ধর্ম ও রেলিজন এক নয়

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষই আজ বিভিন্ন সামাজিক ব্যাধীর মূল কারণ৷ আর এর পেছনে রয়েছে মানুষের অন্ধবিশ্বাস, ডগ্মা বা যুক্তিহীন ভাবজড়তা৷

সারা বিশ্বজুড়ে আজ যে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিপনা–সাম্প্রদায়িক হানাহানি চলছে–এসবেরই পেছনে আছে এই ডগ্মা৷ ধর্মমতের নামে এই ধরনের অজস্র ডগ্মা মানবসমাজকে অজস্র অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও অমানবিক কাজকর্মের দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ ধর্মমতের নামে বিভিন্ন জাত–পাত সম্প্রদায়গত বিভেদ–বিদ্বেষ–ঘৃণা, হানাহানি আজ বৃহত্তর মানবসমাজের ক্ষেত্রে একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে৷ আর সবচেয়ে যেটা বড় কথা, দেশের বা বিশ্বের বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবী মানুষ ‘ধর্ম’ আর এই ধরণের ‘রেলিজিয়াস ডগ্মা’ বা ধর্মমতের গোঁড়ামী এই দুটোকে এক করে ফেলেছেন৷ ধর্ম ও রেলিজন (ধর্মমত বা উপধর্ম) যে এক নয় এই সত্যটাই তাঁরা বোঝেন না৷ তাই তাঁরা ধর্মের নাম শুনলেই নাসিকা কুঞ্চন করেন৷ আজ প্রকৃত ধর্ম ও ধর্মমত (ধর্মমত বা রেলিজন বলতে এখানে বোঝাচ্ছি–বিশেষ ধরণের মতবাদ বা বিশ্বাসকে যা প্রকৃত ধর্ম নয়, কিন্তু এগুলিকেই লোকে ভুল করে ‘ধর্ম’ বলে মনে করে) –এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যটা  বুঝতে হবে৷ এটা ঠিকভাবে বুঝলে সমাজের অধিকাংশ সমস্যারই সমাধানের পথ খুলে যাবে৷

‘ধর্ম’ কথাটি এসেছে সংস্কৃতে ‘ধৃ’ ধাতুর উত্তর ‘মন্’ প্রত্যয় যোগ করে৷ এর অর্থ দাঁড়ায় সত্তাগত বৈশিষ্ট্য ব্দন্দ্বপ্তন্দ্র ন্তুড়্ত্রব্জ্ত্রন্তুব্ধন্দ্ –অর্থাৎ যে কোনো সত্তার এমন কিছু মূল বৈশিষ্ট্য থাকে যে বৈশিষ্ট্য ওই সত্তার পরিচিতি বহন করে৷ যেমন, আগুনের ধর্ম ‘জ্বালিয়ে দেওয়া’, চিনির ধর্ম ‘মিষ্টত্ব’৷ ’আগুনের সত্তাগত বৈশিষ্ট্য জ্বালিয়ে দেওয়া, যদি তা না জ্বালায়–তাহলে তা আগুনই নয়৷ চিনির ধর্ম মিষ্টত্ব, যদি দেখা যায় তা মিষ্টি নয়, তাহলে নিশ্চয়ই তা চিনি নয়, হয়তো বা চিনির মত দেখতে অন্য কিছু৷ ঠিক তেমনি, মানুষেরও একটা মূল সত্তাগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাকে অন্যান্য প্রাণী থেকে বা বস্তুজগৎ থেকে পৃথক করে দেয়৷ এখন, কোনো সত্তার বা বস্তুর ধর্ম জানব কী করে? তার আচরণ দেখে, আচরণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে’৷ মানুষের আচরণ পরীক্ষা–নিরীক্ষা বা বিশ্লেষণ করলে আমরা কী পাব? একটা মানুষ দিবারাত্র কিছু না কিছু করে চলেছে৷ কেন? –না, তার মনের মধ্যে একটা অভাববোধ রয়েছে, এই অভাব পূরণের জন্যেই সে অবিরাম কিছু না কিছু করে চলেছে৷ কিসের অভাব? প্রকৃতপক্ষে এই অভাবের শেষ নেই৷ যে নিঃস্ব, রিক্ত তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তোমার কিসের অভাব৷ সে হয়তো বলবে, মোটা–ভাত, মোটা–কাপড়৷ যখন তা পাবে, সে তখন ভাববে, আমার একটা মাথা গুঁজবার ঘরের অভাব৷ মাথা গুঁজবার একটা ঘর হলে, সে বড় বাড়ী চাইবে৷ এমনি করে দেখা যায়, মানুষের মনের অভাব অনন্ত৷ রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘যাহা চাই, তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই, তাহা চাই না’৷ প্রতিটি মানুষের মনে অনন্ত অভাব রয়েছে৷ সে মনের সেই অনন্ত অভাবকে পূর্ণ করার জন্যে ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে’ অবিরাম ছুটে চলেছে৷ মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণী পেট ভরলেই সন্তুষ্ট, আর কিছু চায় না৷ কিন্তু মানুষের অনন্ত  অভাব–তাই অনন্ত আকাঙক্ষা, তাই সীমিত কোনো কিছুতে মানুষ সন্তুষ্ট নয়৷ এই ‘অনন্ত অভাব’ই মানুষের বৈশিষ্ট্য৷

প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা তাই বলেছেন, অসীম অভাব ও অসীমকে পাওয়ার যে প্রয়াস তাই মানুষের ধর্ম৷ আর অসীম কী? কী পেলে মানুষের এই অসীম অভাব মিটবে? এর উত্তর, একমাত্র ‘ব্রহ্ম’ই অসীম, ব্রহ্মকে পেলেই মানুষের অসীম আকঙক্ষা মিটবে৷ অভাব মিটলে মনের যে অনুভূতি তাকে বলা হয় সুখ৷ অসীম অভাব মিটলে মানুষ পাবে ‘অসীম সুখ’, দর্শনে এই ‘অসীম সুখকেই বলা হয় আনন্দ৷ তাই বলা হয়েছে ‘আনন্দং ব্রহ্ম ইত্যাহু’৷ আনন্দই ব্রহ্ম৷ ব্রহ্মলাভ করলে মানুষের মন পরমানন্দে ভরে যায়৷

বলা বাহুল্য, দর্শনের ব্রহ্মই ভক্তের ভগবান৷ ঈশ্বর, আল্লা, ণ্ডত্থড্ড, জিহোবা, রাম, কৃষ্ণ, হরি–সবাই একই ব্রহ্মের নানান্ নাম৷

প্রতিটি মানুষ অসীমকে চায় অর্থাৎ সেই এক পরমসত্তাকে পেতে চায়–তাঁকে পেলেই মানুষ প্রকৃত আনন্দ লাভ করবে৷ এই আনন্দ পেতে চাওয়া প্রতিটি মানুষের বৈশিষ্ট্য৷ তাই প্রাউট–প্রবক্তা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, সকল মানুষের ধর্ম এক৷ মানুষ মানুষ ভাই ভাই৷ প্রাউট–প্রবক্তা তাই এও বলেছেন যে, ধর্ম মানে–সে ব্রহ্মকে (তাঁকে ণ্ডত্থড্ড, আল্লা–যাই বলা হোক না কেন) পরমপিতা হিসেবে মানে, সে মানে সবাই সেই এক পরমপিতার সন্তান৷ তাই তাকে মানতেই হবে, মানুষ মানুষ ভাই ভাই৷ প্রকৃত ধার্মিক জাত–পাত–সম্প্রদায় মানবে না৷ যারা জাত–পাত–সম্প্রদায় মানে তারা প্রকৃত ধর্ম মানে না৷

তাহলে যে প্রকৃত ধার্মিক তার মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থাকবে কেন? তাই জাত–পাত সম্প্রদায় ভাবনা, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার কোনক্রমেই ধর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়৷

বরং, প্রকৃত ধর্ম চেতনাই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করবে৷ এক বিশ্বপিতাকে মানলে তবে বিশ্বভ্রাতৃত্ব সম্ভব৷ ধর্মের এই যথার্থ স্বরূপ মানুষ উপলব্ধি করুক৷ তাহলেই আজ মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, শুভবুদ্ধি, শুভ চিন্তা ও ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’র ভাব আসবে৷ সব সমস্যার সমাধানের মূল চাবিকাঠি আছে এখানে৷ এই সত্য মানুষ যত শীঘ্র বুঝবে ততই সমাজের পক্ষে, বিশ্বের পক্ষে মঙ্গল৷