অর্থ ও রাষ্ট্রশক্তির জোরে বাঙলা দখল সম্ভব নয়

লেখক
এইচ.এন. মাহাত

স্বাধীনতার আগে ও পরে বাঙলার শাসকের পরিবর্তন এসেছে বার বার৷ ইতিহাসের পাতায় বাঙলা একই শাসন ব্যবস্থার বস্যতা বেশী দিন স্বীকার করেনি৷

জাতীয় কংগ্রেসের হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য স্বাধীনতার নামে দেশ ভাগ করে বাঙালীস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করেছিলো৷ আর সেই সময় বলে ছিলো যারাই ওপার বাঙলা থেকে আসবে তাদের সবাইকে পুনর্বাসন দেওয়া হবে৷

দেশভাগের বলি হয়ে ওপার বাঙলা থেকে আসা বাঙালীদের আজ পর্যন্ত পুনর্বাসন দেওয়া দূরের কথা সুস্থভাবে জীবনযাপন করার সামান্য ব্যবস্থাও করেনি হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী শাসক৷ হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীরা বাঙালীর ভিতরের বৈপ্লবিক চেতনাকে ধবংস করতে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের নামে বিভিন্ন প্রদেশে অস্থায়ীভাবে বসতি  দিয়েছিলো৷ কিন্তু শরণার্থীদের বড় একটা অংশ অস্থায়ীভাবে বাঙলায় বসবাস শুরু করে৷ কংগ্রেসের আমলে নজীরবিহীনভাবে বাঙালীর উপর কর আদায়ের নামে ক্রমবর্ধমান নির্যাতন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় খরা বন্যায় খাদ্যের অভাবে মানুষ দিনের পর দিন অনাহারে থাকতো৷ ছোটবেলায় আমরা দেখেছি ভাতের মাড় বা বাশী পচা খাবারের জন্য দরজায় দরজায় বাঙালীরা ভিখিরি মত ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ সারা বাঙলার সেই বিভিষিকাময় দিনগুলিতে কমিউনিষ্টরা ওই উদ্বাস্তু শরণার্থীদের নিয়ে  শুরু করে খাদ্য আন্দোলন৷ অন্যদিকে চাষের জন্য জমিদারের তৈরী  করা আধিয়ারের নাম করে ভাগচাষীদের নিয়ে শোষণ বন্ধ করতে শুরু হয়েছিলো কমিউনিষ্টদের তেভাগা আন্দোলন৷ এই আন্দোলনের  ফলে শুরু হয় কংগ্রেসের টালমাটাল অবস্থা, কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হয় বাঙলা কংগ্রেস৷ বাঙলা কংগ্রেস সিপিআই/সিপিএমের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট যৌথভাবে আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে নির্বাচনে বাঙলায় কংগ্রেস সরকারের পতন হয়৷ আদর্শ ও উদ্দেশ্যবিহীন জোট সরকার এলেও শক্তিশালী ও একনিষ্ঠ নেতার অভাবে বেশীদিন সরকার রক্ষা হয়নি৷ কংগ্রেস ফিরে এলেও পরবর্তীতে তৈরী হয় শক্তিশালী বামফ্রন্ট৷ তাদের নেতৃত্বে অসহায় বাঙালীদের পাইয়ে দেওয়ার নামে দুই পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির জন্য ট্রাম, বাসে আগুন লাগিয়ে জন জীবনকে স্তব্ধ করা, হরতাল, বনধের নানা রকমের আন্দোলন শুরু হয়৷ ধীরে ধীরে সাধারণ জনগণের মধ্যে পুঁজিবাদী মনস্তাত্ত্বিক কংগ্রেস বিরোধী মানসিকতার প্রকাশ৷ পরবর্তীতে সেই নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বামফ্রন্ট৷ সেই বামপন্থীদের তৈরী বামফ্রন্ট বঙ্গ জয় করে৷ আমরা সেই সময় দেখেছি নিষ্ঠাবান বামপন্থী কর্মীদের, যারা ভাঙা সাইকেল, চটি পরে এক কাপড়ে সাধারণ মানুষের পাশে বসে নূ্যনতম গ্যারান্টির কথা বলতো৷ তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা দেখে মানুষ পুরনো বৈপ্লবিক ঐতিহ্যকে উপলদ্ধি করেছে৷ পরবর্তীতে সেই কমিউনিষ্টরা আদর্শকে জ্বলাঞ্জলি দিয়ে ভোগী সুবিধাবাদী হয়ে উঠে৷ বাঙলার তৎকালীন আমলের কমিউনিষ্ট সরকার সাধারণ মানুষের বহুফসলী কৃষি জমিকে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে সুলভে বিক্রি করতে গেলে আবার শুরু হয় কৃষি রক্ষার নামে আন্দোলন৷ সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম তার উদাহরণ৷ সেই সময় অনেক পুরনো বৈপ্লবিক কমিউনিষ্টরাও কৃষি জমি রক্ষা করতে আন্দোলন সামিল হয়৷ এছাড়াও বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের আমলে নক্সাল বা মাওবাদী দমনের নাম অনেক বাঙালী যুবককে গুপ্ত হত্যার প্রতিবাদে এক বিশাল জনমতে বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের অপশাসনের সমাপ্তি ঘটে মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে৷ তিনি কংগ্রেস ভেঙে তৈরি করেছেন তিনি তৃণমূল কংগ্রেস৷ আজ সেই তৃণমূলকে হটিয়ে বিজেপি বাংলা দখল করতে চায়৷ এবার আসা যাক বিজেপি বা তাদের শরিক আর এস এস বাঙলায় এমন কিছু রেখাপাত করার মতো আন্দোলন করেনি যাকে কেন্দ্র করে সরকারে আসতে পারে৷ বিজেপি বঙ্গের কিছু আদর্শহীন দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক দলের নেতাদের, ইডি,সিবিআইয়ের হাত বাঁচাতে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে তাদের দলে যুক্ত করালেও বাঙলার সাধারণ মানুষের মনে কোন রকমের প্রভাব পড়ে নি৷ পাশাপাশি সেই নেতৃত্ব কোন প্রকারের রাজনৈতিক আন্দোলন করে নি যা বাঙলা ও বাঙালীর মনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে৷ বিজেপি কিছু ভাড়া করা বহিরাগত সৈনিকদের নিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচের  বিনিময়ে বাঙলা জয় করতে চেয়েছিলো যাহা বাঙলা ও বাঙালীর সহজাত পরিবর্তনশীল মানসিকতা নয়৷ বাঙলার  সহজাত স্বভাব হলো অন্যায় অবিচার শোষণ দুর্নীতি স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে বৃহৎ কোন আন্দোলনে শামিল না হলে বাঙলার জনমত তাকে গ্রহণ করে না৷

বিজেপির বহিরাগত পরিযায়ী নেতারা বাঙালীর এই মানসিকতার খবর রাখে না৷ তারা শুধু অর্থ, রাষ্ট্রশক্তি ও সংঘটনের  জোরে বাঙলা দখলের পরিকল্পনা করেছিল৷ কিন্তু বৃহৎ কোন আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জনমানসে রেখাপাত না করে বাঙালী ও বাঙলা জয় করা আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র৷