বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই

লেখক
কিংশুক রণজন সরকার

(আনন্দনগরে অনুষ্ঠিত আনন্দমার্গ ধর্মমহাসম্মেলনে রেণেশাঁ ইয়ূনিবার্সালের প্রেসিডেণ্ট হিসেবে শ্রদ্ধেয় পুরোধা প্রমুখ বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে ভাষণ দেন৷ উক্ত ভাষণের সারসংক্ষেপ লিখে পাঠিয়েছেন পত্রিকার বিশেষ প্রতিবেদক আচার্য মোহনানন্দ অবধূত)

ধর্ম মহাসম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় বাবা (শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী) নোতুন  কোন তত্ত্বের ওপর প্রবচন দিতেন৷ আমরা সাধারণ মানুষ সে ধরণের নোতুন তত্ত্ব দিতে পারি না৷ তবে বাবার দেওয়া নোতুন তত্ত্বের সঙ্গে বর্তমান বিজ্ঞানীদের চিন্তাধারার তুলনামূলক আলোচনা আমরা করতে পারি৷ এখন বৈজ্ঞানিকগণ কোন কিছুকে ভিত্তি মেনে নিয়ে তত্ত্ব দেন৷ যেমন এককোষী জীবকে ভিত্তি ধরে জীবের বিকাশের ওপর বৈজ্ঞানিকগণ তত্ত্ব দিয়েছেন৷ তেমনি আধ্যাত্মিকতাতেও কিছুকে ভিত্তি করে আলোচনা ও ক্রিয়া অনুষ্ঠানাদি গড়ে উঠেছে৷ আর সেই আধ্যাত্মিকতার ভিত্তি হ’ল ঈশ্বর বা ব্রহ্ম বা পরমপুরুষ৷ এই হিসেবে বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার মিল খুঁজে পাওয়া যায়৷

বিজ্ঞান বলছে সব কিছু জড় থেকে এসেছে৷ মনও জড় থেকে তৈরী৷ কিন্তু আধ্যাত্মিকতা বলছে সব কিছু ব্রহ্ম থেকে এসেছে৷ সঞ্চরধারায় ব্রহ্মের বিবর্তনের শেষ পর্যায়ে জড় তৈরী হয়েছে৷Something cannot be created out of nothing. সুতরাং জড় বা matter সৃষ্টি হওয়ার পেছনে কারণ আছে৷ বিজ্ঞান একটা কথার জবাব দিতে পারেনি যে---‘আমি কোথা থেকে এসেছি৷

আইনষ্টাইন হলেন এক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক৷ তাঁর দেওয়া তত্ত্ব হ’ল E=Mc2৷ তিনি বলেছেন, বিজ্ঞানে আমাদের যে inner sense  (অন্তরিস্থ চেতনা) আছে তাকে মানা হয় না৷inner sense   ছাড়া কোন কিছুই তো অনুভব করা যাবে না৷ জ্ঞান কি? জ্ঞান হ’ল---বাহ্যিক বিষয়ের আত্মস্থিকরণ৷ সুতরাং আত্মা অর্থাৎ আমাদের অন্তর্জগৎকে মানতে হবে৷ এই অন্তর্জগৎকে নিয়ে আলোচনা হ’ল আধ্যাত্মিকতা৷ যারা আধ্যাত্মিকতা নিয়ে চলেন তাদের আমরা মহাত্মা বলি৷ আমাদের ইচ্ছা, আবেগ প্রভৃতি আছে৷ বিজ্ঞানে কেবল জড় নিয়ে চর্চা করা হয়৷ কিন্তু তাদের কাছে এই মনের ইচ্ছা, আবেগের কোন স্থান নেই৷ তাই আইনষ্টাইন বলেছেন--- আমাদের অন্তরের আবেগ, অনুভব এগুলোর কথা ভাবা প্রয়োজন৷

আরও এক প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক বলেছেন---কেবল জড়কে মূল বস্তু ধরে নিয়ে বৈজ্ঞানিকগণ যে সব কিছুর গবেষণা করছেন ---এতে তাঁরা মস্ত বড় একটা ভুল করে চলেছেন৷ বৈজ্ঞানিকগণ এই পৃথিবীর যে ছবি তৈরী করেছেন তা মানবিক আবেগ, অনুভূতিকে বাদ দিয়ে৷ বিজ্ঞান ভিত্তিক বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাতেও এই আবেগ ইচ্ছা ও অনুভূতিকে বাদ দিয়ে সব কিছু শিক্ষা দেওয়া হয়েছে৷ তাই ‘বাবা’ শিক্ষার ক্ষেত্রে নোতুন ভাবনা দিয়ে গেছেন৷ আর বলেছেন---‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে৷’

এক মহান বৈজ্ঞানিক বলেছেন---বিজ্ঞান না আধ্যাত্মিকতা এ নিয়ে তর্ক করলে চলবে না৷ উভয়কে নিয়েই চলতে হবে৷

তবে ধর্ম মানে রিলিজিয়ন নয়৷ ধর্মের মূল কথা হ’ল পরমপুরুষকে প্রাপ্তির পথে এগিয়ে চলা৷ ধর্ম হ’ল যা মানুষের মধ্যেকার পশুত্বকে দেবত্বে উন্নীত করে ও ব্রহ্ম সম্প্রাপ্তি এনে দেয়৷ এটাই হ’ল প্রকৃত ধর্ম৷

বিজ্ঞান যেমন কার্যকারণ তত্ত্ব মেনে চলে আধ্যাত্মিকতাও কার্যকারণ তত্ত্ব মেনে চলে৷ যেমন নিউটন বলেছেন আপেল নীচে পড়ার কারণ মাধ্যাকর্ষণ শক্তি৷ নিউটনের আরেকটি তত্ত্ব হ’ল প্রতিটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে৷ তেমনি আধ্যাত্মিকতাও বলছে মানুনষের প্রতিটি কর্মের সমান প্রতিকর্ম আছে৷ কর্মের পর প্রতি কর্মের বীজ মানুষের মনের মধ্যে থাকে৷ তাকেই আধ্যাত্মিক দর্শনে বলা হয় সংস্কার৷ তা পরে কর্মফল রূপে প্রকাশ পায়৷ তাই কার্যকারণ তত্ত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা একই কথা বলছে৷ তাই আধ্যাত্মিকতা পুরোপুরি যুক্তিভিত্তিক৷

যেখানে যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাস নিয়ে মানুষ চলছে তার মানসিক প্রগতি হবে না৷ ভাবজড়তা (ডগমা) জনিত কারণে মনেদ্দর বিকাশ ঘটবে না৷ তাই ধর্মে কোন অন্ধবিশ্বাস থাকা উচিত নয়৷ কার্যকারণ তত্ত্ব মেনে যুক্তিতর্কের দ্বারা বিচার-বিশ্লেষণ করে ধর্মেরপথে চলতে হয়৷

তাই আমাদের বাঁচতে হলে বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা দুই নিয়েই চলতে হবে৷ প্রকৃত বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে কোন বিরোধ নেই৷ তাই বাবা (শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী) বলেছেন ---আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত subjective approach through objective adjustment— জাগতিক বস্তুর উপযুক্ত ব্যবহার করে পরমাগতির দিকে এগিয়ে চলতে হবে৷ এতেই মানব জীবনের সাফল্য নিহিত আছে৷ আমাদের বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা উভয়কে নিয়েই চলতে হবে৷