দেশপ্রেমিকের প্রতি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

এখন কী করা উচিত--- ভাষাভিত্তিক প্রদেশের কথা ভূলে গিয়ে অবিলম্বে সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ভিত্তিতে প্রদেশগুলির পূনর্ঘটন করা, জীবনের সর্বক্ষেত্রে জনসাধারণের ইংরেজীসহ প্রতিটি ভাষাকে নিজ নিজ অঞ্চলে ষোল আনা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত৷ এ ব্যাপারে বাংলা, হিন্দী, মারাঠী,তামিল প্রভৃতি উন্নত ভাষাগুলিকে ও মৈথিলী, ভোজপুরী, মগহী, তুলু, কাঙ্কনী, প্রভৃতি অনুন্নত ভাষাগুলিকে ঠিক সমান নজরে দেখতে হবে উনিশ বিশ করলে চলবে না৷ কাউকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করলে চলবে না৷  ভাষার ক্ষেত্রে সবাই যদি সমান সুযোগ সুবিধা পায় তবে কেউই ভাষাভিত্তিক  প্রদেশের কথা ভাববে না৷ ভবিষ্যতে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের কোন প্রয়োজন দেখা দেবে কিনা তা ভবিষ্যতের ভারতীয় নেশন স্থির করবে তা নিয়ে বর্তমান নেতাদের মাথা ব্যথা করাবার কোন প্রয়োজন নেই৷ তাঁরা যেন সবার প্রতি সুবিচার করে যান৷ ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ইংরাজির স্থানে অন্য কোন ভাষা ব্যবহার করার আবশ্যকতা আছে কি না নিয়েও বর্তমানের নেতাদের মাথা না ঘামালেও চলবে৷ তার আগে তাঁরা এক সুদৃঢ় সেন্টিমেন্টের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তুলুন৷ নেশন গড়ে ওঠার পর রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে ইংরাজি থাকবে কি না বা ইংরাজির স্থানে অন্য কোন ভাষা ব্যবহার করা উচিত হবে কি না এ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব ভবিষ্যত্যের ভারতীয় নেশন গ্রহণ করবে৷

আঞ্চলিক বিবাদ-বিসম্বাদ দেখা দিতে পারে এমন সমস্যা নিয়েও সময় অপচয় করার এটা উপযুক্ত সময় নয়৷ এখন যে নেশনই নেই! বহুনেশনের বাসভূমি  আজকের ভারতবর্ষের অবস্থা একটা বিবদমান যৌথ পরিবারের মত৷ এরা সকলে মিলেমিশে যদি একটা নেশন গড়ে তুলতে নাও পারে, সেক্ষেত্রে একটা যৌথ আদর্শের ভিত্তিতে  একটি দৃঢ়নিবদ্ধ নেশনগোষ্ঠী a compact multinational unit) গড়ে তুলে পরস্পর মিত্রতা-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যৌথ পরিবারের মত মিলেমিশে বাস করতে পারে৷ মনে রাখতে হবে মাথা গুনতি বোটের জোরে সবসময় কাজ করতে গেলে যৌথ পরিবারের একতা রক্ষিত হবে না--- সেক্ষেত্রে যারা হেরে যাবে তারা যৌথ পরিবারের বাইরে চলে যাবে অর্র্থৎ যৌথ পরিবারের মৃত্যু ঘটবে৷

যৌথ পরিবার বেঁচে থাকে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের এখানে ভারতের প্রতিটি নেশনের  সদিচ্ছার ওপরে৷ অত্যন্ত  দুঃখের হচ্ছে এই যে বর্তমান ভারতে  এই সদিচ্ছার অভাব দেখছি৷ বড় বড় নেতারাও দেশের সামগ্রিক স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে নিজের নিজের নেশনের (কোথাও ভাষাভিত্তিক,কোথাও প্রদেশভিত্তিক ,কোথাও সম্প্রদায়ভিত্তিক,কোথাও জাতপাতকেন্দ্রিক) স্বার্থই দেখেছেন৷ আজ তাঁরা কেউই ভারতীয় নন--- সবাই নিজের নিজের নেশনের নেতা, অন্যান্যদের স্বার্থ তাঁদের হাতে নিরাপদ নয়৷

শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইংরেজী থাকা উচিত৷ প্রশ্ণপত্রও ইংরাজীতে হওয়া উচিত তবে উত্তরপত্র ইংরেজী অথবা ছাত্রদের সুবিধামত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ভাষাগুলিতে লিখবার অধিকার থাকা উচিত৷ এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যত অধিকসংখ্যক ভাষাকে স্বীকৃতি দেয়, দেশ ও ছাত্রের পক্ষে ততই মঙ্গল৷ সুকল-ফাইন্যাল পরীক্ষাতেও ইংরেজী সহ  কয়েকটি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ভাষাতে উত্তর লিখবার অধিকার থাকা উচিত৷ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজী ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ভাষাগুলির সমান  ব্যবহার থাকা দরকার ও প্রশ্ণপত্র অনুরূপভাবে হওয়া দরকার৷ পঠন-পাঠনের মাধ্যম হিসেবে কেবলমাত্র ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করলে সুকলের ছাত্রদের অসুবিধে হতে পারে৷ তবে পঠন-পাঠনের ও প্রশ্ণপত্রে  ইংরেজী একটি স্বীকৃত ভাষা হিসেবে অবশ্যই থাকা দরকার৷ অন্যথায় দূরবর্ত্তী প্রদেশ থেকে আসা ছাত্রদের(যেখানে কারোর মাতৃভাষা স্বীকৃত ভাষার তালিকাভুক্ত নয়) শিক্ষালাভ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে৷

কিন্তু এগুলো তো গেল বিরোধ রোধ করবার প্রচেষ্টা৷ এতে তো আর নেশন বা নেশনগোষ্ঠী গড়া যাবে না ৷ নেশন বা নেশন গোষ্ঠী গড়তে গেলে বর্তমান ভারতকে আর কী কী করতে হবে?

ভারতের অধিকাংশ অধিবাসী দরিদ্র৷ তারা পঁুজিবাদের শোষণ থেকে অব্যাহতি পেতে চায়৷ তাদের কাছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা কোন মূল্য বহন করে না যদি না তা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আনতে পারে৷ আমি ভারতের অনেক দুঃস্থ চাষীবাসী লোকেদের বলতে শুনেছি, ‘‘বাবু, ইংরেজের বোট-বাক্সে বোট দেওয়া যায় না? আমরা তাই দেব৷ তাদের রাজত্ব ভাল ছিল৷’’ কথাগুলো বর্তমান নেতাদের পক্ষে নিশ্চয় গৌরবজনক নয়৷ ভারতবাসীদের নিয়ে মজবুত একটি নেশন বা নেশন গোষ্ঠী গড়তে গেলে পঁুজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমেই তা’ গড়তে হবে৷ মুখে সমাজবাদ বা সমাজবাদী ধাঁচ socialistic pattern) বা কল্যাণ রাষ্ট্রের welfare state) নামে বড় বড় বুলি কপচিয়ে গেলে  কোন কাজ হবে না৷ এই ধরণের শ্লোগনের ফলে জনসাধারণের মনে কোন সেন্টিমেন্ট তৈরী হচ্ছে না৷ আর মজবুত সেন্টিমেন্ট তৈরী না হওয়া পর্যন্ত  নেশন বা নেশন গোষ্ঠী গড়ে উঠতে পারে না৷ জনসাধারণের মনের মধ্যে কোন সেন্টিমেন্ট না থাকার দরুণ  সরকারের জনকল্যাণমূলক প্রচেষ্টাগুলোতে জনসাধারণের তরফ থেকে কোন সাড়া বা সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না৷  ভারতবর্ষে সেন্টিমেন্ট তৈরীর পক্ষে ছোটো-বড় অনেকগুলি সুযোগ এসেছে, আজও রয়েছে৷

কিন্তু সে সেন্টিমেন্টগুলোর কোনটিই প্রশংসনীয় নয়৷ পাকিস্তান বিরোধী বা পর্তুগীজ বিরোধী বা চীন-বিরোধী সেন্টিমেন্টের সাহায্যে সাময়িক ভাবে ভারতীয়  নেশন বা নেশন গোষ্ঠী গড়ে তোলা গেলেও সে সেন্টিমেন্টের জের দীর্ঘকাল ধরে চলবে না৷  তাছাড়া ওই সেন্টিমেন্টগুলোর ফলে আন্তর্র্জতিক ক্ষেত্রে বিদ্বেষ ছড়ানো হবে ও তার ফলে বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে৷ বিশ্ব-বন্ধুত্বের প্রতিষ্ঠা যারা চান তাঁরা এসব প্রস্তাবে সম্মত হবেন না৷ যদি ভারতবর্ষে দরিদ্র জনগণের মধ্যে পুঁজিবাদ বিরোধী--- আরো মনস্তত্ত্বসম্মত ভাষায় বলতে গেলে সকল রকম শোষণ বিরোধী সেন্টিমেন্ট anti exploitation sentiment) তৈরী করা হয়, তাতে ভারত বর্ষে একটা মজবুত  নেশন বা নেশন গোষ্ঠীই গড়ে উঠবে না, বরং  নেশন বা নেশন গোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে বেশ মজবুত ও ঐক্যবদ্ধ অবস্থাতেই থাকবে৷  নেতৃবৃন্দের তাই আজ অতীতের ভূল-ভ্রান্তিগুলো শুধরে নিয়ে নতুন ভাবে শোষণ-বিরোধী অভিযান শুরু করতে হবে৷ ভারতবর্ষকে বাঁচাবার আর কোন দ্বিতীয় বিকল্প নেই৷    (ক্রমশঃ)