ডগ্‌মা বনাম বিশ্বমানবতা

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

সম্প্রতি কশ্মীরের পুলওয়ামায় মুসলীম জঙ্গীরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর  কনভয়ের ওপর হামলা চালিয়ে ৪৯ জন জওয়ানকে হত্যা করল৷ সংবাদে  প্রকাশ  গত ৫ বছরে জঙ্গীদের আক্রমণে একমাত্র কশ্মীরেই ৪৬০জন জওয়ান ও ২৮০জন নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে৷ শুধু কশ্মীরে নয় দেশের বিভিন্ন স্থানে  বিভিন্ন  সময়ে এই মুসলীম জঙ্গীরা  হামলা চালিয়ে  সারা দেশ জুড়ে সন্ত্রাসের  আবহ সৃষ্টি করেছে৷ শুধু ভারতেই  বা বলি কেন সারা পৃথিবীতেই মুসলীম জঙ্গীরা  যত্রতত্র হামলা চালিয়ে  সারা পৃথিবী জুড়েই সন্ত্রাসের  আবহ সৃষ্টি করেছে৷ এই জঙ্গীগোষ্ঠীরা তরুণ যুবাদের  মগজ ধোলাই করে’ তাদের শেখাচ্ছে, অমুসলীমরা  সবাই কাফের৷ তাদের হত্যা করলে ‘আল্লা’ সন্তুষ্ট হবেন৷ যে জঙ্গীরা  কাফেরদের হত্যা করবে তারা আল্লার কৃপায় বেহস্তে (স্বর্গে) বহু হুরী (স্বর্গের পরী) পরিবৃত হয়ে  মহাসুখে  থাকতে পারবে৷ সেই স্বর্গ-সুখের লালসায় মুসলীম তরুণরা দলে দলে আত্মঘাতী জঙ্গী গোষ্ঠীতে  নাম লেখায়৷

বিশ্বের সবাই তো ঈশ্বর বা আল্লার সৃষ্টি৷ অর্থাৎ সবাই তাঁর সন্তান৷ পিতা নিশ্চয় চাইবেন, তাঁর সমস্ত  সন্তানরা মিলে  মিশে থাকুক, একে অপরকে ভালবাসুক৷ ‘কাফের-হত্যা করে’ আল্লার সন্তুষ্টি বিধান’--- জঙ্গী মুসলীমদের এই শিক্ষা কোনো প্রকারের যুক্তিযুক্ত হতে পারে না৷ হিংস্রতা মানুষের  ধর্মের অন্তর্গত হতে পারে না, মানব সমাজের পক্ষে এটা অত্যন্ত ক্ষতিকারক৷ কোনো যুক্তিবাদী মানুষই এইমত  মেনে নিতে পারে না৷

ধর্মমতের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোনোপ্রকার  ঘৃণা হিংসা-দ্বেষকেই মেনে নেওয়া যায় না৷  ওই সমস্ত ধর্মের  অনুসারীদেরও কোনোভাবেই এই সমস্ত অযৌক্তিক  উদ্ভট  ডগমার সঙ্গে  একমত হওয়া উচিত নয়৷ মানব  সমাজের ভিতকে  সুদৃঢ় করার এটা হ’ল প্রাথমিক ধাপ৷

সম্পূর্ণ যুক্তি বিবর্জিত এই ধরণের  বিশ্বাসই হ’ল ডগ্‌মা অর্থাৎ ভাবজড়তা৷ মনের যথার্থ ধর্মই হ’ল যুক্তি  বিচারের পথ ধরে এগিয়ে চল৷ এই অগ্রগতি ব্যাহত হলে মানুষ জড়ত্বে পর্যবসিত হবে৷  কবি বলেছেন,‘‘যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে / সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে৷’’

সমাজরূপ নদী সে অবস্থায়  তার গতি  হারিয়ে  ফেলে, বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হবে৷ আর তা অজস্র  রোগের  ডিপো হয়ে উঠবে৷ তা মরণফাঁদ হয়ে উঠবে৷ যেকোনো যুক্তিবাদী  মানুষকে এটা বুঝতে হবে, অন্যকে বোঝাতে হবে৷

বর্তমানে এমনি বিভিন্ন ধরণের অযৌক্তির ডগ্‌মা নিয়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধর্মমত৷ ধর্মমত বলতে আমি বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক ধর্মমতের কথাই বলছি৷ মানবধর্মের  কথা বলছি না৷ মানব ধর্ম যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক --- সমস্ত মানুষের তা এক ও অভিন্ন৷ সেখানে মানুষের মধ্যে কোনো ভেদ নেই৷ ঈশ্বর  এক অনাদি অনন্ত চৈতন্যসত্তা৷ এই মানবধর্ম প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মানবের মিলনসূত্র --- যা বিশ্বের সমস্ত মানবগোষ্ঠীকে এক সূত্রে গাঁথবার  কথা বলে৷ আর সে সূত্র  হ’ল প্রেমের সূত্র, সবাইকে  আপন ভাবাবার ‘একাত্মতা সূত্র’৷ কারণ সবাই তো  এক পরমপিতার  সন্তান৷ বিশ্বভ্রাতৃত্বই এর আদর্শ৷ 

এর আর এক নাম নব্যমানবতাবাদ, আর ভিত্তি হল, অন্তর্জগতে এক চৈতন্যময় পরমপুরুষের সঙ্গে নিজের  মনকে মিলিয়ে দেওয়ার  আন্তরিক প্রয়াস, আর বহির্জগতে সমস্ত মানুষ, পশু-পাখী-তরুলতা সবাইকে সেই এক পরমচৈতন্যের প্রকাশ রূপে ভেবে সবাইকে ভালবাসা, সবার সেবায় আত্মনিয়োগ করা৷ এটাই মানবধর্মের সারকথা৷

তাই আজকের সাম্প্রদায়িকতার  বিষে জর্জরিত মানব সমাজকে  বাঁচাতে হলে প্রতিটি মানুষের  উচিত, সমস্ত প্রকার ডগমাকে বর্জন করে,সেই এক উদার মানবধর্মের  নির্মল আলোকে সবকিছুকে  দেখা, সেই  শক্ত ভিতের ওপর  মানবসমাজকে দাঁড় করানো৷ এরই মধ্যে রয়েছে সমস্ত প্রকার সামাজিক, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক, সাংসৃকতিক ও ধর্মীয় সমস্যার  সুষ্ঠু সমাধান৷ একমাত্র এই পথেই আসবে  বিশ্বশান্তি৷ আজকে সমস্ত  প্রকার সংকীর্ণ বিশ্বাস বা ধর্মমতের ঊধের্ব উঠে মানুষকে  বিশ্বমানব হয়ে উঠতে হবে৷ এছাড়া মানবসমাজের বাঁচবার আর অন্য কোনো পথ নেই৷