ধনসঞ্চয় সম্পর্কে প্রাউটের নীতি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

কোন ব্যষ্টিই সামবায়িক সংস্থার (collective body) সুস্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে না৷

 

আমাদের চাহিদা তিন ধরনের–

  • ভৌতিক (physical)
  • মানসিক (psychic)
  • আধ্যাত্মিক (spiritual)

অণুমন তার অনন্ত ক্ষুধা ভৌতিক উপাদান লাভের মাধ্যমেই তৃপ্ত করতে চায়, কিন্তু এই ভৌতিক সম্পদ যদিও বিপুল, তবুও অনন্ত নয়– সীমিত৷ ভৌতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক এই তিন স্তরের মধ্যে মানসিক ও আধ্যাত্মিক জগৎ অনন্ত৷ এই দুই স্তরে অণুমনের অনন্ত এষণার পরিতৃপ্তি হতে পারে৷ এতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দেবে না৷

সামাজিক–অর্থনৈতিক সংরচনায় মানুষ মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্তরে পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে৷ মানসিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদ অনন্ত৷ তাই এই সম্পদ কোন মানুষ যতই আহরণ করুক না কেন, তাতে কারুর ঘাটতি পড়বে না৷ কিন্তু জাগতিক সম্পদ সীমিত৷ এক্ষেত্রে একজন অতিরিক্ত সঞ্চয় করলে সমাজের অধিকাংশ মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণে ঘাটতি দেখা দেবে৷ এতে বৃহত্তর–জনগণের আধ্যাত্মিক, মানসিক ও ভৌতিক অগ্রগতি রুদ্ধ হতে বাধ্য৷ সুতরাং ভৌতিক স্তরে ব্যষ্টি স্বাধীনতার সমস্যাকে সমাধান করতে গেলে, একে অবশ্যই একটা ঊর্ধ্বসীমার বাইরে যেতে দেওয়া হবে না৷ আবার একে কঠোর ভাবে খর্ব করাও উচিত নয়–কেননা তা করলে মানুষের আধ্যাত্মিক, মানসিক ও ভৌতিক স্তরের বিকাশ সম্ভব হবে না৷

অর্থোপার্জন নিশ্চয়ই করতে পার, কিন্তু সে উপার্জন যেন ততটুকুই হয়–তোমার পরিবার প্রতিপালনের জন্যে, বা তাদের দুর্দিনের সংস্থানের জন্যে যতটুকু প্রয়োজন, তার চাইতে একপয়সাও বেশী নয়৷ সর্বদাই মনে রাখতে হবে অর্থের মূল্য ব্যবহারে৷ তোমার ঘরে তোমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ সঞ্চিত হলে ব্যবহার না থাকায় তা মূল্যহীন হয়ে যায়৷ যতটা অর্থকে তুমি মূল্যহীন করে’ ফেলছ একজন বুভুক্ষু–বিবস্ত্র মানুষের প্রতি তুমি সেই পরিমাণ অবিচারও করে’ ফেলছ৷ তোমার মূল্যহীন টাকাগুলো অন্যকে ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে সেগুলোকে মূল্যবান করে’ নিতে হবে৷

মানুষের মনে যে অনন্ত ক্ষুধা আছে সেই ক্ষুধা মানসিক বা আধ্যাত্মিক সম্পদে নিবৃত্ত হবার ঠিক পন্থা না পেলে, জড়জগতে প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ আহরণ করে’ অন্যকে বঞ্চিত করবার কাজে লেগে যায়৷ অন্যকে শোষণ করে’ ধনী হবার ইচ্ছা এক ধরণের মানসিক ব্যাধি৷

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মানুষ যেখানে অপরিগ্রহ (জীবন ধারণের জন্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জাগতিক ভোগ্য দ্রব্য গ্রহণে অনীহা) নীতিকে লঙঘন করছে, শোষণের সূত্রপাত সেখানেই৷

সীমিত জাগতিক সম্পদ থেকে যখন অন্তহীন মানসিক–আভোগ সন্তুষ্টি পেতে চায় তখনই শোষণ শুরু হয়৷ ফলে মুষ্টিমেয় মানুষ হয়ে ওঠে পুঁজিবাদী, বাঁকীরা শোষিত দরিদ্রে পরিণত হয়৷

পরিবারের যে সদস্য অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে একাত্মভাব রাখে না, যৌথ অধিকারের মহৎ আদর্শ তথা যুক্তিগ্রাহ্য তথ্যটুকুকে স্বীকার করতে চায় না, তাকে সামাজিক জীব বলে’ স্বীকার করা চলে না৷ প্রকৃত আধ্যাত্মিক আদর্শ অনুযায়ী ব্যষ্টিগত মালিকানা–ব্যবস্থাকে চরম ও পরম বলে’ স্বীকার করা চলে না, আর তাই পুঁজিবাদকেও সমর্থন করা যায় না৷

ভোগ্যপণ্যের অন্তর্নিহিত সুপ্ত শক্তিই পুঁজি৷ বুদ্ধিমান লোকেরা ভোগ্যপণ্যরূপে অন্যদের থেকে বেশী পুঁজি সংগ্রহ করে, কিন্তু যেহেতু ভোগ্যপণ্য বেশী দিন ধরে’ জমিয়ে রাখা যায় না, সেইজন্যে তারা পুঁজি হিসেবে জমাতে থাকে অর্থ৷ এদেরই বলে পুঁজিবাদী৷ এই পুঁজিবাদীরা ‘ভূমা–উত্তরাধিকার’ তত্ত্বের বিরোধী৷ পুঁজিবাদের বিরোধিতা করা তাই অন্যতম লক্ষ্য৷

বর্ত্তমান বিশ্বের পুঁজিবাদীরা নিজের ঘরে প্রাচুর্য্যের মাত্রাধিক্য ঘটাতে গিয়ে অন্যকে ক্ষুধার জ্বালায় শুকিয়ে মারে, নিজের পোষাকের জৌলুস দেখাতে গিয়ে অন্যকে ছিন্ন কন্থা ব্যবহার করতে বাধ্য করে, নিজের প্রাণ শক্তিকে বাড়াতে গিয়ে অন্যের প্রাণরস শোষণ করে৷ জীবের সামুহিক স্বার্থের কথা ভাবতে গেলে তাই পুঁজিবাদের উচ্ছেদ প্রয়োজন৷

এই পৃথিবীর ভোগ্যবস্তুর পরিমাণ সীমিত, অথচ প্রয়োজন সকলকারই৷ একজনের প্রাচুর্যের ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্যের গ্রাসাচ্ছাদনে টান পড়ে৷ এই অন্যের প্রয়োাজনের কথা বুঝতে না পারাটাই ব্যাধি৷ এই ব্যাধিতে যারা ভুগছে তারও বৃহৎ মানব–পরিবারেরই সদস্য–তারাও ভাই৷ মানবিক আবেদনে অথবা অবস্থার চাপ সৃষ্টি করে’ তাদের ব্যাধি সারাবার ব্যবস্থাই করতে হবে, তাদের ধ্বংস করবার চিন্তাও মহাপাপ৷

মানবিক আবেদনে বা সত্যাগ্রহে মানুষের মনের যে অংশটি খুবই কোমল, যে অংশটি একটুতেই দুলে ওঠে, সেটুকুকেই ছোঁয়ার চেষ্টা করা হয়৷ তাই যারা বিচারশীল, যাদের মনে বেশ কিছুটা কোমলতা আছে, সত্যাগ্রহে বা মানবিক আবেদনে তারাই সাড়া দেয়৷ জড়বুদ্ধির কাছে এই জাতীয় আবেদন খুব বেশী মূল্য বহন করে না৷ তাদের মনকে দোলা দেবার জন্যে, কঠোরতম আঘাত হানবার প্রয়োজন আছে, ও চিরদিন থাকবে অন্যথায় কেবল সাত্ত্বিক আবেদনের ফলে কবে কোন্ কঠোর মনের গোপন কোণে কোমল বীণাতন্ত্রী বেজে উঠবে তার অপেক্ষায় অনন্তকাল ধরে’ বসে থাকতে হয়৷ যে নিপীড়িত হতভাগ্যদের দুঃখমোচনের জন্যে এই আবেদন, তাদের অস্থিপঞ্জর ততদিনে গুঁড়িয়ে ধূলো হয়ে যাবে৷ তাই গান্ধীবাদ বা ভূ–দান আন্দোলন মানুষের সহৃদয়তার যতখানি মূল্যই দিক না কেন, বা এর প্রবক্তারা যতই ঋষিকল্প হোন না কেন, এ নীতি ক্ষুদ্র–স্বার্থপ্রলুব্ধ্ মানুষ সাধারণভাবে কখনই গ্রহণ করবে না৷ পদযাত্রীর পায়ের ক্ষত তাদের কঠোর মনকে নাড়া দিতে পারবে না৷ গান্ধীবাদ কল্পনার স্বর্গে সুন্দর–কিন্তু বাস্তবের পৃথিবীতে উদ্ভট আত্মম্ভরিতা মাত্র৷

পুঁজিবাদীরা দুর্নীতিগ্রস্ত ও ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত৷ যেহেতু তাদের আভ্যন্তরীণ আকুতি খুবই নগণ্য ও নিস্ক্রিয়, সেহেতু তাদের স্বভাব সংশোধনের উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে শক্তি সম্প্রয়োগ করতেই হবে৷ সুন্দর সুন্দর বাক্য বিন্যাস করে’ উপদেশ দিলে কাজ হবে না৷

শক্তি–সম্প্রয়োগে ব্যষ্টি বা সমষ্টি–মনের যে বিষবৃক্ষকে ধ্বংস করা হয়েছিল, তার বীজ মানুষের মনে থেকেই যায়৷ অবস্থার চাপ কিছুটা শিথিল হলেই তা অঙ্কুরিত হয়ে ওঠে৷ কারণ অবদমিত বৃত্তিকে ফুটিয়ে তোলাই মানুষের স্বভাব ধর্ম, আর এই বৃত্তি–স্ফূরণ যদি রোধ করতে হয় তবে স্বভাবটাতেই পরিবর্তন আনতে হবে৷ জিনিসটা একটা মূল নীতি ঘটিত ব্যাপার৷ এ সম্বন্ধে কোনও স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা একেবারেই অর্থহীন৷

যারা মানুষের হৃদয়বত্তার ওপরেই ষোলআনা নির্ভর করে’ মানবিক আবেদনকেই একমাত্র পুঁজি বলে’ গ্রহণ করেছে  তারা ব্যর্থ হবে যারা হৃদয় বৃত্তির পরিবর্ত্তনের জন্যে কোনপ্রকার ব্যবস্থা না নিয়ে, বা স্বভাব সংশোধনের জন্যে কোন  নীতিগত বা আদর্শগত পন্থা অবলম্বন না করে’ কেবলমাত্র আইনের চাপে বা সঙ্গীন উঁচিয়ে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারাও ব্যর্থ হবে৷ গান্ধীবাদ আর জড়শক্তি–কেন্দ্রীক তথাকথিত সাম্যবাদ–এ দুটোর কোনটাই মানুষের কল্যাণ করতে পারবে না৷

মানুষকে বেছে নিতে হবে এমন একটা পন্থা যেখানে কোন অবস্থাতেই মানবতাবোধের বা মানবিক আবেদনের অভাব থাকবে না, অধিকন্তু প্রয়োজনবোধে জড়শক্তি, তথা অন্য যে কোন প্রকার শক্তি–সম্প্রয়োগের ব্যবস্থা থাকবে৷ জড়–ভোগ্য জগতের সম্পদ একজনের কাছে যাতে বেশী না জমে তার জন্যে প্রয়োজন ক্ষেত্রে কিছুটা শক্তি সম্প্রোয়গ করতে হবে বৈকি–কিন্তু এও তো জানি যে, শক্তি–সম্প্রয়োগে সে তার সঞ্চিত সম্পদ থেকে কিছুটা বঞ্চিত  হবে বটে, বা ভবিষ্যতের সঞ্চয়ের সুযোগও তার কমে যাবে বটে, কিন্তু জড় ভোগ্যবস্তু পাবার জন্যে যে মনের ক্ষুধা (আসলে জড় বা মানস–দুই প্রকার ভোগই মানস–ক্ষুধা থেকে উদ্ভূত–স্থূল ক্ষুধা তার চাইতে অনেক কমেই মিটে যায় এখানে স্থূল ক্ষুধাকে অর্থাৎ crude mind এর প্রয়োজনকে বিশুষ্ক্–মানস–ক্ষুধা বলতে আমার আপত্তি আছে) সেটাকে উপযুক্ত শিক্ষার দ্বারা ভিন্ন খাদে বইয়ে মানস–ভোগের ক্ষুধায় পরিবর্ত্তিত করা নিশ্চয়ই কোন অসম্ভব কাজ নয়৷ মানুষ সমাজে এই রকম শিক্ষারই প্রয়োজন আজ সব চাইতে বেশী৷