বাংলা বানান  সংস্কার

লেখক
জ্ঞানভিক্ষু

প্রাউট–প্রবক্তা মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার ভাষাতত্ত্ব ও ব্যাকরণ বিজ্ঞানের ওপরও বহু অমূল্য পুস্তক রচনা করেছেন, যা কলকাতা, ঢাকা, কল্যাণী প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অধ্যাপক সহ বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক ও জ্ঞানী গুণীজনের দ্বারা বহুল প্রশংসিত৷ তাঁর রচিত ‘প্রভাতরঞ্জনের ব্যাকরণ বিজ্ঞানে’ (৩ খণ্ড) তিনি বহু প্রচলিত অনেক বাংলা বানানের ভুলত্রুটি বা অর্থবিচ্যুতি দেখিয়ে সে সবের সংস্কার সাধনেও সচেষ্ট হয়েছেন৷ এ ধরনের কিছু বাংলা বানান সম্পর্কে তাঁর অভিমত তাঁর ভাষাতেই প্রকাশ করা হচ্ছে ঃ

গায়ত্রী

‘গৈ’ ধাতু  শতৃ  ত্রৈ  তৃচ্ প্রত্যয় করে হয় ‘গায়ত্তৃ’–গানের দ্বারা যিনি (পুং) ত্রাণের ব্যবস্থা করে দেন৷ ‘গায়ত্তৃ’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ ‘গায়ত্রী’৷ ‘গায়ত্রী’ বেদের সপ্ত ছন্দের অন্যতম৷ বৈদিক সাতটি ছন্দ হচ্ছে–গায়ত্রী, উষ্ণীক্, ত্রিষ্টুপ, অনুষ্টুপ, বৃহতি, জগতি ও পঙ্কক্তি৷ অনেকে ‘গায়ত্রী’ বানানে একটি ‘ত’ ব্যবহার করেন অর্থাৎ বানান লেখেন ‘গায়ত্রী’৷ এটা ভুল৷ দুটো ‘ত’ দিয়ে লিখতেই হবে৷ একটি ‘ত’ ‘গায়ৎ’ শব্দের, অপর ‘ত’টি ‘ত্রৈ’ ধাতুর৷ এই ধরণের ভুল অনেকে ‘পু–’ সম্বন্ধেও করে থাকেন৷ পুৎ  ত্রৈ  ড ঞ্চ পু–৷ একটি ‘ত’ ‘পুৎ’ শব্দের, অপর ‘ত’–টি ‘ত্রৈ’ ধাতুর৷ এক্ষেত্রে ‘ত্র’ দিয়ে লিখলে ভুল হবে৷ ‘গায়ত্রী’ একটি বিশেষ ছন্দ৷ তাই তার বানান ভুল হওয়া মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়৷

‘‘ওঁ আয়া হি বরদে দেবি ত্র্যক্ষরে ব্রহ্মবাদিণি৷

গায়ত্ত্রি ছন্দসাং মাতর্ক্ষ্রহ্মযোনি নমোহস্তু তে৷৷’’

‘গৈ’ ধাতু + শতৃ = গায়ৎ, ত্রৈ + ড = ত্র৷ গায়ৎ + ত্র = গায়ত্ত্র৷ এই ‘গায়–’ শব্দেরও স্ত্রীলিঙ্গ রূপ ‘গায়ত্রী’৷ ‘গায়ত্তৃ’ ও ‘গায়–’ এই দু’টি পুংলিঙ্গ শব্দেরই মানে এক, আর দু’য়েরই স্ত্রীলিঙ্গ রূপ ‘গায়ত্রী’৷ একটা ‘ত’ দিয়ে ‘গায়ত্রী’ লেখা একটা common error৷

উচিত

মূল ধাতুর আদিতে অন্তঃস্থ ‘ব’ থাকলে তার সঙ্গে ‘ক্ত’, ‘ক্তিন্’ প্রত্যয় যুক্ত হলে প্রত্যয়ান্ত শব্দ অন্তঃস্থ ‘ব’ থাকে না, সেই স্থানে ‘উ’–এর আগম হয়৷ যেমন, বচ্ + ক্ত = ‘বচ্ত’ বা ‘বত্ত’ হবে না, হবে ‘উক্ত’৷ বচ্ + ক্তিন = ‘বচ্তি’ বা বত্তি হবে না, হবে ‘উক্তি’৷ বদ্ + ক্ত = বাদিত হবে না, হবে ‘উদিত’৷ তাই যা অনুবাদ করা হয়েছে তা ‘অনুবাদিত’ না হয়ে হবে অনু + উদিত = অনূদিত৷ বপ্ + ক্ত = বপ্ত না হয়ে হবে ‘উপ্ত’ (যা বপন করা হয়েছে)৷ বচ্ + ণিচ্ + ক্ত = বচিত না হয়ে হবে ‘উচিত’৷ মনে রাখা দরকার ‘ক্ত’ প্রত্যয়ান্ত শব্দে খণ্ড ‘ত’ (ৎ) বা হসন্তযুক্ত ব্যঞ্জন হয় না৷ তাই ‘উচিত’ বানান পূরো ‘ত’ দিয়ে লিখতে হবে, খণ্ড ‘ত’ (ৎ) দিলে চলবে না৷ দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, অনেক নামজাদা সাহিত্যিকও বানান–জ্ঞান না থাকায় লিখছেন ‘উচিৎ’৷ এতে জনসাধারণ বিভ্রান্ত হন৷ আলোচিত, আপ্যায়িত, গৃহীত, বর্ধিত প্রভৃতির মতই ‘উচিত’–ও একটি পুরো ‘ত’–এর শব্দ৷ এতে খণ্ড ‘ত’ (ৎ)–এর কোন অবকাশ নেই৷ ‘উচিত’ শব্দটির ভাবারূূার্থ হচ্ছে, যা বলানো হয়েছে৷ আর ‘উক্ত’ মানে যা বলা হয়েছে৷ যোগারূঢ়ার্থে ‘উচিত’ শব্দের মানে যথোপযুক্ত, ঠিকঠাক৷ ‘উক্ত’ শব্দের ভাবারূূার্থ–যোগারূঢ়া একই৷ তবে ঋগ্বেদের খণ্ডকে বলা হয় এক একটি ‘মণ্ডল’৷ এক একটি মণ্ডলে থাকে কয়েকটি ‘সূক্ত’৷ এক একটি সূক্তে থাকে কতকগুলি ‘ঋক্’ (শ্লোক)৷ তাই ‘সূক্ত’ মানে ভাবারূূার্থে ‘যে ভাল কথা বলা হয়েছে’ আর যোগারূঢ়ার্থে ‘সূক্ত’ মানে কয়েকটি ঋকের সমষ্টি৷

ক্ষেত/ক্ষুদে

তৎসমে ‘ক্ষ’ যথারীতিই থাকে৷ তবে তা কোথাও ঋগ্বেদীয় রীতিতে, কোথাও যজুর্বেদীয় রীতিতে উচ্চারিত হয়৷ তদ্ভবে শৌরসেনী প্রাকৃতে ‘ক্ষ’ ‘খ’–য়ে রূপান্তরিত হয় যেমন ক্ষেত্র>খেত্ত>খেত্৷ মাগধী প্রাকৃতে ‘ক্ষ’ অক্ষরটির উচ্চারণ ‘ক্খ’ তাই যদিও মাগধী প্রাকৃতে তদ্ভবে ‘খ’ উচ্চারণ করা হয়, বানানে ‘ক্ষ’ রাখাই সঙ্গত, যেমন ক্ষেত্র>ক্ষেত্ত>ক্ষেত ক্ষুদ্রিক>ক্ষুদ্দিতা>ক্ষুদে৷ বাংলা মাগধী প্রাকৃতজাত ভাষা, তাই বাংলায় ‘ক্ষেত’৷ কিন্তু হিন্দী শৌরসেনী প্রাকৃত–জাত ভাষা, তাই হিন্দীতে ‘খেত’ শৌরসেনী বানান লিখতে হবে৷ অনেকে বাংলায় ‘খেত’, ‘খুদে’ বানান লেখেন৷ এর সংশোধন দরকার৷

ছাত্রা/ছাত্রী

ছদ্’ ধাতুর অর্থ আচ্ছাদন দেওয়া৷ যে বস্তু আচ্ছাদন দেয় তা–ই ‘ছত্র’৷ গুরুর ছত্রছায়ায় যে আশ্রিত তাকে ছত্র + অণ করে ‘ছাত্র’ বলা হয়৷ ‘ছাত্র’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গে দু’টি রূপ রয়েছে–‘ছাত্রী’ ও ‘ছাত্রা’৷ ‘ছাত্রী’ মানে ‘ছাত্রের পত্নী’৷ তিনি নিজে পড়ুয়া হতেও পারেন, নাও হতে পারেন৷ ‘ছাত্রা’ মানে যিনি নিজে পড়ুয়া কিন্তু তিনি কারও স্ত্রী হতেও পারেন, নাও পারেন৷

ঠিক / সঠিক

ঠক একটি বিশেষণ৷ সাধারণ নিয়মে বিশেষণের আগে ‘স’–এর সংযুক্তি হয় না৷ যেমন ‘সচকিত’ ভূল তেমনি ‘সঠিক’–ও ভুল৷ ‘ঠিক’ বলাই ঠিক৷

কাঁটাল/কাঁঠাল

সংসৃক্ত ‘কণ্ঢকীফলম্’ থেকে এসেছে ‘কাঁটাল’৷ ‘কণ্ঢক’ বা ‘কাঁটা’ শব্দে ‘ট’অক্ষরটি রয়েছে৷ তাই বানান লিখতে হবে ‘কাঁটাল’–কাঁঠাল’ নয়৷ একে অসমীয়াতে বলে কাঁটাল’, বিহার ও উত্তর ভারতে ‘কটহল’৷ পাকা কাঁটালকে সংস্কৃতে বলা হয় ‘পনস’৷ দ্রড়িয়া, মাঠী ও মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণাংশে ‘পনস’ শব্দটি বেশ প্রচলিত৷ কাঁচা কাঁটালকে বাংলায় ‘এঁচোড়’ বা ‘ইঁচড়’ বলে৷ এটি দেশজ বাংলা শব্দ৷ কম বয়সের ছেলে বেশী পাকা হলে আমরা বলি ‘ইঁচড়ে পাকা’৷