বোধোদয়

লেখক
শ্রী সনৎকুমার দত্ত

সম্প্রতি ‘বর্ত্তমান’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হ’ল৷ সংবাদটির সারমর্ম এই যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভূগর্ভ থেকে মানুষের যথেচ্ছভাবে জল তোলায় উদ্বিগ্ণ৷ এই যথেচ্ছভাবে ভূগর্ভ থেকে জল তোলা যাতে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ও সেই সঙ্গে বৃষ্টির জল যাতে সংরক্ষিত হয় তার জন্য সরকার চিন্তা-ভাবনা করছেন৷

খবরটি পড়ে মনটা যেন কেমন করে উঠলো কেননা খবরটির সঙ্গে আমি অন্তরের টান অনুভব করছি৷

বহুবছর আগে, তা অন্ততঃ তিরিশ/পঁয়তিরিশ  বছর আগে,পরম শ্রদ্ধেয় মনীষী শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার মহাশয় এ ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন৷

তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বুদ্ধির মুক্তি---নব্যমানবতাবাদ’-এ এব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন৷

মানুষের অস্তিত্ব ত্রি-স্তরাত্মক৷ দেহ মন ও আত্মা নিয়েই একটি পূর্র্ণঙ্গ মানুষের জীবন৷ অন্যভাবেও বলা যায় ‘অস্তি, ভাতি ও আনন্দম্’---এই তিনভাব নিয়েই মানুষের জীবন৷

আমরা সবাই জানি, মানুষ শুধুমাত্র উদর উপস্তু জীব নয়৷ তার ‘মন’বলে একটি জিনিস আছেতার ‘আত্মা’ বলে আরও একটি জিনিস আছে৷ 

আমরা সচরাচর দেখে থাকি--- অধিকাংশ মানুষই জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়েই ব্যস্ত থাকেন৷ তাঁরা মনে করেন এতেই বুঝি তাঁরা সুখে থাকবেন আনন্দে থাকবেন৷

কিন্তু, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মানুষ এতে, সম্পূর্ণ সুখ পায় না আনন্দ তো দূরের কথা৷ কেননা ‘আনন্দ’ সুখেরও উপরে৷ জাগতিক ভোগ-বিলাসে মানুষ যখন বীতশ্রদ্ধ হয়-তখনই তার টনক নড়ে৷ সে তখন অন্য ধরণের সুখ চায়৷ ‘অন্য ধরণের সুখের’ সন্ধানে সে আধ্যাত্মিকতার সংস্পর্শে আসে ৷ কিন্তু আধ্যাত্মিককতার সঙ্গে থাকা অত সহজ সাধ্য নয়৷ এর জন্য প্রয়োজন সাধনার৷ এই সাধনাই তাকে আনন্দের সন্ধান দেয়৷ এই ‘আনন্দ’ অন্য জগতের জিনিস, কিন্তু, তা’ আপেক্ষিক জগতের সঙ্গে সম্পর্কও রাখে৷ মানুষ থাকে আপেক্ষিক জগতে৷ এই আপেক্ষিক জগতে থাকতে গেলে তাকে আপেক্ষিক জগতের রীতিনীতি মেনে চলতে হয়৷ অথচ, তার মন ‘পারমার্থিক জগতে  যেতে চায়৷ তাই, মানুষকে আপেক্ষিক জগতের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে চলতে হয়৷

কীভাবে এই সামঞ্জস্য বিধান করতে হয়---তা শ্রীসরকার তাঁর ওই বই এ আলোচনা করেছেন৷

সংক্ষেপে বলা যেতে পারে  তাকে তিনধরণের ‘ভাব প্রবণতা’ বা sentiment’ থেকে সাবধান থাকতে হবে৷

এই তিন ধরণের ভাব প্রবণতা হচ্ছে ‘ভৌম-ভাবপ্রবণতা’ ‘গোষ্ঠীগত ভাব প্রবণতা‘ ও ‘সাধারণ মানবতাবাদে কেন্দ্রিক ভাব প্রবণতা৷’

মানুষ আজ পর্যন্ত যে একটা,সর্র্বঙ্গসুন্দর ‘সমাজ’ গড়ে তুলতে পারে নি---তার একমাত্র কারণ হচ্ছে সে এই তিন ধরণের ভাবপ্রবণতা থেকে আজও যুক্ত হতে পারে নি৷ সে কথাই শ্রীপ্রভাত রঞ্জন সরকার ওই বই-এ বলেছেন মানুষকে, তাই, আনন্দের সন্ধান পেতে হলে, ‘নব্যমানবতা-বাদের’ আশ্রয় নিতে হবে৷

এইজন্য মানবতাবাদ মানুষকে শেখায় পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে৷ মানুষকে আজ তাই এই  ecological balance’ রাখতেই হবে৷ তাকে জীবজগৎ, উদ্ভিদ জগৎ , পশুজগৎ , ও জড় জগৎকে রক্ষা করতেই হবে৷ অনেক পরে হলেও মানুষ আজ উদ্ভিদ জগৎ , পশুজগৎকে বুঝতে শিখেছে মান্যতা দিতে শিখেছে৷ শেখেনি শুধু জড় জগৎকে মান্যতা দিতে৷ আলো, বাতাস আবহাওয়া এদেরকেও তো মানতে হবে৷ তা না হলে মানুষ বাঁচবে কী করে? তাই  শ্রীসরকার, তাঁর ওই গ্রন্থে এদের সকলকে নিয়েই বাঁচতে শেখার পরামর্শ দিয়েছেন৷ এটাই হল নব্যমানবতা-বাদ’ যা সর্বরোগের মকরধবজ৷