মনি৷

                জ্ঞানমাত্মনি মহতি নিযচ্ছেৎ

                                তদ্ যচ্ছেচ্ছান্ত আত্মনি৷৷’’

সাধকের জীবন কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে এর আগেও বলেছি৷ বলেছি যে একজন যথার্থ সাধক এই আপেক্ষিক জগতের কর্ত্তব্যগুলোও যথাযথভাবে করবে, আবার আধ্যাত্মিক জগতের কর্ত্তব্যগুলোও ঠিক ঠিক করতে থাকবে আর এই উভয় জগতের মধ্যে থাকবে একটা সুসামঞ্জস্য (happy blending)৷ বহির্জগতে থাকবে একটা সুসন্তুলিত অবস্থা (objective adjustment) আর সেই সঙ্গে মনোজগতে থাকবে ঈশ্বরাভিমুখী মনোবৃত্তি subjective approach) । সাধকের কখনও ভোলা উচিত নয় যে তার জীবনটা হ’ল একটা আদর্শাভিমুখী গতি (ideological flow)৷

আদর্শের দিকে মানুষ ক্রমাগত এগিয়ে চলবে৷ অনাদিকাল থেকে মানুষ সেই ভাবেই চলে আসছে আর চলতে চলতে আজ সে মানুষের স্তরে এসে পৌঁছেছে৷ এই চলার পথে তাকে কত পশু–পক্ষীর জীবন, কত কীট–পতঙ্গের জীবন যাপন করতে হয়েছে কত দুঃখ–কষ্ট, কত লাঞ্ছনা–পমান তাকে ভোগ করতে হয়েছে৷ যেমন ধরো, একটা ছাগলের জীবন৷ ঘাস খেয়ে তার দিন কাটছিল একদিন এক কসাই তাকে ধরল, কাটল, ছাল–চামড়াটা ছাড়িয়ে ফেলল৷ এমনই দুঃখময় জীবন তাকে একদিন যাপন করতে হয়েছে৷ সে কথা আজ সে ভুলে গেছে৷ আর এভাবেই এগিয়ে চলতে চলতে সে পেয়েছে আজ মানুষের জীবন৷

পশুজীবনের চেয়ে মানুষের জীবনে নিরাপত্তা অনেক বেশী৷ পশুকে জীবন কাটাতে হয় বনে জঙ্গলে যেখানে সর্বদাই একটা ভয় ভয় ভাব থাকে, এই বুঝি অন্য একটা শক্তিশালী পশু এসে আক্রমণ করে বসে, তাকে মেরে খেয়ে ফেলে৷ তাকে সর্বদাই এই রকম ভয় ভীতির মধ্যে দিন কাটাতে হয়৷ আর এই ভীতি–সন্ত্রস্ততা থেকে, এই নিরাপত্তাহীনতা থেকে বাঁচবার জন্যে অনেক বন্য পশু এসে মানুষের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল৷ মানুষ তাদের ঘাস–পালা, এটা–ওটা খেতে দিয়েছিল৷ কিন্তু হামেশাই সে একটা সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকত কখন সে তাকে মেরে কেটে খাবে৷ পশুজীবনের এটাই হ’ল কথা৷ পশু মানুষকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে এমনকি মৃত্যুর এক মুহূর্ত্ত আগে পর্যন্তও মানুষকে বিশ্বাস করে৷ কিন্তু পরে যখন তার সেই বিশ্বাসের পাত্রকে অস্ত্র হাতে তাকেই হত্যা করতে আসতে দেখে, তখন বুঝে নেয় যে সে এতদিন যাকে বন্ধু ভেবেছিল আসলে সে বন্ধু নয়–শত্রু৷ একদিন তাকে কাটবার জন্যেই ঘাস–পালা খাওয়াত৷ পশুর প্রতি মানুষের যে বন্ধুত্ব, যে দরদ, সেটা নিতান্তই লোক দেখানো৷ এতে কোন ভালবাসা নেই, সত্যিকারের কোন দরদ নেই৷ এটাই পশু জীবনের অভিশাপ৷

প্রত্যেক মানুষকে এই রকম পশু জীবনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলতে হয়েছে৷ সবাই একদিন পশু ছিল আর এই কথাটা মনে রেখেই তো মানুষের ভাবা উচিত যে তাদেরও একদিন এই রকম দুঃখময় জীবন কাটাতে হয়েছিল৷ তাই যে সমস্ত পশু আজ আমাদের আশ্রয়ে রয়েছে, তাদের যেন সে রকম জীবন যাপন করতে না হয়৷ যে নারী তার শাশুড়ীর কাছ থেকে লাঞ্ছনা–গঞ্জনা সহ্য করেছে তার তো সতর্ক হওয়া উচিত যাতে তার পুত্রবধূরা তার কাছ থেকে ওই ধরণের দুর্ব্যবহার না পায়৷ কথাটা ঠিক নয় কি? তোমরা এমনটা করো তো আজ তোমরা অনেকেই শাশুড়ী হয়েছ, একদিন তোমাদেরও পুত্রবধূ হিসেবে দিন কাটাতে হয়েছিল৷ তেমনি পশুর সম্বন্ধে মানুষেরও ভেবে দেখা উচিত যে আমাকেও একদিন পশুজীবন যাপন করতে হয়েছিল৷

মানুষের উচিত বাহ্যিক জগতে ঠিক ঠিক ভাবে আপন কর্ত্তব্য করে যাওয়া আর সর্বদা সতর্ক থাকা যাতে তার জন্যে অনর্থক কারো কষ্ট না হয়৷ এর ফলে জাগতিক ক্ষেত্রে আমার যে অধিকার সেটা সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে৷ প্রতিটি মানুষ যাতে খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় ঠিক মত পায় সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে৷ আমি কাউকে শোষণ করব না, আবার অপরের দ্বারা নিজেকে শোষিত হতেও দেব না–এটাই হ’ল বহির্জাগতিক সন্তুলন বা objective adjustment৷ অর্থাৎ বাইরের জগতের সঙ্গে ঠিক ঠিক সম্বন্ধও রাখতে হবে, আবার কাজও করতে হবে৷ কিন্তু বাইরের জগতে এই যে সামঞ্জস্য, এটাকে বজায় রেখে আমাকে জীবনে এগিয়ে চলতে হবে৷ কিন্তু একথাটা ক্ষণিকের জন্যেও ভুললে চলবে না যে আমি কেবল এই স্থূল জগতের জন্যে আসিনি৷ স্থূল জগতের জন্যে আসে পশু৷ সেখানে বাঁচবার জন্যে তাকে সর্বদাই লড়াই চালিয়ে যেতে হয়৷ কেউ জঙ্গলে রয়েছে তো সেখানে বাঘ–ভালুক, হাতী–সিংহ, সাপ–কুমীর, কত ভয়ঙ্কর জন্তুর ভয় থাকে৷ আর যে সব জীবজন্তু মানুষের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে–যেমন ছাগল, ভেড়া, গোরু–মোষ ইত্যাদি, তাদেরও সর্বদা ভয় থাকে মানুষ কখন তাদের বধ করে খেয়ে ফেলে৷ কাজেই পশুর জীবনে নিরাপত্তা কোথায় কিন্তু মানুষের জীবনে এ ধরনের জাগতিক নিরাপত্তা পশুর চেয়ে অনেক বেশী৷

এই যে বস্তুতান্ত্রিক জগতে সন্তুলন, এর জন্যে মানুষের ব্যতিব্যস্ত হওয়া উচিত নয়৷ যেহেতু আজও আমরা একটা সুষ্ঠু মানব সমাজ গড়ে তুলতে পারিনি, তাই মানুষকে খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ইত্যাদি ব্যাপারে জাগতিক অনুপপত্তি পূরণের জন্যে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয় বৈ কি৷ আদর্শ সমাজ তৈরী হয়ে গেলে তাকে এর জন্যে অযথা হয়রান হতে হবে না৷ সেদিক থেকে মানুষ কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারে৷ তখন আধ্যাত্মিক প্রগতির জন্যে মানুষ চেষ্টাশীল হবার অধিক সুযোগ পাবে, বেশী সময় পাবে আর মানুষের যে Subjective approach অর্থাৎ পরমপুরুষের দিকে এগিয়ে চলা, তার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে বাইরের জগৎ থেকে ধীরে ধীরে স্থূল মনকে প্রত্যাহার করে সূক্ষ্ম মনে, সূক্ষ্ম মনকে আত্মায় সমাহিত করতে হবে৷ আত্মা যখন পরমাত্মায় সমাহিত হয়ে যায়, তখন বুঝতে হবে, মানুষ জীবনের চরম লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে৷ আজকের পৃথিবীতে বহির্জাগতিক সন্তুলন নিয়ে মানুষকে অতি মাত্রায় হয়রান হতে হচ্ছে৷ তাই আধ্যাত্মিক প্রগতির জন্যে মানুষ বেশী সময় দিতে পারছে না৷ এটাই হ’ল সবচেয়ে দুঃখের কথা৷ তাই আমি তোমাদের বলব যে তোমরা শীঘ্রাতিশীঘ্র একটা সুস্থ মানব সমাজ তৈরী করে নাও, যাতে প্রতিটি মানুষ আত্মিক সাধনার জন্যে প্রচুর সময় ও সুযোগ পায়৷

(পটনা, ২রা জানুয়ারী, ১৯৭৯)