বাঙলার প্রতি কোনও অবহেলা চলবে না

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

সম্প্রতি ভারতের শীর্ষ আদালত নির্দেশ জারী করেছে যে, এখন থেকে সুপ্রিম কোর্টের রায়  ইংরেজী ও হিন্দী সহ তেলেগু, মারাঠি, কন্নড়, ওড়িয়া ও অসমিয়া ভাষাতেও মিলবে৷ এই মোট ৭টি ভাষাতে সুুপ্রিম কোর্টের এই রায় বিস্ময়জনক৷ দেশের শীর্ষ আদালত অন্ততঃ দেশের সমস্ত ভাষাভাষীদের  প্রতি নিরপেক্ষভাবে আচরণ করবে৷ এটাই আমরা আশা করব৷ সমস্ত নিরপেক্ষ বিচারশীল মানুষও এই আশা করে৷ কিন্তু অসমীয়া, ওড়িয়া  প্রভৃতি  আঞ্চলিক ভাষাতে সুপ্রিম কোর্টের  রায় দেওয়া হবে, অথচ ১৩ কোটি বাঙালীর মাতৃভাষা  বাংলাতে তা দেওয়া হবে না৷ অথচ, রাষ্ট্রসংঘেও যে ভাষায়  বত্তৃণতা দেওয়া যায়, যে ভাষাকে  রাষ্ট্রসংঘ পৃথিবীর মধুরতম  ভাষা হিসেবে  স্বীকৃতি  দিয়েছে,  যে ভাষায়  ভারতে  প্রথম নোবেল পুরস্কার  লাভ করে রবীন্দ্রনাথ  বিশ্বকবি  হয়েছেন, যে ভাষার মনীষী রাজা রামমোহন  রায়, স্বামী বিবেকানন্দ প্রভৃতি ভারতকে  বিশ্বের দরবারে সম্মানের আসনে  বসিয়েছে, সেই ভাষাকে  অবহেলা করা ও গুরুত্বহীন মনে করা  যে অতীব বিস্ময়জনক --- এতে কোনো  সন্দেহ নেই৷

সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত  ভারতের শীর্ষ আদালতের নিরপেক্ষতাকে  প্রশ্ণের মুখে দাঁড় করিয়েছে৷ সংবাদে  প্রকাশ  পশ্চিমবঙ্গ  বিধানসভায়  বাম ও কংগ্রেস বিধায়করা  সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ  করেছেন ও তাদের বক্তব্য  সুপ্রিম কোর্ট ও কলকাতা হাইকোর্টের রেজিষ্টারকে  দিয়েছেন৷

মুখ্যমন্ত্রী  মমতা  বন্দ্যোপাধ্যায়ের  উচিত, ১৩ কোটি  বাঙালীর হয়ে অবিলম্বে  সুপ্রিম কোর্টে দরবার করা যাতে  অবিলম্বে  বাংলা  ভাষাতেও  সুপ্রিম কোর্টের  রায়  পাওয়া যায়৷

কেন্দ্রীয় সরকার তো সমস্ত  রাজ্যগুলির প্রতিভূ৷ তাহলে  প্রধানমন্ত্রী মোদিজী কেন সুপ্রিম কোর্টের এই প্রস্তাবে সায় দিচ্ছেন৷ তবে তিনি বা তাঁর সরকার বাঙালী বিদ্বেষী? তাহলে কীভাবে তিনি সমস্ত  ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী  বলে নিজেকে দাবী করতে পারেন৷

স্বাধীনতার  আগে থেকেই আমরা দেখেছি, ভারতের  কেন্দ্রীয়  সরকার বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব---যাই বলি না কেন--- বাঙালীদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করে চলেছে৷ তাই গান্ধীজী বাংলার স্বাধীনতা বিপ্লবীদের অতুলনীয় ত্যাগকে কোনোদিন স্বীকৃতি দেননি৷ বীর বিপ্লবী নেতাজীর অতুলনীয় বীরত্ব ও দেশপ্রেমকেও গান্ধীজী ও তার একান্ত অনুগামী জওহরলাল নেহেরু ও অন্যান্যরা স্বাধীনতার আগে বা পরে প্রাপ্য স্বীকৃতি  দেন নি৷ তাই নেতাজীকে তাই হকু বিমান দুর্ঘটনায় মৃত বলে ঘোষণা করবার  জন্যে নেহেরু মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন৷

স্বাধীনতার বলি হিসেবে পঞ্জাব ও বাঙলাকে ভাগ  করা হ’ল৷ স্বাধীনতার পর পাকিস্তান অংশের যে সমস্ত হিন্দুপঞ্জাবী ভারতে  চলে এল তাদের পুরো ক্ষতিপূরণ দিয়ে  পুনর্বাসন করা হ’ল, অথচ, বাঙলার ক্ষেত্রে সমান দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে তা করা  হ’ল না৷ ওপার বাংলা থেকে প্রাণের দায়ে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু ভারতের  পশ্চিম বাংলা অসম  ও ত্রিপুরায়  চলে আসতে বাধ্য হল, অথচ, তাদের ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন দেওয়া হ’ল না৷ স্বাধীনতার ৭২ বৎসর পরও অসম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, দণ্ডকারণ্য  ও ভারতের  বিভিন্ন  এলাকায়  ওই সব মানুষেরা  অধিকাংশ ক্ষেত্রে আজও উদ্বাস্তু হয়ে চরম দারিদ্রের সঙ্গে  লড়াই করে  চলেছেন৷ তার ওপর অসমে তো  তাদের অনেককেই বিদেশী তক্মা দিয়ে  ডিটেনশন ক্যাম্প নামক জেলে পচিয়ে মারা হচ্ছে৷ ৪০ লক্ষ বাঙালীকে এভাবে  বিদেশী বলে চিহ্ণিত করে রাষ্ট্রহীন বলে ঘোষণা করা হয়েছে৷ সম্প্রতি নূতন এন.আর. সি  তালিকা থেকে আরও  ১ লক্ষ বাঙালীকে বিদেশী তালিকাভুক্ত করা হ’ল৷ এদের জীবনে  দুর্দশার অন্ত নেই৷  এবার ত্রিপুরা ও  পশ্চিম বাঙলায়ও এন.আর.সি করে  কোটি কোটি বাঙালীকে রাষ্ট্রহীন  করার চক্রান্ত চলছে৷

কিছুদিন আগে  কেন্দ্র থেকে পশ্চিম বাঙলায়  সুকলের হিন্দী  ভাষাকে  বাধ্যতামূলক করার পরোয়ানা জারী করেছিল৷ এর আগে  তো হিন্দীওয়ালারা বিহারে অঙ্গিরা, মৈথিলী, নাগপুরিয়া অবধি ভোজপুরী প্রভৃতি  ঐতিহ্যপূর্ণ ভাষাভাষীর মানুষের  ওপর হিন্দী চাপিয়ে  দিয়ে তাদের লিখিয়েছে  হিন্দীই তাদের মাতৃভাষা৷ এইভাবে একে একে বিভিন্ন মাতৃভাষাকেও  খুন করা হচ্ছে৷ এবার কি বাংলা ভাষাকে  খুন করার ষড়যন্ত্র চলছে?

পাশ্ববর্তী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের বেশীর ভাগ মানুষের  মাতৃভাষা বাংলা  অথচ এ রাজ্যে  বাংলা ভাষাকে  প্রধান রাজভাষা না করে  হিন্দীকে  প্রধান রাজভাষা  করা হয়েছে--- যদিও  হিন্দী এখানকার কারুর মাতৃভাষা নয়৷

এইভাবে আমরা দেখছি, অবলুপ্ত করার চেষ্টা চলছে৷ আমরা ভারতের  ১৩ কোটি  বাঙালীর  পক্ষ থেকে বাঙ্লা ভাষাকে  অবহেলা  করার সমস্ত প্রচেষ্টার প্রতিবাদ জানাচ্ছি৷

বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের কাছেও আমাদের দাবী, আরও  ৭টি  ভাষার মত সুপ্রিম কোর্টের  রায় যেন অবিলম্বে  বাংলা ভাষাতে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়৷