‘‘বোটের লাগিয়া ভিখারি সাজিনু’’

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

এককালে জঙ্গীপুর (মুর্শিদাবাদ) এর দাদাঠাকুর প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থায় ধনিক শ্রেণীর ভোট ভিক্ষাকে ব্যঙ্গ করে গান বেঁধেছিলেন ও নিজেই জমিদারের বিরুদ্ধে একজন দরিদ্র অশিক্ষিত মানুষকে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে তার পক্ষে দলবল নিয়ে ওই গান গেয়ে প্রচারেও নেমেছিলেন৷ সেই দাদাঠাকুরের বাঁধা গানে ছিল---

‘‘আমি ভোটের লাগিয়া

ভিখারি সাজিনু,

ফিরিনু গো দ্বারে দ্বারে’’

বা---

‘‘ভোট দিয়ে যা ও ভোটাররা

মাছ কুটলে মুড়ো দেব---

ধান ভানলে কুঁড়ো দেব

কালো গোরুর দুধ দেব

দুধ খাওয়ার বাটি দেব

ভোট দিয়ে যা ও ভোটাররা৷’’

সময় বদলেছে কিন্তু সেদিনের নির্বাচনী চিত্রটি যেন হুবহু এক রয়ে গেছে৷ আজও দেখছি কোটিপতি নির্বাচন প্রার্থীরা---যাঁরা সবসময় পাইক পেয়াদা বেষ্টিত হয়ে থাকেন, সাধারণ গরীব মানুষের সঙ্গে যাঁদের কোন যোগাযোগ নেই, তাঁরা নির্বাচনের আগে এক মাসের জন্যে হঠাৎ ভিখারি বনে গেছেন৷ বোটের ভিখারী৷ দলবল নিয়ে হাত জোড় করে দরজায় দরজায় যান তাদের সুখ-দুঃখের খবর নেন, ঝুপড়ি বাড়ী থেকে, ফুটপাতের দোকান থেকে জলের পাত্র তুলে গলা ভেজাচ্ছেন, সবাইকে বোঝাচ্ছেন---‘আমি তোমাদের লোক’৷ পথের পাশে দণ্ডায়মান মহিলার কোল থেকে তাঁর শিশুকে নিজের কোলে নিয়ে গাল টিপে দিচ্ছেন, তাঁদের মন জয় করার জন্যে৷ নানান ধরণের প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে চলেছেন৷ ভোটে জিতে বেরিয়ে এলে অবশ্য ওইসব প্রতিশ্রুতির কথা আর খেয়ালই থাকবে না৷ থাকবার কথাই নয়৷ তখন ওঁদের পায় কে! এখন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কাছে টেনে নিয়ে তাঁদের হাত নিজের মাথায় দিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করছেন, কিন্তু নির্বাচনের পর তাঁদের কথা মনে থাকবে না৷ মনে থাকবে কেবল তাদের কথা যারা পুঁজিপতি ব্যবসায়ী, প্রমোটার, দাপুটে মস্তান---তাদের কথা৷ তখন গরীব সাধারণের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেও ওদের প্রয়োজন ফুরোবে না৷ বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই নেতারা পাক্কা অভিনেতা বা অভিনেত্রী৷ এমনিতে অভিনেতা/অভিনেত্রীরা তো নেতা-নেত্রীদের দলে ভিড়ছেনই, কিন্তু পেশায় অভিনেতা/অভিনেত্রী ছাড়াও যেসব নেতা-নেত্রী আছেন তাঁরাও যে মোটেই কম অভিনেতা-অভিনেত্রী নন তা তাঁদের এইসব আচরণ দেখে স্পষ্ট মালুম হয়৷

আসলে এইসব নেতা-নেত্রীরা ভালভাবে জেনেই রাজনীতিতে নেমেছেন যে বর্তমান রাজনীতিটা হ’ল বিনা লগ্ণীতে লাভজনক ব্যবসার পথ৷

নৈতিক চরিত্রের মানের দিক থেকে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এরা দেউলিয়া৷ চলতি লোকসভার সদস্যদের একটা বড়ো ভাগই বিভিন্ন ফৌজদারী মামলায় জড়িত৷ নির্বাচন কমিশনারের কাছে দাখিল করা হলফনামাতেই দেখা গেছে বর্তমান লোকসভার ৩৪ শতাংশ সদস্যের বিরুদ্ধেই রয়েছে মারাত্মক ধরণের ফৌজদারি অভিযোগ৷ এর আগের লোকসভাতে (২০০৯তে নির্বাচিত) ৩০ শতাংশ সদস্যের বিরুদ্ধেই ছিল ফৌজদারি মামলা৷ এসব অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফরমস্ (এডিআর) এর রিপোর্ট৷ এই রিপোর্টে আরও দেখা যাচ্ছে, ওই সময় লালুপ্রসাদ যাদবের আর.জে.ডি-র সমস্ত সাংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধেই ছিল ফৌজদারি মামলা৷ শিবসেনার ১৮জন এম.পি.-র মধ্যে ১৫ জনের বিরুদ্ধেই ছিল ফৌজদারি মামলা, এ.ডি.আর-এর রিপোর্ট বলছে, দেশের মধ্যে মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার থেকে জয়ী সবচেয়ে বেশী সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধেই রয়েছে ফৌজদারি মামলা৷

আর এই সমস্ত নেতা-নেত্রীদের অর্থনৈতিক অবস্থান হ’ল এদের অধিকাংশই কোটিপতি৷ এর মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডুর দল টি.ডি.পি-র জয়দেব গালার সম্পত্তির পরিমাণ ৬৮৩ কোটি টাকা৷ টি.ডি.পি-র সংসদ সদস্যদের গড় সম্পত্তির পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা৷ এ.ডি.আর-এর রিপোর্ট থেকে জানা যায়, কংগ্রেসের সংসদ সদস্যদের গড় সম্পত্তির পরিমাণ ১৬ কোটি টাকা৷ বি.জে.পি-র এম.পি.দের গড় সম্পত্তি ১১ কোটি টাকা, সি.পি.এমের এম.পি.দের গড় সম্পত্তির পরিমাণ ৭৯ লক্ষ টাকা ইত্যাদি অর্থাৎ উক্ত এম.পি.রা সকলেই স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশই পুঁজিপতি ও পুঁজিপতিদেরই তাঁবেদার৷ আন্তরিকভাবে গরীব জনসাধারণের কথা তাঁরা চিন্তা করে না৷ নিজেদের ক্ষমতাপ্রাপ্তির জন্যে যেটুকু চিন্তা করার প্রয়োজন শুধুমাত্র সেটুকু চিন্তাই তাঁরা করেন৷

পুঁজিবাদী ভাবধারার বিষাক্ত বৃত্তের মধ্যেই তাঁদের সমস্ত চিন্তাভাবনা, তাই অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণের বাইরে তাঁরা চিন্তা করতেই পারেন না৷ তাই বর্তমানে যত প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল রয়েছে সবার অর্থনৈতিক মতবাদ অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণের মধ্যে আবর্তিত৷

সবাই মনে করেন, দেশের বেকার সমস্যা দূর করতে ও দারিদ্র দূর করতে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের সাদরে আমন্ত্রণ করা ছাড়া উপায় নেই৷ তাই প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী সবাই দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের সন্তুষ্ট করতে সদাব্যস্ত৷

কিন্তু শোষক পুঁজিপতিদের কৃপায় যে দেশের জনসাধারণের শোষণমুক্তি সম্ভব নয়, দেশের দারিদ্র ও বেকার সমস্যার সমাধানও মোটেই সম্ভব নয়---এই সহজ সত্যটুকু বোঝবার সামর্থ্য এদের কারো নেই৷ তাই স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৭২ বছর ধরে এই নীতি অবলম্বন করে চলে দেশের জনগণের যথার্থই অর্থনৈতিক উন্নতি হয়নি, দেশের ধনীদের সম্পত্তি ক্রমশঃই বেড়েছে ও ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে৷ দেশের সমস্ত ক্ষেত্রে ধনীদের ক্ষমতা-প্রতিপত্তি বিপুল পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে৷