ভারতে ‘বিদেশী’ কারা ?

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

পূর্বপ্রকাশিতের পর

সুতরাং, এমর্মে যারাই স্বদেশী-বিদেশী ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ণের অবতারণা করছেন তাদের এককথায় বলতে হবে---অজ্ঞ, অর্র্বচীন, কূপমণ্ডুক, সংকীর্ণ চেতা, পলিটিক্যাল গেম্বলার ও সর্র্বেপরি মানবজাতিরই মহাশত্রু মানব-বিদ্বেষী৷ বস্তুতঃ সমাজে থেকেই ওরা বিষাক্ত ‘বাইরাস’ সেজে সমাজকে কলূষিত করে চলেছে ও নানাভাবে নানাপর্যায়ে মানবজাতির প্রগতি, সমৃদ্ধিকে বিপরীত করছে ও অধিরোহণকে আটকে রাখতে অপপ্রয়াস চালাচ্ছে৷ সুতরাং, এদের দুষ্ট গ্রাস থেকে মানবজাতিকে ও মানবসমাজকে রক্ষা করাটাই হবে আজকের বুদ্ধিমান, বিবেকবান ও প্রজ্ঞাসমৃদ্ধ মানুষের একমাত্র পবিত্র কর্ম৷

ভারতাত্মার মর্মবাণী---বহুর মধ্যে এককে দেখা ও সেই এক হচ্ছেন বিশ্বস্রষ্টা পরমপিতা,---পরমেশ্বর৷ তাই, স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন---‘‘জীবে প্রেম করে যেইজন/সেইজন  সেবিছে ঈশ্বর’’৷ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক ওজস্বীনি ভাষায়---‘‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে৷ কবি চণ্ডীদাস বলেছেন---‘‘জগৎ জুড়িয়া একজাতি/ সেই জাতির নাম মানুষ জাতি’’৷  আনন্দমার্গ দর্শনের ভাষায়---‘‘হরর্মে পিতা গৌরী মাতা স্বদেশভুনত্রয়ম্‌’’৷ অর্থাৎ হর হচ্ছেন পরমপিতা পরমব্রহ্ম কল্যাণসুন্দরম্‌ শিব প্রকৃতি স্বয়ং হচ্ছেন জগন্মাতা আর বিশ্ববাসীর স্বদেশ বা বাসস্থান ত্রিভুবন জুড়ে৷ ভারতীয় শাস্ত্র বলছে ‘‘উদারচরিতানাং তু বসুধৈব কুটুম্বকম্‌৷’’ বসুধা কথাটির মানে পৃথিবী৷ তাই বলা হয়েছে--- উদারচরিত,প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী ও সংকীর্ণতামুক্ত ব্যষ্টির দৃষ্টিতে সমগ্র পৃথিবীর শুধু মানুষই নয় বরং মানুষ, জীবজগৎ, উদ্ভিদ-জগৎ ও বস্তুজগৎ অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টিজগৎ নিয়েই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আর সবটাই হচ্ছে একমেবাদ্বিতীয়ম্‌ পরমেশ্বরেরই সৃষ্টি৷ তাই, বিশ্বের সমগ্র মানবিকসত্ত্বা, ছোট-বড় প্রতিটি জীব, তৃণলতা, গুল্ম বৃক্ষাদি সহ প্রতিটি বস্তুকণা নিয়েই এক বিশ্বপরিবার ও আনন্দপরিবার একই সূত্রে গাঁথা৷ তাই বিশ্বে কেউ কারোর পর নয়---বরং পরমাত্মীয়, এজন্যেই মানবোচিত আইডিয়া হবে--- ‘‘নিজে বাঁচো ও অপরকেও বাঁচতে দাও৷’’ সুতরাং ভেদ-বিভেদ, আপন-পর, দূরের কাছের বিচার, বর্ণ-বৈষম্য, বা অন্য কোনো রকমের বিভাজন চিন্তাধারাই অমানবোচিত বলে বিবেচনা হওয়া চাই৷ নতুবা মানবিক আদর্শ, মানুষের ভাগবৎ-ধর্ম তথা ইউনিবার্সালিজম-এর কোম মাহাত্ম্যই রক্ষা পায় না৷ আর তাহলে এ যাবৎ মানুষের  শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ত্যাগ, সেবা, সাধনা, তপশ্চর্যা  সবকিছুই মূল্যহীন হয়ে দাঁড়ায়৷

তাই বলতে হচ্ছে যে, বৈশ্য-প্রভাবিত সমাজ-ব্যবস্থায় শোষক শ্রেণী তথা পুঁজিবাদী গোষ্ঠী সর্বদাই সংকীর্ণ চিন্তাধারা, জাতভেদ, জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতা, ভাষা-সংস্কৃতি ধর্মীয়-গোঁড়ামি, কূপ-মণ্ডুকতা ইত্যাদি বিভিন্ন মন-গড়া বাহানার মাধ্যমেই তারা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে রাখতে চায়, যাতে মানুষে মানুষে বিভাজনের উস্কানী দিয়ে তারা শুভশক্তি ও অশুভশক্তি এ দু’য়ের মধ্যে বিরোধ তৈরী করে লালন-পালন করে থাকে যত্ন সহকারে যাতে ক্ষমতার অলিন্দে, নিষ্কন্টক হয়ে বসে থাকা সম্ভব হয় ও কায়েমী স্বার্থ অক্ষুণ্ণ্ রাখা যায়৷ সুতরাং এযুগের বুদ্ধিমান ও বিচারপ্রবণ ব্যষ্টিদের মানবতার স্বার্থেই ওইসব সমাজ শত্রুদের চিহ্ণিত করে কোনঠাসা করে রাখাই হবে পরমব্রত পালন৷

প্রসঙ্গ ক্রমেই উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, শাসকগোষ্ঠী হিসেবে ‘ভাগ করো আর শাসন করো’--- এই নীতির সুদক্ষ ধারক ছিল ব্রিটিশ জাতি৷ কিন্তু, সেই ব্রিটিশদেরই অনুসৃত-রীতি মেনে ১৯৪৭ সালের পর থেকে ব্রিটিশ-শাসনমুক্ত ভারতে ব্রিটিশ তথা পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী ও শোষকগোষ্ঠীর যোগ্য উত্তরাধিকারী হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী শোষক-কাম-শাসক গোষ্ঠী, তাদের সাকরেদ, দালাল, অনুচর ও আমলাচক্র বিগত আটদশক ধরে ভারতে চূড়ান্তরূপে এই বিভেদ কামিতা, বিভাজন নীতি ও বিচ্ছিন্নতাবাদ চালিয়ে যাচ্ছে অবাধগতিতে৷ অবাধগতিতেই চালিয়ে যাচ্ছে কেন? না, ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে যে কয়েকশ’ রাজনৈতিক দলগুলো ভারতে রয়েছে ওদের প্রত্যেকটি দলেরই না রয়েছে কোন উপযুক্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক দর্শন, প্রকৃত ও উপযুক্ত সমাজ সচেতনার লাভের আদর্শ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, না রয়েছে নৈতিকতাবোধ ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা৷ তাই ওদের রাজনীতি নিজেদের ভোগ-বিলাস ও ক্ষমতাভোগের মজা লুটতে--- জনসেবা বা  সত্যিকারের দেশপ্রেম ওদের চরিত্রে কোন ঠাঁই নেই বলেই ওরা পুরো দস্তুর আত্মস্বার্থে নিমগ্ণ, সমাজের প্রতি দায়-দায়িত্বহীন, তাই, প্রবঞ্চনা প্রতারণা কপটাচারিতা, হঠকারিতা, ধূর্তমি শঠতা---এসবই ওদের রাজনীতির আসল মূলধন৷

তাইতো, বর্তমানের বিশ্বায়ন ও ইন্টারনেটের যুগে যেক্ষেত্রে মানুষ চাঁদে ও মহাকাশে অন্যান্য গ্রহে পাড়ি জমাতে নয়, ঠাঁই খুঁজে নিতে বদ্ধপরিকর, সেক্ষেত্রে ভারতের পুঁজিপতিবাদের ক্রীড়নকরা অর্থাৎ শাসকরূপী শোষকেরা ওই ‘ডিবাইড’ নীতির ফসল ঘরে তুলতে এন.আর.সি, সি-এএ, দেশী, বিদেশী, স্বদেশী, ভিনদেশী, উদ্বাস্তু অনুপ্রবেশকারী, ডি-বোটার, ডিটেনশন ক্যাম্প, ---এইসব নিয়ে বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত করে চলেছেন, একমাত্র তাদের শোষণসহ অপশাসন চালাবেন বলেই৷ আর জরদগব ভারতীয় জনগণ নিরীহতার নামে কাপুরুষতা, অসহায়তার নামে আত্মসমর্পণ করেই যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে চলেছেন৷ ভারতের সংবিধান-মোতাবেক নাগরিকত্ব-আইনকে সরকার কীভাবে এতটা উদাসীনতা বা  অপরাগতকে নীরব সমর্থন জানতে পারছেন, তা ভাবতেও  গা ঘিন ঘিনিয়ে উঠে৷ আরেক বিষয়ও রয়েছে৷ শাসকগোষ্ঠী যতই দেখাক তা--- না-না-না--- প্রতিবাদীর কপালে জুটবেই বিড়ম্বনা৷ অত কিম?