দগ্ধৰীজ

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

‘‘যাবন্নক্ষীয়তে কর্ম শুভঞ্চাশুভমেবচ,

তাবন্নজায়তে মোক্ষো ণৃণাং কল্পশতৈরপি৷

যথা লৌহময়ৈঃ পাশৈঃ পাশৈঃ স্বর্ণময়ৈরপি,

তথা ৰদ্ধো ভবেজ্জীবো কর্মাভিশ্চ শুভাশুভৈঃ৷৷’’

(তন্ত্র)

সোণার বেড়ি দিয়ে কাউকে ক্ষাঁধলে তাতে কি তার কষ্ট লাঘব হয়? –না, কেননা ৰন্ধন সোণার হোক বা লোহারই হোক তা তো ৰন্ধন–ই৷ সৎ কর্মের স্বর্ণৰন্ধন আর অসৎকর্মের লৌহৰন্ধন, যেটাই হোক তা তো ভাঙ্গতে হবে৷ নিজেকে অসৎকর্ম থেকে বিরত রাখতে হবে যাতে লোহার শৃঙ্খল চেপে না বসে৷ আর সৎ কর্ম তো করতেই হবে, কিন্তু সেই সঙ্গে তজ্জনিত সোণার শৃঙ্খল পরমাত্মার পায়ে সমর্পণও করে দিতে হবে এই বলে–‘‘হে প্রভু, সৎ কাজের সুফলও আমি ভোগ করতে চাই না৷ আমি তা’ তোমাকেই সমর্পণ করছি৷’’

যতক্ষণ পর্যন্ত শরীর আছে, কোন–না–কোন কর্ম করতেই হবে৷ এছাড়া কেউ থাকতে পারে না৷ শ্বাস–প্রশ্বাস সেটাও একটা কর্ম৷ আমি অন্যত্র বলেছি যে কেউ যদি কোন কাজ না করে খালি ঘুমোতে চায় তাহলে সেটাও একটা কর্ম৷ কাজ তো করতেই হবে–দেখতে হবে তা যেন অসৎ কর্ম না হয়, অবশ্যই তা হবে সৎ কর্ম, আর সেটাও তাঁকে সমর্পণ করে দিতে হবে৷ কোটি কোটি বার জন্ম নিলেও কর্মের প্রতিকর্ম ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না৷ যতক্ষণ সেই প্রতিকর্মের ভোগ না হচ্ছে, ততক্ষণ তার হাত থেকে নিস্তার নেই৷ এখন কর্মের প্রতিকর্ম কীভাবে নিঃশেষিত হবে? ‘‘কর্মভোগেন ক্ষীয়তে’’– অর্থাৎ কর্মফল ভোগের মাধ্যমেই তার ক্ষয় হবে৷ ‘‘অবশ্যমেব ভোক্তব্যম্ কৃতম্কর্ম শুভাশুভম্’’–শুভ অশুভ যে কর্মই হোক, কৃত কর্মের ফলভোগ করতেই হবে৷ তাই কর্ম করার সময়ই সতর্ক থাকতে হবে৷ কেননা পরে অনুশোচনা করেও কোন লাভ হবে না৷

এখন প্রশ্ণ হ’ল প্রতিকর্ম কেমন ধারা হবে? মূল কর্মের মতোই, না তার কম, বা তার বেশী? নিয়ম হচ্ছে তা হওয়া উচিত সমান ও বিপরীত৷ কিন্তু সেক্ষেত্রে দেখতে হবে যে প্রতিকর্মের ফলভোগ কেবল মনের সঙ্গে সম্বন্ধিত না তা শারীর–মানসিক৷ যদি মূলকর্ম হয় মানসিক তা হলে প্রতিকর্ম ঠিক তার সমান হবে৷ কিন্তু তা যদি হয় শারীর–মানসিক, তাহলে প্রতিকর্ম কি ধরনের হবে? এর মধ্যেও একটা ব্যাপার আছে৷ কোন শারীর–মানসিক কর্মের দ্বারা মন যদি প্রভাবিত না হয়ে থেকে থাকে তাহলে কিছুই হবে না৷ যদি কেউ নিজেকে নয়, পরমপুরুষকেই কর্মের অধিকারী বলে ভাবে তাহলে তার মন প্রতিকর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয় না৷ সাধারণভাবে প্রতিকর্ম শারীর–মানসিক হলে তার প্রভাব মূলকর্ম থেকে অনেক বেশী হবে৷

বিশুদ্ধ মানসিক কর্মের ক্ষেত্রে প্রতিকর্ম হবে সমান মাত্রার৷ কিন্তু শারীর–মানসিক কর্মের প্রতিকর্ম মনকে সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত করবে না৷ যদি এমন হয় যে, কোন শারীর–মানসিক প্রতিকর্ম কিছুটা শরীরকেও প্রভাবিত করবে তাহলে মূলকর্মের চেয়েও প্রতিকর্মের মাত্রা অনেক ক্ষেড়ে যাবে৷ মানসিক কর্মের ব্যাপারে মন সেই কর্ম অনুসারেই প্রভাবিত হবে৷ কিন্তু শারীর–মানসিক কর্মের ক্ষেত্রে তার প্রতিকর্ম কিছুটা মন ভোগ করবে, কিন্তু মনকে প্রভাবিত করবে না৷ যা মনকে প্রভাবিত করছে তা মানসিক প্রতিকর্ম–সঞ্জাত আর যা তা করছে না তা শরীরগত৷ এই বিশুদ্ধ  শরীরগত প্রতিকর্মের অংশটুকু আবার মনকে প্রভাবিত করবে না৷ তাই শারীর–মানসিক প্রতিকর্মের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ মানসিক ফলভোগ, তৎসহ শারীরিক ফল ভোগ–এই দু’য়ে মিলে প্রতিকর্মের ফল ভোগ যায় ক্ষেড়ে৷ এইভাবে প্রতিকর্মের বোঝা হয়ে যায় বেশী ভারী৷ সেজন্যে এ ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে৷

আধ্যাত্মিক অনুশীলনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরের সাধক আছে৷ কেউ বলে–‘‘হে পরমাত্মা, কৃপা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার সংস্কার ক্ষয় করিয়ে দাও৷ আমার সংস্কার যা আছে তা আমাকেই দাও৷’’ কিন্তু কেউ কেউ বলবে–‘‘আমি নিজের সংস্কার ভোগ করার সঙ্গে সঙ্গে অন্যের সংস্কারও ভোগ করতে প্রস্তুত আছি৷’’ এইভাবে অনেক রকমের ভাবনা থাকে৷ কেউ অন্যের সংস্কারের ভার নিজে নিতে চায় এইজন্যে যাতে অন্যকে  কষ্ট ভোগ করতে না হয়৷ যে স্তরে যে সাধক আছে তাদের ভাবনাও সেই অনুযায়ীই হয়ে যায়৷ সাধনা করতে করতে সাধক একটা স্তরে পৌঁছে যায় যখন পরমাত্মার জন্যে তার পূর্ণ ভক্তি জাগ্রত হয়ে যায়৷ তখন দুঃখ–দুর্দশার প্রবল তুফানও তাকে বিচলিত করতে পারে না৷ সেই সাধক অবশ্যই নিজের মনে চরমভাবে কষ্ট ভোগ করছে৷ কিন্তু সেটা পরমপুরুষেরই কৃপা মনে করে কষ্টকে তোয়াক্কা পর্যন্ত করে না৷ যন্ত্রণা–ভোগের মধ্যেই সে ঐশ্বরীয় আনন্দের আস্বাদ পায়৷ সেই স্তরের সাধককেই বলা হয় দগ্ধৰীজ৷ একজন দগ্ধৰীজ সাধক প্রত্যক্ষভাবে তার মানসিক অধিক্ষেত্রের মধ্যেই থাকে৷ তার কষ্টভোগ প্রত্যক্ষভাবে মানসিক স্তরেই চলতে থাকে৷

এখানে ৰীজ মানে যেমন গাছের ৰীজ হয়৷ যখন কোন ৰীজ বপন করা হয় তখন তা থেকে গাছ বের হয়৷ কিন্তু ৰীজ যদি দগ্ধ হয়ে যায় তাহলে তা থেকে গাছ তৈরী হবে না৷ কোন সাধক তখনই দগ্ধৰীজ স্তরে উপনীত হয় যখন তার আর নিজের কোন সুখ–দুঃখের ভাবনা থাকে না৷ যে নিজের হাতে এক পয়সাও না রেখে পুরোপুরি ষোল আনাই পরমপুরুষের কাছে সমর্পণ করে দিয়েছে, সে–ই দগ্ধৰীজ৷ সকলেই নিজের নিজের সংস্কার ভোগ করে৷ কিন্তু দগ্ধৰীজ সাধক তার ইচ্ছামত অন্যের সংস্কারের বোঝাও বহন করে৷ আর যারা তা করে তারা প্রকারান্তরে পরমপুরুষের ভারকেই তো লাঘব করে৷ এটা তোমাদের মনে রাখা উচিত৷

নিজের ব্যষ্টিগত সমস্যা–সংক্রান্ত দুর্ভাবনা নিয়েই পড়ে থেকো না৷ নিজের তো বটেই, অন্যের বোঝাও বইবার জন্যে তৈরী থাকো৷ তবেই না তুমি একজন সত্যিকারের সাহসী মানুষ বলে গণ্য হবে৷ দগ্ধৰীজ হও৷ প্রত্যেকেরই নিজের নিজের ব্যষ্টিগত সমস্যা আছে৷ নিজের দুঃখদুর্দশার ভোগ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কোরো না৷ বরং অন্যের বোঝা বহন করে চলো৷ কেউ তোমার শত্রু নয়৷ আপনজন ভেবে অন্যের বোঝা বহন করতে প্রস্তুত থাকো৷