অষ্টকমল

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

আমাদের শরীরে আটটি চক্র আছে৷ মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত ও বিশুদ্ধ– এই পাঁচ চক্র আর এর ওপর আজ্ঞাচক্র, গুরুচক্র ও সহস্রারচক্র*৷ এই হ’ল অষ্টকমল৷ পরমাত্মার লীলা এই অষ্টকমলকে নিয়ে৷

সাধনায় যখন মানুষ এগিয়ে যায় তখন কী হয়?

‘‘সর্বতঃ পাণিপাদং

তৎ সর্বতোক্ষিশিরোমুখম্৷

সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোঁকে সর্বসাবৃত্য তিষ্ঠতি৷৷’’

এই অষ্টকমল যখন ফোটে, তা কেমন করে ফোটে? মানুষ যখন মনের সমস্ত ভাবনা নিয়ে পরমপুরুষেরই উপাসনা করে তখন সমস্ত ভাবনা, সমস্ত আকুতি একের দিকেই ছুটে যায়৷

এইজন্যে বলা হয় ধর্ম বিশ্লেষণাত্মক নয়, সংশ্লেষণাত্মক৷ অনেককে এক করে নিয়ে একেরই দিকে চলা– এই হ’ল ধর্মের মূলমন্ত্র৷ আর এককে খণ্ড খণ্ড করা– এটা হ’ল জড়সাধনা৷ ধর্মের স্বভাব সংশ্লেষণত্মাক আর জড়ের স্বভাব বিশ্লেষণাত্মক৷ ধর্ম ও জড়ের মধ্যে মূলগত পার্থক্য বা মৌলিক পার্থক্য হ’ল একটা সংশ্লেষণাত্মক আর দ্বিতীয়টা বিশ্লেষণাত্মক৷ একটা অনেককে নিয়ে একের দিকে চলতে চায়, আর অন্যটা এককে অনেক খণ্ডতে বিভাজিত করে দিতে চায়৷ প্রতিটি জীবের মধ্যে যে অষ্টকমল আছে তাদের গতি একের দিকে, অনেকের দিকে নয়৷ অর্থাৎ সমস্ত কমল একেরই বন্দনা করে, একেরই উপাসনা করে– অনেকের নয়৷

এই ‘এক’ কেমন? ‘‘সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ’’৷ তুমি তোমার কমল তাঁকে উৎসর্গ করলে তিনি নেবেন না, আর অন্য আর একজন তা করলে নিয়ে নেবেন, এমনটি হতে পারে না৷ ‘‘সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ’’৷ ‘পাণি’ মানে হাত, ইংরেজীতে যাকে পাম্ (palm) বলে৷ অর্থাৎ সবার সামনে তাঁর হাত আছে৷ যে–ই কমল দিতে চাইবে, তিনি নিয়ে নেবেন৷ গরীবের নেবেন না, ধনী লোকের নেবেন– এমনটি নয়  সকলেরই নেবেন৷ যে মূর্খ, শাস্ত্র জানে না, যে ‘আইডিয়া এণ্ড আইডোলোজি’ পড়েনি, সে কি তাহলে পরমাত্মাকে পাবে না? ‘সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ’৷ তাঁর হাত সবার সামনে আছে, তাঁর ‘পাণি’ সবার জন্যেই আছে৷

‘পাদং স্তৎ’– তাঁর পা–ও সবার সামনে আছে৷ অর্থাৎ যে কর্ম করবে সে তাঁকে পেয়ে যাবে৷ ‘সর্বতোক্ষিশিরোমুখম্’৷ তাঁর চোখও সবার সঙ্গে আছে৷ তাঁর চোখ সবাইকেই দেখছে, কাউকে দেখছে না এমন নয়৷ পরমপুরুষ একজনকে দেখছেন, অন্য কাউকে দেখছে না, এমন নয়৷ পরমপুরুষ যদি একজনকে এক সেকেণ্ডের জন্যে, এক মুহূর্তের জন্যে না দেখেন বা দেখা বন্ধ করে দেন, তাহলে তার মৃত্যু হয়ে যাবে৷ জীবিত যখন আছ তখন অবশ্যই একথা মনে রেখ যে পরমপুরুষ তোমাকে দেখছেন৷ তা, মনে রেখ, পরমাত্মা যার দিকে চব্বিশ ঘণ্ঢা তাকিয়ে আছেন সে কখনও ঘৃণ্য, নীচ, বা হীন হতে পারে না৷ সামাজিক দৃষ্টিতে তুমি যদি তুচ্ছ হয়ে গিয়েও থাক, পরমাত্মার কাছে কখনওই তুচ্ছ হতে পার না৷ বলা হয়, তাঁর কাছে কেউই হেয় নয়৷ অবহেলার পাত্র নয়৷

‘সর্বতোক্ষিশিরোমুখম্’৷ সবার দিকে তাঁর মুখ আছে৷ অর্থাৎ যে তাঁর দিকে তাকাবে সে–ই তাঁকে পেয়ে যাবে  ‘সর্বতোক্ষিশিরোমুখম্’– অর্থাৎ সার্বভৌম ও সর্বকালিক রূপে তাঁকে পাবে৷ পিঁপড়ে অথবা হাতী, অজগর অথবা উই, যে–ই তাঁর দিকে তাকাবে, তিনিও তাঁর দিকে তাকাবেন, কারণ সে দিকেও তাঁর মুখ আছে৷ সাধুও  তাঁর দিকে তাকিয়ে ‘তব দ্রব্যম্’ বলে দান করলে, পরমাত্মা তা হাসতে হাসতে  নিয়ে নেবেন আর পাপীও তাঁর দিকে তাকিয়ে ‘তব দ্রব্যম্’ বলে দান করলে তিনি তা নিয়ে নেবেন– ‘সর্বতোক্ষিশিরোমুখম্’৷ ভেবে দেখ জগতে যাঁরা আত্মীয়–স্বজন, মা–বাবা তাঁরা সন্তানের জন্যে কী না করেন? তাঁরা সন্তানের কী করে ভালো হবে, একথা সবসময় ভাবেন৷ সমস্ত জীব, সকল বস্তু সম্পর্কে ভাবা তাঁর কাজ৷ তাই রাম–শ্যাম–যদু, পণ্ডিত–মূর্খ ইত্যাদির বিচার এখানে নেই৷ তুমি তোমার নিজের সমস্যা নিয়ে যতটা চিন্তিত– কী করে সমাধান হবে, কোথায় যাবে– তার চেয়ে বেশী চিন্তিত তিনি৷ তাই পৃথিবীতে তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পার৷ কারণ, তোমার মস্তিষ্ক্ যতটা মজবুত, তাঁর মস্তিষ্ক্ তার চেয়ে অনেক বেশী মজবুত৷ তোমার মস্তিষ্কের জন্ম তাঁর থেকেই৷ তাই ছোট্ট একটা মস্তিষ্ক্ নিয়ে তুমি আর কত দূর ভাবতে পারবে তার চেয়ে নিজের চিন্তা তাঁকে সমর্পণ করে দাও৷

অনেকে আছেন যাঁরা পরমপুরুষের কাছে এটা–ওটা চান৷ ভাবেন, যদি পরমাত্মাকে কোনো দিন একান্তে পেয়ে যাই তাহলে কোনো বর চেয়ে নোব৷ ‘এই বর দাও, সেই বর দাও– ছেলেরা পরীক্ষায় যেন পাশ করে যায়– মেয়েদের যেন বিয়ে হয়ে যায়, ভালো ঘর–বর পায় অথচ খরচ যেন না করতে হয়৷ কিন্তু ভেবে দেখ তোমার যা দরকার, তোমার প্রকৃত প্রয়োজন কী, তা তুমি যতটা না বোঝ, তার চেয়ে বেশী পরমাত্মা বোঝেন৷ তোমার প্রকৃত প্রয়োজন কী হতে পারে তা তুমি জান না, তিনি জানেন৷ তোমার ভবিষ্যৎ তোমার মাথায় নেই, কিন্তু তাঁর মাথায় আছে৷ ভবিষ্যতের গর্ভে কী আছে– কী বস্তু কোথায় কীভাবে নিহিত, তা তোমার জানা নেই, তিনি জানেন৷ নিজের অতীত তুমি ভুলে গেছ, তিনি কিন্তু ভোলেননি৷ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ– এই যে ত্রিকালিক বন্ধন, এটা তাঁর জন্যে নয় কারণ তিনি কালের স্রষ্টা, তাই তিনি কালবাধিত নন৷

‘সমপ্লুষিণা সম মশকেন সম নাগেন সম এভিস্ত্রিভিলোকৈঃ৷’

‘প্লুষিণ’ মানে উইপোকা আর ‘মশক’ মানে মশা৷ ‘নাগ’ শব্দের অনেক অর্থ, একটা অর্থ হ’ল পাহাড়ী ঝর্ণা৷ ‘নগ’ মানে পাহাড় আর ‘নাগ’ মানে পাহাড়ী ঝর্ণা৷ আর একটা অর্থ হ’ল ম্যামথ (mammoth) অর্থাৎ ঐরাবৎ যা বর্তমান হাতীর চেয়ে চার গুণ বড় ছিল৷ এখন এটা পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে৷ ইংরেজীতে বলে ‘মামথ’  আর সংস্কৃতে ‘ঐরাবত’ বা ‘নাগ’৷ তাই, মশা বা উইয়ের প্রতি তাঁর যতটা দরদ, ঐরাবতের প্রতিও ঠিক ততটাই৷ তাদের জন্যে তিনি যতটা ভাবেন বা চিন্তা করেন, ‘সম নাগেন’– ঐরাবতের জন্যেও ততটাই ভাবেন৷ ঐরাবতের চেয়ে এরা তো অনেক ছোট, কিন্তু তাদের প্রতিও সমান ভাবনা– বেশী কম নয়৷

‘সম এভিঃ ত্রিভিঃ লোকৈঃ’৷ আর এই যে ত্রিলোক– স্থূল, সূক্ষ্ম আর কারণ জগত, তার প্রতিও তাঁর তেমনই সমান চিন্তা, ঊনিশ–বিশ নয়৷ অর্থাৎ একটা মশা বা উইয়ের প্রতি যতটা সহানুভূতি, সমগ্র বিশ্বের জন্যেও ততটাই৷ কেউ যদি ভাবে যে সে স্পেশাল ফেবার বা বিশেষ সহানুভূতি পাবে তা কিন্তু নয়, তাঁর কাছে সবাই সমান৷