বিজেপি’র বাঙালী বিদ্বেষী চরিত্র

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে প্রথম নির্বাচনী সভা থেকে বীর বিক্রমে ঘোষণা করলেন---এবার ক্ষমতায় এলে পশ্চিমবঙ্গে এন.আর.সি. লাগু করবেন ও খুঁজে খুঁজে বিদেশী তাড়াবেন৷ অসমে নরেন্দ্র মোদীও এন.আর.সি.-র পক্ষে বলে গেলেন৷ তার সঙ্গে সঙ্গে বললেন---হিন্দু শরণার্থীদের নিরাপদে আশ্রয় দেওয়া হবে৷ অসমে এন আর সি লাগু করে ৪০ লক্ষ মানুষকে বিদেশী তক্মা দিয়ে তাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ তার প্রায় ৫০ শতাংশ বাঙালী হিন্দু, আর বাকী ৫০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে সংখ্যালঘু মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান প্রভৃতি৷

যাদের এভাবে নাগরিকত্ব হরণ করে’ চরম নির্যাতন করা হচ্ছে তারা অধিকাংশই কিন্তু অসমের আদি বাসিন্দা৷ বিগত ২২শে সেপ্ঢেম্বর অসমের ১৪টি জাতীয় সংঘটনের যৌথ মঞ্চ ‘বাঙালী যৌথ সমন্বয় সমিতি’র সভাপতি সুকুমার বিশ্বাস ও সাধারণ সম্পাদক সুরেশ সরকার সুস্পষ্টভাবে দাবী করেছিলেন অসমে ৮০ লক্ষ বাঙালী হিন্দুর বাস৷ এর ৫০ শতাংশ অসমের আদি বাসিন্দা৷ বলা বাহুল্য, বাঙলার বৃহৎ অংশ ব্রিটিশরা অসমের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছিল৷ যেমন কাছাড়, নওগাঁ, গোয়ালপাড়া ইত্যাদি৷ মূল বাংলাভাষী এলাকা বাংলা থেকে কেটে অসমের সঙ্গে যোগ করা হয়েছিল৷ তাই এখানকার নাগরিকদের বৈধ নাগরিকত্ব প্রশ্ণাতীত৷ অপরপক্ষে এর মধ্যে যে অপর ৫০ শতাংশ হিন্দু বাঙালী ওপার থেকে শরণার্থী হয়ে এসেছে, নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তি ও ইন্দিরা মুজিব শক্তি অনুসারে তারা বৈধভাবে ভারতীয় নাগরিকে পরিণত হয়েছেন৷ তাদের শরণার্থী প্রমাণপত্র, শরণার্থী ভিসা, ভোটার তালিকা ইত্যাদি পাঁচ ধরণের নথি বাতিল করার আর্জি জানিয়ে আদালত থেকে নির্দেশ আনিয়ে বাঙালী হিন্দুদের রাষ্ট্রহীন করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে৷ আর পূর্বোল্লিখিত আদি বাঙলার যে সমস্ত এলাকা অসমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওই এলাকার মুসলিম বাঙালী জনগোষ্ঠীও নিঃসন্দেহে ভারতীয় নাগরিক৷ তাদেরও নাগরিকত্ব হরণের কোনও অধিকার বিজেপি সরকারের নেই৷ বিজেপি অসমের উগ্র জাতিয়তাবাদী গোষ্ঠীকে তোষণ করে ক্ষমতায় আসা ও ক্ষমতায় টিঁকে থাকার লক্ষ্যেই এইভাবে অসমের বৈধ হিন্দু ও মুসলিম বাঙালীদের রাষ্ট্রহীন করার ষড়ন্ত্র করেছে৷

এইভাবে বিজেপির বাঙালী বিরোধী চরিত্রটা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছে৷ অমিত শাহরা যে চরম বাঙালী বিরোধী এটা তাদের এইসব আচরণ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায়৷ ওরা শুধু মুসলিম বিরোধী নয়, ওরা বাঙালী বিরোধী৷ বাঙালী হিন্দুদের মন পাওয়ার জন্যে ওঁরা বলে বেড়াচ্ছে ওপার বাঙলা থেকে যে সমস্ত হিন্দু বাঙালী ধর্মের কারণে স্বাধীনতার বলি হিসাবে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন তাঁদের বিরুদ্ধে ওরা নন, তাঁদের সবাইকেই শরণার্থী হিসেবে সাদরে গ্রহণ করা হবে৷ তাই যদি হয় তাহলে অসমে লক্ষ লক্ষ হিন্দু বাঙালীকে এন আর সি-র তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ডি-ভোটার করা হচ্ছে---ডিটেনসন ক্যাম্পে অমানুষিক কষ্ট দেওয়া হচ্ছে কেন? মিথ্যাবাদী অমিত শাহদের কথা শুণে যে সমস্ত বাঙালীরা নাচছেন তাঁদের বলি অসমে এন আর সি তালিকা থেকে নাম বাদ পড়া ও ডি-ভোটারের নোটিশের জেরে যে সমস্ত বাঙালীরা আত্মহত্যা করেছে বলে বিভিন্ন প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ তার অধিকাংশ হিন্দু বাঙালী কেন? যেমন এইভাবে আত্মহত্যাকারীদের তালিকায় আছে অসমের দলবাড়ি জেলার হরি সিং থানার অন্তর্গত ঘাগরা উলুবেবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা দীপক দেবনাথ (৪৯)৷ তাঁর ১৯৭১ সালের লিগাল ডেটা রয়েছে৷ সেই অনুসারে এন আর সি-র প্রথম তালিকায় নামও উঠেছিল৷ কিন্তু দ্বিতীয় তালিকায় আবার নাম বাদ দেওয়া হয়৷ ইনি তখন এন আর সি কেন্দ্রে যোগাযোগ করেন৷ আবার নতুন করে আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয়৷ এরপরে বর্ডার পুলিশ তাঁর নামে আবার ডি-বোটারের নোটিশ পাঠিয়ে দেয়৷ ডি-বোটারের মানে ডাউটফুল বোটার অর্থাৎ সন্দেহজনক বোটার৷ এ অবস্থায় দিশাহারা হয়ে পড়েন দীপকবাবু৷ এই মানসিক চাপে গত বছর ২৮শে অক্টোবর গলায় দড়ি লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন৷

তার কয়েকদিন আগে ১৯৫১ সালের অসমের বাসিন্দা হিসেবে নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও এন আর সি তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ায় ও তারপর এন আর সি কেন্দ্র থেকে বিদেশী ঘোষণা করায় দলগাঁওয়ের  অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও আইনজীবী নীরদবরণ দাস আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷ নীরদবরণবাবু তাঁর নাগরিকত্বের সমস্ত বৈধ নথিপত্র নিয়ে এন আর সি অফিস থেকে শুরু করে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন৷ দিনের পর দিন এইভাবে সরকারী অফিস ও আদালতে ঘোরাঘুরি করেও কোনও কাজ না হওয়ায় মানসিক চাপে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷

ঠিক এইভাবে একই কারণে আত্মহত্যা করেন বাক্সা জেলার বিনয় চন্দ, দলাবাড়ি জেলার গোপাল চন্দ্র দাস, টাংলের বিমল চন্দ্র ঘোষ প্রমুখ৷

তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি সরকার এন আর সি নামে সমস্ত বাঙালীদের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত৷ বাঙালী বিদ্বেষী বিজেপি এইভাবে বাঙালী অধূ্যষিত ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে এন আর সি লাগু করতে চাইছে৷ ভারতের আর কোনো রাজ্য নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই৷ যদিও দেশে বহু সীমান্ত রাজ্য রয়েছে ও সীমান্ত সমস্যা রয়েছে, কিন্তু বাঙালীদের বিরুদ্ধেই বিজেপির যত কোপ৷

বাঙালী বিদ্বেষী বিজেপি বিভিন্ন জনসভায় এন আর সি-র কথা বলে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়ুল মারছে---নিজেদের কবর নিজেরাই তৈরী করছে৷