একমাত্র সমবায়ই সমাধান

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

 সংসদে বাস্তবিক পক্ষে অগণতান্ত্রিকভাবে পাশ হওয়া কৃষি-বিল তিনটিতে রাষ্ট্রপতি কোবিন্দ সই করার পর এগুলি আইনে পরিণত হল৷ এই আইন যে কর্ষকদের স্বার্থসিদ্ধি করবে না, বরং পুঁজিপতি হাঙ্গরদের মুখে  তাদের ঠেলে দেওয়া হ’ল তা এর আগের দিন সম্পাদকীয়তে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি৷ মোদিজী যুক্তি দেখাচ্ছেন, চাষীরা গ্রামের মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারা শোষিত হচ্ছিল, এখন তারা এই শোষণ থেকে মুক্তির রাস্তা পেল৷ আশ্চর্যের ব্যাপার, যে চাষীরা গ্রামীণ ছোট-খাটো মধ্যস্বত্বভোগীদের সঙ্গে তাদের উৎপন্ন ফসলের দরকষাকষিতে পেরে উঠছিলেন না, তারা তাহলে  বড়ো বড়ো কর্র্পেরেট পুঁজিপতি হাঙ্গরদের সঙ্গে পেরে উঠবে কী করে? মোদিজী কি স্ববিরোধী কথা বলছেন না?

আসল কথা হ’ল ভারত কৃষিপ্রধান দেশ৷ মূলতঃ কর্ষকদের  সমর্থনের ওপর ভিত্তি করেই রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতায় আসছেন৷ কিন্তু অশিক্ষিত, সরল সাধারণ কৃষিজীবিদের বিভ্রান্ত করা সহজ৷ নানান্ভাবে আশ্বাস ও প্রলোভন দিয়ে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলগুলি তাঁদের সমর্থন আদায় করে তাঁদের ঘাড়ে চড়ে ক্ষমতার উচ্চ সিংহাসনে আরোহন করছেন, ক্ষমতায় এসে সরকারগুলি নানান্ সুযোগ, সুবিধা দানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, সামান্য-ছিঁটে ফোঁটা করে কিছু কিছু পাইয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু কর্ষকরা সামগ্রিকভাবে বঞ্চনা ও  শোষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না৷ তাঁরাই দেশবাসীর অন্ন জোটাচ্ছেন আর তাছাড়া প্রায় সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যেরও তাঁরাই মূল কাঁচামাল উৎপাদন করছেন, যেমন বস্ত্রের জন্যে কার্র্পস উৎপাদন, শিক্ষার অন্যতম প্রধান উপকরণ কাগজের কাঁচামাল তাঁরাই উৎপাদন করছেন, এমনিভাবে ঔষধীয় লতাগুল্ম, ঘরবাড়ীর তৈরীর কাঠ প্রভৃতি তো চাষীদেরই পরিশ্রমের ফলে আমরা পাচ্ছি৷ কিন্তু এই চাষীদেরই বৃহদংশ অর্ধাহারে-অনাহারে শুকিয়ে মরছেন, অভাবের তাড়নায়,ঋণগ্রস্ত হয়ে হতাশায় গভীর খাদে নিমজ্জমান৷ প্রতি বছর হাজার হাজার  চাষী এই কারণে আত্মহত্যাও করছেন৷ সভ্যতার এঁরা পিলসুজ৷ মাথায় করে সভ্যতার  প্রদীপ ধরে রেখেছেন, সেই প্রদীপের আলোয় চারিদিকে উদ্ভাসিত,নিজেরা কিন্তু অন্ধকারে, শুধু প্রদীপের পোড়া তেল সর্বাঙ্গ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে৷ এই হ’ল চাষীদের অবস্থা!

কেন? তার প্রধান কারণ, কৃষি বা কৃষিজীবীদের মূল সমস্যার সমাধানের চেষ্টা একেবারেই হচ্ছে না৷ জমিতে সারা বছর জলসেচের ব্যবস্থা নেই৷ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে লড়াই করে তাদের চাষ করতে হয়, অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার ক্ষতিপূরণ পায় না৷ কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দেওয়া হয় না৷ কোনো শিল্পজাত পণ্য উৎপাদিত হওয়ার পর যেভাবে তার উৎপাদনের শ্রমমূল্যসহ সমস্ত প্রকার মূল্য হিসেব করে ওই পণ্যের বাজারদর নির্র্ধরণ করা হয, চাষীদের উৎপাদিত ফসলের মূল্য সেভাবে নিধারিত হয় না৷ ফলে  লাভের মুখ তারা দেখতে পায় না৷ আসলটাও উঠে না৷ চাষের ক্ষেত্রে উৎপাদিত দ্রব্যের চেয়ে চাষের খরচই বেশি৷ অথচ মাটির প্রতি  মায়ার জন্যে ও তাদের সামনে বিকল্প কিছু নেইও, তাই বছরের পর বছর সমস্ত দুর্র্ভেগকে তাঁদের মেনে নিতে হচ্ছে৷ তা মেনে না নিলে দেশও অচল হয়ে যেত৷ অথচ তাদের কথা ভাববার কেউই নেই৷

বামপন্থীরা গরীব ভূমিহীন মজুরদের হাতে স্বর্গ পাইয়ে দেওয়ার দাবী করে বিরাট ঘটা করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ভূমি সংস্কার করালো৷ কিন্তু তাতে বাস্তবে ভূমিহীন বা প্রান্তিক চাষীদের  কতটুকু উপকার হ’ল? গরীব চাষীরা যে ২/৪ কাঠা জমি পেল, তাতে ভালভাবে চাষ করার জন্যে পয়সা তাদের কাছে নেই, ভাল ভাবে জল সার-বীজ দিয়ে চাষ করার সামর্থ্য তাদের নেই৷ বেশির ভাগ  ক্ষেত্রে পরিবারের জীবিকা অর্জনের জন্যে তাদের অন্য কাজের সন্ধানে ছুটতে হ’ল৷ ফলে ওই জমিতে অনেক সময় চাষই হ’ল না৷  ভাগচাষ বা বর্গাচাষের পক্ষেও ঢাক-ঢোল পিটিয়ে খুব প্রচার করা হলেও সেক্ষেত্রেও চাষীর মুখে হাসি ফুটল না৷ কৃষি-মাণ্ডিতে নির্ধারিত  দামে ফসল বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেও এতেও চাষীদের যে দুঃখ ঘুচানো গেল কেউ সে দাবী করতে পারে না৷

এবার মোদিজী উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলেন৷ ‘এ যেন  রুটি পাচ্ছে না তো কেক খাচ্ছে না কেন’---এই ধরণের ব্যাপার৷ যে চাষীরা স্থানীয় মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের শোষণে জেরবার, তাদের বিশাল বিশাল  পুঁজিপতিদের সঙ্গে কুস্তির ময়দানে নামিয়ে দেওয়া হল৷

এখন, প্রথম প্রথম চাষীদের মন পেতে পুঁজিপতিরা চাষীদের ফসলের ভাল দাম দিলেও পরে তাদের অবাধ শোষনের হাত থেকে কে রক্ষা করবে? সে উত্তর নেই৷ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর নীলচাষের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে৷ মোদি সরকারের পাশ করা চুক্তিচাষের আইনের মাধ্যমে৷

তাই প্রাউট-প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন, কৃষি সমবায় ছাড়া কৃষি ও কৃষিজীবীদের বাঁচানোর কোনো উপায় নেই৷ কৃষি-সমবায়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমিখণ্ড একসঙ্গে যুক্ত করে বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ করা যাবে৷ সমবায় তৈরী হলে ঐক্যবদ্ধভাবে সেচের  জলের উন্নত ব্যবস্থা করা, উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশকের ব্যবস্থা করা, উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করাও সহজ হবে, সমবায় হলে সরকারী সুযোগ লাভ করাও সহজ হবে৷ সরকারও  সমবায়কে সাফল্যমণ্ডিত করার ব্যাপারে অর্থ, কৃষি যন্ত্রপাতি ও বিশেষজ্ঞও দিয়ে সর্বতোভাবে সাহায্য করতে বাধ্য থাকবে৷

প্রথমে অলাভজনক জোতগুলিকে নিয়ে ও পরে লাভজনক জোতগুলিকে নিয়ে সরকারকে ধাপে ধাপে কৃষি-সমবায় গড়ার উদ্যোগ নিতে হবে৷ কৃষি সমবায়ে কেউ কাউকে শোষণ করবে না৷ প্রবক্তা এটাও বলেছেন, সমবায়ের সাফল্য যে বিষয়গুলির ওপর নির্ভর করে তার একটি হল---নীতিবাদী প্রশাসকের কঠোর তত্ত্বাবধান৷ তার সঙ্গে সঙ্গে দরকার জনগণের নৈতিকতা  ও সামবায়িক মানসিকতা৷ শোষোক্ত দুটি বিষয়ও সমবায়ের জন্যে, শুধু সমবায় কেন,সর্বক্ষেত্রেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে গুরুত্ব দেননি৷ প্রাউটের ‘নব্যমানবতাবাদ’ তত্ত্বে জনগণের নৈতিকতা ও সামবায়িক মানসিকতা সৃষ্টির জন্যে বিশেষ পদ্ধতির কথাও বলা হয়েছে৷ প্রাউটে কৃষি ও গ্রামোন্নয়নের জন্যে কৃষি উৎপাদক সমবায় ও উপভোক্তা সমবায় দুয়েই ওপরই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ প্রাউটের এই ব্যবস্থার দ্বারা কেবল গ্রামের মানুষই নয়, শহরের উপভোক্তারাও সমভাবে উপকৃত হবেন৷