অমর দধীচি লহ প্রণাম

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

যাঁরা মানবতার জন্যে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁরা হলেন দধীচি৷ বাংলা ভাষায় যে শহীদ শব্দটি ব্যবহার করা হয় এর উৎস সন্ধান করলে আমরা দেখবো, মধ্যযুগে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে অন্য ধর্মাবলম্বীদের লড়াইয়ে যে সমস্ত মুসলিম মৃত্যু বরণ করতেন তাঁদের আরবী ভাষায় বলা হতো শহীদ৷ আর এই যুদ্ধের পরে যাঁরা জয়ী হয়ে ফিরে আসতেন তাঁদের বলা হতো গাজী৷ তেমনি খ্রীষ্ট ধর্মের হয়ে লড়াইতে যাঁরা প্রাণ বিসর্জন করতেন তাঁদের বলা হতো মার্ট্যার Martyr)৷ শহীদ ওMartyr শব্দ দুটির সঙ্গে তাই বিশেষ বিশেষ রিলিজিয়ন বা মতবাদের স্বার্থে লড়াইয়ের সম্পর্ক জড়িত৷ যদিও বর্তমানে এই দুটি শব্দ ব্যাপক অর্থে প্রযুক্ত হয়৷

দধীচি শব্দের সঙ্গে রিলিজিয়নে রিলিজিয়নে লড়াইয়ের কোন সম্পর্ক নেই৷ দধীচি শব্দটির উৎস এক পুরাণ কাহিনী৷ পুরাণ মানে লোক শিক্ষার্থে রচিত কাহিনী৷ পুরাণের চরিত্রগুলি ও ঘটনাবলী প্রকৃতপক্ষে কাল্পনিক, কিন্তু সেগুলি লোকশিক্ষার্থে রচিত হতো৷ পুরাণে বলা হয়েছে---

‘অষ্টাদশ পুরাণেষু ব্যাসস্য বচনদ্বয়ম্

পরোপকার পুণ্যায় পাপায় পরপীড়নম্৷’

---অর্থাৎ ব্যাসদেব যে ১৮টি পুরাণ রচনা করেছিলেন, এগুলির মাধ্যমে যা বলতে চেয়েছেন তা হলো পরপকারই পুণ্য ও অন্যকে পীড়ন করাই পাপ৷ কবি বলেছেন---

‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহু দূর

মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেতে সুরাসুর৷’

তাই দধীচি হ’ল এক প্রতীকী চরিত্র৷ পুরাণ কথিকায় বর্ণিত দেবাসুরের সংগ্রামের কাহিনীতে অত্যাচারী অসুরদের কাছে একসময় দেবতারা পরাজিত হ’ল৷ এখন উপায় কী? বিষ্ণু বললেন , এখন একটাই উপায় আছে৷ কেউ যদি স্বেচ্ছায় তাঁর জীবন দান করেন তবে তাঁর অস্থি থেকে নির্মিত বজ্রের সাহায্যেই বৃত্তাসুরকে নিধন করা সম্ভব হবে৷ তখন দেবরাজ ইন্দ্রের নেতৃত্বে দেবতারা দধীচি ঋষির কাছে গিয়ে তাঁর অস্থি দান করার জন্যে আবেদন করলেন৷ দেবের কল্যাণে দধীচি খুশীমনে স্বেচ্ছা মৃত্যু বরণ করলেন৷ তারপর দেবরাজ ইন্দ্র দধীচির অস্থিতে তৈরী বজ্রের সাহায্যে বৃত্তাসুরকে বধ করলেন৷

যাঁরা বৃহত্তর স্বার্থে---বৃহত্তর মানবতার স্বার্থে আপন জীবন বিসর্জন দেন, তাঁরাই দধীচি হওয়ার যোগ্য৷ এখানে দধীচি নামটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে, শহীদ আর ম্যাট্রেয়ার শব্দে রিলিজিয়ন রিলিজিয়নের মধ্যে লড়াইয়ে মৃত্যুবরণের সম্পর্ক, কিন্তু দধীচি শব্দটি শুভাশুভের সংগ্রামে শুভ শক্তির পক্ষে ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মৃত্যু বরণের ভাবটি রয়েছে৷

আজ বিশ্বজুড়ে সর্বক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে চরম অবক্ষায়৷ নৈতিকতা ও মানবতা মহা সঙ্কটে পড়েছে৷ তাই অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম---সর্বক্ষেত্রেই চরম দুর্নীতি ও শোষণ পরিব্যপ্ত৷  অর্থনীতির ক্ষেত্রে  সর্বত্র চলছে পুঁজিবাদী শোষণ৷ একদিকে ধনীক শ্রেণীর জিম্মায় সঞ্চিত বিপুল সম্পদের অপচয় ও অপব্যবহার, অন্যদিকে চরম অভাবে শুকিয়ে মরছে দরিদ্র সীমার নীচে পড়ে থাকা মানুষ৷ রাজনীতির নামে চলছে ক্ষমতা দখলের কাড়াকাড়ি৷ ধর্মের নামাবলীর নামের আড়ালে চলছে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও জাত-পাত- সম্প্রদায়ভিত্তিক ডগমাকে আশ্রয় করে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ হানাহানি৷ এইভাবে সমগ্র সমাজ চরমভাবে দূষিত হয়ে উঠেছে৷ সর্বত্র দেখা দিয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা৷

এই পরিস্থিতিতে  মানব সমাজের সমস্ত সমস্যা দূর করে এক আদর্শ মানব সমাজ গড়ে তোলার জন্যে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী দিয়েছেন এক সর্বানুসূ্যত জীবন দর্শন---যা সমাজের যাবতীয় সমস্যা সমাধানের পথ দেখাচ্ছে৷ পাশাপাশি তিনি সাধনা ও সেবার ভিত্তিতে গড়ে তুলেছেন একদল সর্বত্যাগী কর্মী৷ এর সঙ্গে সঙ্গে এই মহান আদর্শকে বাস্তবায়িত করে বিশ্ব মানবতা প্রতিষ্ঠার জন্যে বঞ্চিত অবহেলিত চরম দারিদ্র্যক্লিষ্ট পুরুলিয়া জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় গড়ে তোলেন আনন্দনগর৷ ঝোপ ঝাড় জঙ্গল কেটে নির্জন পাথুরে এলাকায় গড়ে তোলেন সুকল, কলেজ, শিশুসদন, হাসপাতাল, অন্ধ-মূক-বধির শিক্ষাকেন্দ্র, যোগাশ্রম প্রভৃতি বহুমুখী সেবামূলক প্রতিষ্ঠান৷

শুভ শক্তির এই অভ্যুত্থানে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে সিপিএম সহ বিভিন্ন অশুভ চক্র একজোট হয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়৷ উদ্দেশ্য আনন্দমার্গকে ধবংস করে মানবতার এই নবজাগরণকে স্তব্ধ করে দেওয়া৷ এই উদ্দেশ্যেই ওই অশুভ চক্রবিশাল গুণ্ডাবাহিনী নিয়ে আনন্দনগরের ওপর আক্রমণ চালায়৷ নরপিশাচরা সেদিন সম্পূর্ণ নিরস্ত্র আচার্য অভেদানন্দ অবধূত, আচার্য সচ্চিদানন্দ অবধূত , অবোধ কুমার, ভরত কুমার, প্রভাস কুমার---এই পাঁচ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে৷ সেটা ছিল ১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চ৷ অশুভ শক্তির হাতে নিহত এই পাঁচজন মহাপ্রাণকে স্মরণ করে বিশ্বের সর্বত্র এই বিশেষ দিনটিকে দধীচি দিবস নামে আখ্যায়িত করেন আনন্দমার্গী ও বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষ৷ এদিন এই পঞ্চদধীচিকে ও সঙ্গে সঙ্গে মানবতার কল্যাণে আরও যাঁরা আত্মোৎসর্গ করেছেন তাঁদের  সবার প্রতি জানায় সশ্রদ্ধ প্রণাম৷ অমর দধীচিদের মহান আত্মত্যাগই বিশ্বমানবতার নবজাগরণের পাঞ্চজন্য--- শঙ্খনিনাদ৷