বিজন সেতুর পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে

লেখক
আচার্য ত্র্যম্বকেশ্বরানন্দ অবধূত

পূর্ব প্রকাশিতের পর

অথচ ১৯৬২ সালে যখন চীন ভারত দখল করতে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন সেই কাজে চীনের কম্যুনিষ্টরা যাতে সফল হয় সেই জন্যে  ভারতের কম্যুনিষ্টরা ভারতের জনগণকে বোঝাবার চেষ্টা করলো--- চীন আক্রমণকারী নয়, ভারতই আক্রমণকারী, চীন শুধু তার জবাব দিচ্ছে৷

---এই হচ্ছে কম্যুনিষ্টদের ভারত প্রেমের বহর৷ আর ওরাই আজ আওয়াজ তুলেছে ‘‘আনন্দমার্গীরা ভারত বিদ্বেষী’’!

‘‘ভারতবিদ্বেষী, দেশের শত্রু, বিদেশের চর’’ ইত্যাদি গুজবের লক্ষ্য  আগামীদিনের সম্ভাব্য যুদ্ধ৷ চারিদিকে যে রকম অস্ত্র শয্যা চলছে তাতে যেকোন দেশ যেকোন সময় ভারতকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতে পারে এমন আশংকা প্রধানমন্ত্রীও অহরহই করছেন৷ প্রমদ দাশগুপ্ত ও জ্যোতি বসুর দলও জানে যে আশঙ্কা অমূলক নয়৷ সেই যুদ্ধের আগে থেকেই যদি  ‘দেশের শত্রু’ ‘বিদেশের চর’ বলে আনন্দমার্গের বিরুদ্ধে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখা যায়, তাহলে যুদ্ধের ডামাডোলে আবার পার্টির অ্যাকশন স্কোয়াড দিয়ে  আরও বড় আকারের হত্যাকাণ্ড সহজেই সংঘটিত করা যাবে ও আবার জনগণের কাঁধে অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে  আসামীর কাঠগোড়ায়  দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে৷

‘আনন্দমার্গ সাম্প্রদায়িক সংঘটন’ ‘আনন্দমার্গ মুসলমানদের শত্রু এই আওয়াজ তুলে  মুসলমানদের দিয়ে  আনন্দমার্গের বিরুদ্ধে একটা দাঙ্গা বাঁধাবার চক্রান্ত চলছে সমানতালে৷  কিন্তু কম্যুনিষ্টদের সে গুড়ে বালি পড়েছে৷ গত ১৩ই জুলাই যখন সেদিন সন্ধ্যায় দিল্লীর রামলীলা ময়দানে আনন্দমার্গ আয়োজিত জনসভায় ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রধান, ইমাম আবদুল বোখারি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে আনন্দমার্গের কার্যকলাপের প্রশংসা করলেন ও ইসলামের শিক্ষানুয়ায়ী নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে ৩০শে এপ্রিলের হত্যাকারীদের খুঁজে বার করার জন্যে কেন্দ্রীয় বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবীকে সমর্থন করলেন৷

অতএব এখন কী যে কেউ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় না যে , সি.পি.এম শুধু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাই নয়, আরোও মারাত্মক হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের লিপ্ত রয়েছে৷

সি.পি.এম যে হত্যাকারী তা সন্দেহাতীতভাবে  প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও সিপি এম প্রশ্ণ তুলেছে--- তারা কেন হত্যা করতে যাবে?

আনন্দবাজার পত্রিকার ৪ঠা মের সম্পাদকীয়তেই এই  প্রশ্ণের উত্তর রয়েছে৷ সম্পাদক লিখেছেন--- কসবা তিলজলা নারকীয় হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ণ উঠিয়াছে৷ প্রথম প্রশ্ণ, যে এলাকায় একটি রাজনৈতিক দলের এত প্রভাব সেখানে তাহাদের অজান্তে  এত বড় ও ব্যাপক একটি হত্যাকাণ্ড ঘটিতে পারে কি না? সকলেই জানেন, তিলজলা-কসবা এলাকা সিপিএমের শক্ত  ঘঁটি৷  সকলে ইহাও জানেন  সিপিএমের কর্মী ও নেতারা ওই এলাকায় দীর্ঘদীন ধরিয়া আনন্দমার্গের বিরুদ্ধে জোর প্রচার চালাইতেছিলেন৷  এখন কাহারও এ বিষয় সন্দেহ নেই যে, শুক্রবারের হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত৷ আনন্দমার্গীরা ওই সময় ওই সব পথ দিয়া যাইবেন জানিয়াই  কিছু লোক রাস্তার মোড়ে মোড়ে  তাঁদের জন্যে অপেক্ষা করিতেছিল৷ আনন্দমার্গীরা সরাসরি অভিযোগ তুলিয়াছেন, ইহারা সিপিএমের লোক৷ --- দলের পরিকল্পনা অনুসারে ইহারা ওইদিন তাঁহাদের অবধূত কর্মীদের হত্যা করিয়াছে৷ এই অভিযোগের জবাবে কিছু লোক আবার বলিতেছেন--- না, এ কাজ সিপিএম করে নাই, কিছু বাইরের লোক আসিয়া তিলজলা-কসবা এলাকায় মারণযজ্ঞ সমাধা করিয়া পালাইয়া গিয়াছে৷ এই প্রসঙ্গেই ওই প্রশ্ণটি উঠিয়াছে--- যে এলাকায় সিপি এমের এত প্রভাব সেই এলাকায়  বাইরের কিছু লোক আসিয়া এত  ব্যাপক একটি হত্যা যজ্ঞ সমাপ্ত করিয়া পালাইতে পারে কিনা? ঘাতকরা যে ঐ দিন ভোর হইতেই  এলাকার একাধিক রাস্তার মোড়ে  অপেক্ষা করিতেছিল তাহাতে এখন আর সন্দেহ নাই৷                   সি পি এমের শক্ত ঘাটিতে বাহিরের ঘাতকরা আসিয়া  দলবদ্ধভাবে ওৎ পাতিয়া  অপেক্ষা করিতে সাহস পায়, ইহা কি বিশ্বাসযোগ্য? সি পি এমের লোকজন আগে বা পরে তাহাদের চ্যালেঞ্জ করিল না কেন?, বাধা দিতেই এগিয়ে এল না  কি কারণে?

পুলিশের নিস্ক্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে সিপিএমের লোকজনের মনোভাবই কি প্রমাণ করে না কি  এই ঘটনা সিপি এম ঘটিয়েছে?

এরপরেও  প্রশ্ণ  উঠেছে, নির্বাচনের আগে সিপি.এমের  পক্ষে এই ধরণের আইনশৃঙ্খলার  অবনতি ঘটানো কি সম্ভব--- যার অজুহাতে নির্বাচন বানচাল হতে পারে ও যেখানে নির্বাচন বানচাল হলে সিপিএমের সব থেকে বেশি ক্ষতি?

এর উত্তরে বলা যায় যে, একমাত্র নির্বাচনের আগেই ঐ ধরণের ঘটনা ঘটানো সি.পি.এমের পক্ষে  অনুকুল৷ কারণ স্থানীয় পুলিশ থেকে শুরু করে সমগ্র পুলিশ প্রশাসনকে নিস্ক্রিয় করে না রাখলে ঐ ধরণের বিভৎস হত্যাকান্ড ঘটানো যায় না৷ অথচ পুলিশ প্রশাশনের দায়িত্ব হচ্ছে সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু৷ তাই সিপি এম জানতই যে হত্যাকান্ড, তা যে যখনই সংগঠিত করুক, তার দায় সিপিএমের ঘাড়ে যেতে বাধ্য৷ কিন্তু নির্বাচনের আগে যদি এই হত্যাকান্ড ঘটানো যায়, তাহলে জনসাধারণকে এই বলে বোকা বানানো যাবে যে, যেখানে আর মাত্র ২০ দিন বাদে নির্বাচন ও যে নির্বাচনে সিপিএম জিতবে বলেই নির্বাচনকে  তরান্বিত করেছে সেখানে নির্বাচন ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে, এমন একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সিপিএম নিশ্চয়ই সেধে করতে যাবে না৷ অর্থাৎ আপাত দৃষ্টিতে যখন সকলেরই মনে হবে যে, সিপিএমের পক্ষে এখন এ কাজ করা সম্ভব নয় একমাত্র তখনই হত্যাকান্ডের ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব ---ও সিপিএম সেই ঝুঁকিই নিয়েছে৷ সামনের নির্বাচন ছিল সিপিএমের পক্ষে আত্মরক্ষার এক বিরাট চাল, আর তাই নির্বাচনের আগের দিনগুলিই ছিল সিপিএমের পক্ষে আক্রমণের প্রকৃষ্ট সময়৷ এই কৌশলের নাম ‘Strategium Paradoxical’’ অর্থাৎ ‘কৌশলগত বৈপরীত্য’৷ এছাড়া নির্বাচন প্রক্রিয়া এতদূর এগিয়ে গিয়েছিল যে নির্বাচন বন্ধ করা যাবে না৷ সে বিষয়ে সিপিএম নিঃসন্দেহ ছিল৷ তাছাড়াও নির্বাচনী প্রচারে চাঙ্গা পার্টি কর্মীদের দিয়ে ব্যাপারটির মোকাবিলা করা  সহজ ছিল৷ নির্বাচনের সময় পারস্পরিক দোষারোপের মধ্য দিয়ে ঘটনাটা চাপা পড়ে যাবে এই ছিল সিপিএম পার্টির হিসাব৷ সিপিএম পার্টির আরও মোক্ষম হিসেব ছিল৷ ত্রিপুরা তথ্যমন্ত্রী অনিল সরকার কসবা-তিলজলায় ৯ই মে বলেন, ‘‘আনন্দমার্গীদের কুৎসিত চেহারা, নৃশংস হত্যালীলা ত্রিপুরার মানুষ দেখেছে আশিতে৷ কম্যুনিষ্ট বিরোধিতায় এরা সব পারে৷ ১৭ কেন ১৭০০ খুন করতেও এরা দ্বিধা করবে না৷ সতর্ক থাকুন৷’’ (গণশক্তি ১৫ই মে)৷ হিসেব ছিল আনন্দমার্গীরা ‘হত্যার বদলে হত্যার নীতি’ নিয়ে কম্যুনিষ্টদের হত্যা করলে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে আনন্দমার্গের নেতা ও কর্মীদের জেলে পুরে ফেলা যাবে৷ কিন্তু ওদের যে সে হিসেব ভন্ডুল করে আনন্দমার্গীরা জনতার সামনে সমস্ত নথিপত্র নিয়ে উপস্থিত হয়ে, জনতাকে সিপিএম পার্টির নেতারা আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, সেই জনতাকে থেকে সম্মানে আসামীর কাঠগড়া থেকে বের করে এনে বিচারকের আসনে বসিয়ে জনতার দরবারে ঘটনার বিচার প্রার্থনা করল৷    (ক্রমশঃ)