ভারতের গণতন্ত্রের প্রহসন

লেখক
কৃষ্ণমোহন দেব

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)

‘‘গণতন্ত্রের দ্বিতীয় ত্রুটি হ’ল যে বোট পাবার জন্য নেতাগণ যত্রতত্র অনেক নির্বাচনী ভাষন দেন৷ যে ভাষনগুলি অন্তসারশূন্য বিভ্রান্তকর আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও ধাপ্পাবাজীতে ভরা৷’’ যেমন মোদিজী, অমিতজী আর তাঁদের পার্টির লোকেরা পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য মিটিং এর পর মিটিং এর অনুষ্ঠান করে চলেছে আর পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বলছেন বিজেপি ক্ষমতায় আসবে আর সোনার বাংলা তৈরী করবে৷ এই মোদীজী ও তার পার্টি প্রথমবারে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে অর্থাৎ ২০১৪এর সাংসদ নির্বাচনে হাওয়া উঠিয়েছিল যে মোদিজী ও তাঁর পার্টি শাসনে আসলে বিদেশ থেকে ভারতের যত কালো টাকা বিদেশের ব্যাংকে জমা রয়েছে তা এনে দেবে ও ভারতের সাধারণ জনসাধারণের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পনের (১৫) লক্ষ করে টাকা জমা দিয়ে দেবেন, বছরে দু’কোটি বেকারের চাকুরী করে দেবেন অর্থাৎ পাঁচবছরে দশকোটি বেকার চাকুরী পাবে আর ভারতে আচ্ছে দিন আনবেন, আরও কত কী৷ জনগণের মন মোহিত করা প্রতিশ্রুতির হাওয়া উঠিয়ে বিজয় লাভও করেন আর মোদীজীও প্রধানমন্ত্রীর আসন দখল করেছিলেন৷ কিন্তু ২০১৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত পাঁচ বৎসর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বিদেশ থেকে এক কানা কড়িও কালো টাকা আনতে পারেন নি আর পাঁচবছরে দশকোটি বেকারদের চাকুরী জুটেনি বরং ওই সময় আড়াই কোটি মানুষ তাদের কর্ম থেকে বরখাস্ত হয়েছে৷ জনগণের মনকে বিদেশের কালোটাকা আনার ৩ বছরে দু’কোটি বেকারের চাকুরী ও অন্যসব দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য চালাক মোদিজী হঠাৎ এক হাজার টাকা ও পাঁচশ’ টাকার নোট বাতিল করেন৷ আর জনগণকে শোনাতে লাগলেন ভারতের মধ্যে কালোটাকা ও জাল নোটের  জন্য ভারতের বিকাশ সম্ভব হচ্ছে না, নোট বাতিল দেশের কল্যাণের জন্য করা হয়েছে৷ কিন্তু এর ফলস্বরূপ দেখা গেল কোন কালোটাকা বা জাল নোট ধরা পড়েনি দেশে যত পাঁচশ টাকার ও হাজার টাকার নোট রিজার্ভ ব্যাংক ছেড়েছিল প্রায় সব নোট-ই, বদলের ফলে, ব্যাংকে এসে গিয়ে ছিল৷ বরং দেখা গেছে বিজেপির পার্টি ফাণ্ড কয়েকগুন বেড়ে গিয়েছিল ও সেই সঙ্গে পার্টির স্থাবর সম্পত্তির বৃদ্ধি হয়েছিল নোট বাতিলের আগে ভাগে৷

মোদীজীর ওই নোট বাতিলের ভুল পদক্ষেপের জন্য সারা ভারতের মানুষকে কত না হয়রানি হতে হয়েছে৷ আর নোতুন দু’হাজার ও পাঁচশ টাকার নোট ছাপানোর জন্যে হাজার হাজার কোটি টাকা অকারণ খরচ হয়েছে৷ পুরানো পাঁচশ ও হাজার টাকার নোট  ব্যাংকে বদলের জন্য ভারতের মানুষকে রোদ-জল সহ্য করে পথে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন দিতে হয়েছে৷ যার ফলে প্রায় দু’শ জন লোকের প্রাণহানি হয়েছে৷ এই অমূল্য প্রাণগুলির মৃত্যুর কারণ তো মোদিজী৷ তখন মানুষের হাতে একহাজার ও পাঁচশ টাকার নোট যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও অনেক পরিবারকে অনাহারেও থাকতে হয়েছে আর কর্মসংস্থানের মালিকগণ বহু মানুষকে ছাটাই  করতে বাধ্য হয়েছিল৷ নিরাপত্তা ও হয়রানি থেকে বাঁচবার জন্য মানুষ শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছে৷ কিন্তু এক্ষেত্রে মানুষ সরকারের দ্বারা হয়রান হয়েছে ও প্রাণ বিসর্জন করেছে৷ মোদীজী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য যে সকল প্রতিশ্রুতির হাওয়া উঠিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আসন দখল করলেন সে সব প্রতিশ্রুতির কোনকিছুই ঠিকভাবে কার্যকর করতে পারেন নি৷ অথচ এ এক বড় পরিহাস যে ২০১৯ এর সাংসদ নির্বাচনে মোদিজীর বিজেপি পার্টি ২০১৪ এর নির্বাচনের থেকে আরও বেশী সিটে বিজয়ী হয়ে’ দ্বিতীয়বার দিল্লীর মস্‌নদে বসেছেন৷ ২০১৪-এর নির্বাচনে বিজেপী পার্টি এককভাবে ২৮০ এর মত সিটে জয়ী হয়েছিল আর ২০১৯ এর  সাংসদ নির্বাচনে বিজেপি পার্টি এককভাবে ৩০৫ এর মত সীটে বিজয়ী হয়েছে৷ এ ভারতের গণতন্ত্রের প্রহসন নয় কি? এটা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বড় রকমের প্রহসন৷ ঠিক এমনই ছিল বামফ্রন্ট তথা সি.পি.এম পার্টির দীর্ঘ ৩৪ বছরের রাজত্ব৷ বোটাররা যাতে বোট (ভোট) দিতে না আসে সে জন্য আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে’ বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট ও হাইটেক রিগিং করে নির্বাচনের পর নির্বাচনে জয়ী হয়ে দীর্ঘ ৩৪ বছর শাসন ক্ষমতাকে কুক্ষীগত করে রেখেছিল৷ যারা তাদের পার্টি করত না বা তাদের মিটিং মিছিলে যেতন না তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে, পরিকল্পিতভাবে মারিচ ঝাঁপি, সাইবাড়ী, ধানতলা, বানতলা, বিজনসেতু প্রভৃতি গণহত্যাগুলি প্রকাশ্য দিবালোকে করেও নির্বাচনের পর নির্বাচনে জয়ী হয়ে’ শাসনক্ষমতা কায়েম করেছিল৷ এ কি জনগণের বা জনগণের ইচ্ছানুযায়ী শাসন! এও ছিল গণতন্ত্রের আর এক ধরণের প্রহসন৷ পশ্চিমবঙ্গে সি,পি এম-এর শাসন ছিল শাসকশ্রেণী ও তাদের স্বজন ও তাদের কেডারদের সুবিধাভোগের জন্য আর হার্র্মদ পুষেছে ভোটে জয়ী হওয়ার জন্য৷

গণতন্ত্রে চোর ডাকাতদের প্রবঞ্চকদের, ধান্দাবাজদের খুশী করে চলতে হয় নির্বাচনে জয়লাভ করবার জন্য৷ সরকার এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে না কারণ সরকার যদি এদের দুর্নীতিমূলক কাজকর্ম বন্ধ করতে চায় তাহলে সরকার ক্ষমতা হারাবে৷ এও গণতন্ত্র শাসন ব্যবস্থার বড় ত্রুটি ৷ তাই দেখি, মোদিজী স্বচ্ছ (সাফাই) ভারতের  পরিকল্পনা নিয়েছিলেন কিন্তু দুর্নীতিমুক্ত ভারত গড়ার কথা বলতে বা ডাক দিতে সাহস করেন নি৷ যদি দেশ দুর্নীতির রমরমাতে ভরে থাকল তো শাসন ব্যবস্থা কিসের জন্য? কেবল রাস্তা পরিষ্কার করে দিলে হলো? শাসন ব্যবস্থা তো দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য৷ কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যারা শাসনক্ষমতায় থাকে তারাও দুষ্টেরই প্রতিপালিত করে থাকে৷

বলা হয় যে গণতন্ত্রে হলো অধিকাংশ জনগণের সমর্থনের শাসন বা শাসনব্যবস্থা৷ কিন্তু আসলে বহু দলীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থায় দেখা গেছে সংখ্যালঘুরাই শাসনব্যবস্থায় এসে যায়৷

অধিকাংশের সমর্থন মানে শতকরা পঞ্চাশ (৫০) ভাগের বেশী লোকের সমর্থন৷ কিন্তু নির্বাচনে চার-পাঁচ বা অধিক প্রতিদ্বন্দী প্রতিদ্বন্দীতা করলে দেখা গেছে এদের মধ্যে যিনি শতকরা ৩০টি বা ২৫টি বোট লাভ করেছে সেই বিজয়ী হয়ে গেছে কারণ অন্যেরা এককভাবে ৩০ শতাংশ বোট এর অধিক লাভ করতে পারে নাই৷ ৭০-৭৫ শতাংশ লোকের বিজয়ী প্রার্থীর জন্য সমর্থন নেই৷ কোনদল পঞ্চাশের বেশী আসনে জয়ী হলো ও সেইদলই সরকার গঠন করল৷ আর সেই দলেরই সমগ্র জনগণের উপর কর্ত্তৃত্ব কায়েম হ’য়ে যায়৷ অথচ দেখা গেছে শতকরা পঞ্চাশভাগেরও কম শুধু নয় জনগণের ২৫-৩০ শতাংশ লোকের সমর্থন লাভ করেছে মাত্র৷

এই সংখ্যালঘুরাই ক্ষমতায় এসে যাচ্ছে ও তাদের ইচ্ছামত দলের  স্বার্থ অনুযায়ী বিল পাশ করে নেয় আর ইচ্ছামত তৈরী আইন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়৷

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পদস্থ সরকারী অফিসারগণ শাসকদলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে না৷ কারণ সচিবালয় শাসকদলের  মন্ত্রী মণ্ডলের দ্বারা পরিচালিত হয৷ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে না কারণ বিচার বিভাগের  সর্বেসর্র্ব হলেন জনৈক মন্ত্রী৷ চার বিভাগের অফিসারদের ওপর চাপ সৃষ্টির ফলে নিরপেক্ষভাবে বিচারের রায় পাওয়া যায় না বা আইনসম্মত বিচারের রায়ও দেওয়া হয় না৷ ঠিক তেমনি রাজস্ব বিভাগের কাজকর্মও ঠিকভাবে হয় না৷ ক্ষমতাসীন দলের চাপে সে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না৷ ফলে জনগণের অর্থ বে-নামেও যথেচ্ছভাবে আত্মসাৎ শাসকগোষ্ঠী করে থাকে৷ এব্যাপারে আমরা ভূষি কেলেঙ্কারী, ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারী, চারা ঘোটালা, কয়লা কেলেঙ্কারী, প্রভৃতির সঙ্গে বিশেষ ভাবে পরিচিত৷