ভারতে ‘বিদেশী’ কারা ?

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ বলা হচ্ছে ভারতকে৷ আমাদের সংবিধানে এই দেশটাকে বলা হয়েছে ভারত তথা ইন্ডিয়া৷ আবার শুণি আয়তনের পরিমাপেও নাকি আমাদের সংবিধান বৃহত্তম--- সম্ভবতঃ ওজনেও তা-ই হবে৷ কারণ, এখন পর্যন্ত এই সংবিধানে তালি-লাগানোর সংখ্যা সেঞ্চুরি পার করে গেছে অনেক আগেই৷ অবশ্য তালি-লাগানো কথাটা এখানে ‘অ্যামেন্ডমেন্ট’-অর্থেই সহজ বাংলায় বোঝাতে চেয়েছি করিজেন্ডাম-অর্থে তো নয়ই৷ জানিনা কতদূর সঠিক হয়েছে৷ গোড়াতে এই বিশাল ভূ-ভাগ খণ্ড খণ্ড জনপদ অর্থে বিভিন্ন রাজাদের শাসনাধীন অসংখ্য রাজ্যে বিভক্ত ছিল আর রাজ্যে রাজ্যে সুপ্রাচীনকাল থেকেই ঠোকাঠুকি ও লাগালাগি অর্থাৎ প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে লিপ্ত থাকত৷ আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে কুরুক্ষেত্রের মহারণের পরেই তারকব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণ মহারাজ যুধিষ্ঠিরের শাসনাধীনে ‘মহাভারত’ অর্থাৎ একচ্ছত্রাধীন বিশালায়তন ভারত রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন৷ কিন্তু কালক্রমে সেই বন্ধনও শিথিল হয়ে পড়ে নানাবিধ কার্যকরণে৷ পরবর্তীকালে গ্রীক সম্রাট আলেকজাণ্ডারও ভারত-অভিযানে এসে সমগ্র দেশটা জয় করতে পারেন নি৷ বৈদিকযুগে আর্যরাও বাইরে অর্থাৎ মধ্যএশিয়া থেকে এদেশে এসেছিলেন--- অর্থাৎ আর্যরা কোনমতেই ভারতের আদি তথা ইন্ডিয়াজেনাস তথা ভূমিপুত্র বা সাবেক বাসিন্দা ছিলেন না৷ এদের সাবেক বা ওরিজিন্যাল বাসিন্দা বলতে যাদের বোঝায় তারা হলে অষ্ট্রিক গোষ্ঠীরও কোল বা অষ্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ৷

ইতিহাসের মত আজ থেকে প্রায় দশলাখ বছর আগে হোমো-সেপিয়ানস্‌-প্রজাতিভুক্ত মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল এদেশেই যখন দেশটার নাম আদৌ ভারতবর্ষ ছিল না৷ তখন ভারতবর্ষ তো ছিলই না৷ হিমালয় পর্বতও ছিল না৷ --- আর্যাবত্ম, গুজরাট, রাজস্থানের থর মরুভূমি, আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর কিছুই ছিলনা৷ আজ যেখানে হিমালয় রয়েছে সে স্থানে ছিল টেথিস সাগর৷ আর টেথিস সাগরের দক্ষিণতীর থেকে দক্ষিণে অষ্ট্রেলিয়া, পশ্চিমে আফ্রিকা আর পূর্বে ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত একই ভূ-ভাগ ছিল---গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ড৷ মানুষের নিঃশ্বাস যখন এ পৃথিবীর বাতাসকে উত্তপ্ত করেনি এ সেই সময়কার কথা৷ আজ যেখানটায় পশ্চিমবাঙলার পশ্চিম প্রান্তে পরেশনাথ পাহাড়ের অবস্থান রয়েছে তারই পূর্বদিকে ছিল সুপ্রাচীন রাঢ় আর পশ্চিম ছিল ঝাড়খণ্ড৷ আজ থেকে প্রায় ত্রিশকোটি বছর পূর্বে গণ্ডোয়ানা ল্যাণ্ডের বুকে রাঢ়ের উৎপত্তি, যেখানটায় আজ থেকে প্রায় দশলাখ বছর আগে পৃথিবীর প্রথম মানব সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছিল৷ ওরা ছিল নৃতাত্ত্বিক বিচারে অষ্ট্রিক-গোষ্ঠীর মানুষ৷ ওদের ভাষার নামও ছিল কোল বা অষ্ট্রিকভাষা৷ একমাত্র রাঢ়েই তখন বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতার প্রাণীন স্পর্শ আর মানুষের উদ্ভূতির উপযুক্ত পরিবেশ৷ তাই, পৃথিবীর প্রথম মানব সন্তানের সূতিকাগার ছিল---এই রাঢ়৷ আবার, রাঢ়কে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল বিশ্বের প্রাচীনতম নদীমাতৃক সভ্যতা ও  সংস্কৃতি৷

আর্যরা ভারতে পুরাতন অধিবাসী বা আদিবাসী কোনটাই ছিল না৷ আজ থেকে প্রায় সাত কিংবা আটহাজার বছর পূর্ব থেকে ওরা মধ্য-এশিয়ার পশ্চিম দিক থেকে ভারতের উঃ-পঃ সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল৷ ভারতে আর্যদের প্রবেশকালে বা এরও পূর্ব থেকে এদেশের মূল বাসিন্দা যারা ছিল, তাদের আর্যরা ‘অনার্য’ আখ্যা দিয়েছিল৷ কিন্তু বুঝতে হবে যে, এই অনার্য বলতে কোন গোষ্ঠী-বিশেষকে বোঝাত না৷ সেই সময়কার ভারতের অধিবাসী---(১) অষ্ট্রিক (২) মঙ্গোলীয় (৩) অষ্ট্রিক আর নিগ্রো গোষ্ঠী মিশ্রণ-জাত দ্রাবিড় গোষ্ঠীগুলিরই, সাধারণ পরিচয় ছিল---অনার্য৷ অবশ্য পরে আর্য-অনার্যের সংঘর্ষ ও সমিতির ফলে আর্যদের সঙ্গে রক্ত-মিশ্রণ ঘটে যায়৷ তবে উত্তর ভারতীয়দের ও পঃ-ভারতীয়দের সঙ্গে আর্যরক্তের সংমিশ্রণের যে মাত্রা, সেই তুলনায় পূর্ব কিংবা দঃ-ভারতের ক্ষেত্রে তা নেই বললেই চলে৷

ভাষার ক্ষেত্রেও আর্যরা কথা বলত তাদের বৈদিকীভাষায় যা’ আবার অন্যেরা বুঝত না৷ এদেশীয়রা যে ভাষায় কথা বলত, সেগুলোও আর্যরা বুঝত না বলেই বলত পাখীর কিচির মিচির৷ পরবর্তীকালে বৈদিকভাষার সঙ্গে এদেশীয় ভাষার সংমিশ্রণ সংশুদ্ধিও সহযোগ ঘটিয়ে নোতুন একভাষা ধীরে ধীরে গড়ে গড়ে উঠেছিল তাও’ প্রায় আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে৷ সংস্কারকৃত এই ভাষারই নামকরণ হয় সংস্কৃত ভাষা৷ সংস্কৃতভাষা সম্পূর্ণরূপেই ভারতের নিজস্বভাষা--- বহিরাগত নয়, কেবল আর্যদের ভাষাও নয়৷ উল্লেখ্য যে, আর্যদের নিজস্ব কোন হরফ ছিল না বলেই বেদ লেখা হত না৷ অথচ অষ্ট্রিকরা তন্ত্র প্রভাবিত ছিলেন বলে তাদের বর্ণ বা অক্ষর ছিল অর্থাৎ এদেশীয়দের লেখার নিজস্ব হরফ ছিল৷ সেজন্যেই সংস্কৃত ভাষায় নিজস্ব হরফ না থাকায় সংস্কৃত কাব্য-সাহিত্য লিখিত হয়েছে বিভিন্ন হরফের মাধ্যমে৷ বর্তমানে সংস্কৃত বা হিন্দী যে হরফে লেখা হয়, সেটি হচ্ছে গুজরাটি নগর ব্রাহ্মণদের প্রবর্তিত হরফ আর সেজন্যেই এর নাম হয়েছে নাগরীলিপি থেকে দেবনাগরী লিখিত লিপি৷

অনেকের মতেই বর্তমানের বাঙালী জনগোষ্ঠীরটার সৃষ্টি  হয়েছিল আজ থেকে প্রায় তিনহাজার বছর পূর্বে৷ আধুনিক বাঙালী জনগোষ্ঠী হচ্ছে (১) অষ্ট্রিক (২) মঙ্গোলীয়, (৩) দ্রাবিড় আর কিঞ্চিৎমাত্রায় ছিটে-ফোঁটা আর্যরক্তের সংমিশ্রণে এতটাই কমমাত্রায় যে বাঙালীর রক্তে আর্য-রক্তের সংমিশ্রণ প্রায় নেই বললেই চলে৷ তাই, নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোন, ঐতিহাসিক যুক্তি ও বিজ্ঞান-নির্ভর যুক্তির দিক থেকে বিচার করে দেখলে শুধু বাঙলা বা ভারতই নয় এমনকি পৃথিবীতেই আজ আর শুধু একটিমাত্র মানুষকেও খুঁজে বের করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেও চিহ্ণিত করা সম্ভব হবে না যে, ওই লোকটির দেহে নৃতাত্ত্বিক নির্দিষ্ট কোন বিশেষ গোষ্ঠীর রক্ত বইছে৷ সুতরাং এমতাবস্থায়, কোন মানুষটি কোথাকার আদিবাসিন্দা আর কে স্বদেশী ও কে বিদেশী, সেটা বিচারের সাধ্যি কোন্‌ মানুষটির থাকতে পারে বলে বিচারসম্মতভাবে যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারবে? তাই বলব, ভারতের মাটিতে কে বা কারা বিদেশী আর বহিরাগত কারা, অনুপ্রবেশকারী কারা আর কারা মূল বাসিন্দা ইত্যাদি সনাক্ত করার অধিকার বোধ হয় প্রকৃতি স্বয়ং বা বিশ্বপিতা পরমসৃষ্টিকর্র্ত ও বিশ্বনিয়ন্তা কাউকেই লেখা -পড়া করে দিয়ে রাখেননি৷