এন আর সি-র থাবা

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সহ এ রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসক দলের ছোট-বড় নেতা-নেত্রীরা প্রায়ই হুঙ্কার দিয়ে চলেছেন, পশ্চিমবাঙলায় এন অর সি লাগু করা হবে৷ এন আর সি-র আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে এই পশ্চিমবাঙলায়ও অসমের মত আত্মহত্যার মিছিল শুরু হয়েছে৷ এ পর্যন্ত এই বাঙলায় ১২ জনের আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে৷

এন আর সি কথাটির মানে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস্ অর্থাৎ ভারতীয় নাগরিকপঞ্জী৷ যারা ভারতীয় নয় বলে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তাদের বিদেশী আখ্যা দিয়ে ভারত থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে৷ যেমন, অসমে ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর নির্দেশে অসমে নতুন করে নাগরিকপঞ্জী তৈরীর প্রক্রিয়া শুরু হয় ও অসমবাসীদের এদেশের বৈধ নাগরিকত্বের নথিপত্র দাবী করা হয়৷ এরপর দেখা গেল, সরকার পক্ষ থেকে যে প্রথম দফা নাগরিকপঞ্জী প্রকাশ করা হয়, তাতে ৪০ লক্ষ বাঙালীর নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷

এইভাবে নাগরিকপঞ্জী তালিকা থেকে বাদ দেওয়া, ডি-ভোটার (ডাউটফুল ভোটার)-এর নোটিশ ও আলফার হুমকীর ত্রিফলা আক্রমনে হতাশ হয়ে ৫০ জনের বেশী বাঙালী আত্মহত্যা করেছে৷ তার মধ্যে তথাকথিত হিন্দু ও মুসলিম সবাই রয়েছে৷ ১৯৭১ সালকে ভিত্তি বছর করে বৈধ নাগরিকত্বের কথা বলা হয়েছে৷ অথচ ১৯৫১ সালের অসমের বাসিন্দা হিসাবে নাগরিককত্বের নথিপত্র দাখিল করা সত্ত্বেও এন আর সি-র তালিকা থেকে নাম বাদ পড়েছে৷ এমনি করে বহু বাঙালীর নাম বাদ দেওয়া হয়েছিল নাগরিকত্বের পঞ্জী থেকে৷ দ্বিতীয় দফায় সংশোধিত নাগরিকপঞ্জীর খসড়া তালিকা থেকে ১৯ লক্ষ বাঙালীর নাম বাদ পড়েছে৷ বিজেপি দাবী করেছিল তারা বাঙলাদেশ থেকে মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদেরই নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ দিতে চায়৷ তাদের বক্তব্য, জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে এটা জরুরী৷ কিন্তু ওপার বাঙলা থেকে ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে যারা ভারতে এসেছে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে৷ কিন্তু দেখা গেল যে ১৯ লক্ষ বাঙালীর নাম নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ পড়েছে তার ১২ লক্ষই তথাকথিত হিন্দু৷ এখন বিজেপি নেতারা কি উত্তর দেবেন? এই পরিপ্রেক্ষিতে ওখানকার বিজেপি নেতারাও এত হিন্দুদের নাম বাদ পড়ার প্রতিবাদ করেছেন৷ কিন্তু তাদের সরকারই তো এদের নাগরিকত্ব হরণ করে তাদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ এই সমস্ত বাঙালীদের চাকরী, ব্যবসা এমনকি জীবনও আজ বিপন্ন৷

যে বিপুল সংখ্যক বাঙালীর নাম নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়েছে, এখন তারা কোথায় যাবে? বাঙলাদেশ তো সরাসরি তাদের নিতে অস্বীকার করেছে৷ বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, ওরা বাঙলাদেশের নাগরিক নয়, তাই বাঙলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্ণই ওঠে না৷ তাহলে শেষ পর্যন্ত কি উপায়? ডিটেনশন ক্যাম্প নামক জেলে পাঠিয়ে অত্যাচারে, নির্যাতনে তাদের জীবন শেষ করে দেওয়া?

অথচ বর্তমান অসমের নওগাঁ, হোজাই, লংকা, লামডিং, বরপেটা, ধুবড়ী, গোয়ালপাড়া, কাছাড়, মিকির পাহাড়ের সমতল অংশ---এসবই প্রাচীন কাল থেকে মূল বাঙলার অংশ ও বাঙালী অধ্যুষিত৷ বর্তমানে ওই এলাকাগুলি অসমের অন্তর্ভুক্ত হলেও বাঙালীরাই এখানকার ভূমিপুত্র ও ভূমিকন্যা৷ এখন চক্রান্ত করে তাদের বিদেশী আখ্যা দিয়ে বিতাড়নের চেষ্টা করা---বাঙালীর বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্রের নামান্তর ছাড়া আর কি?

এখন পশ্চিম বাঙলা ও ত্রিপুরাতেও এন আর সি লাগু করে নাগরিকত্ব নবীকরণের নামে আবার লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করে তাড়াবার চক্রান্ত হচ্ছে৷

বহু গরীব মানুষ, ভূমিহীন, বাস্তুহীন মানুষ বারবার বন্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানান্ কারণে বাস্তুচূ্যত হয়েছে৷ তাদের অনেকের পক্ষে পুরোনো নথিপত্র সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি৷ যারা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেও স্বাধীনতার বলি হয়ে দেশ ত্যাগ করে এ বাঙলায় উদ্বাস্তু হয়ে এসেছে---তাদের সঙ্গে বহু গরীব মানুষ আছে যারা কোনও রকমে কায়ক্লেশে জীবন ধারণ করছে---তাদের অনেকের ক্ষেত্রেও সরকারের চাহিদা অনুসারে সমস্ত নথিপত্র পেশ করা সম্ভব নাও হতে পারে৷ তাদের কি হবে? তাদের সামনে কি আত্মহত্যা ছাড়া কোন পথ নেই?

যে মুসলমান ভাইরা এখানকার প্রকৃত নাগরিক, বর্তমান কেন্দ্রের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার তাদের হয়তো সহ্য করতে পারে না কিন্তু তারাও কোন্ যুক্তিতে বিদেশী হবে? বাঙালী জাতিকে দুর্বল করতে হিন্দু মুসলমানের মিলিত বাঙালী সংস্কৃতি তথা বাঙালী ঐক্যকে চূর্ণ করতে বারবার ব্রিটিশরা চেষ্টা চালিয়েছিল৷ ব্রিটিশ বিদায় নেওয়ার পরেও সেই বাঙালী বিদ্বেষী নীতি মেনেই হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী নানানভাবে বাঙালী জাতির ওপর আঘাত হেনে চলেছে৷ বাঙালী জাতিকে খণ্ড-বিখণ্ড করে’ এখানকার শান্তি-সংহতি সমস্ত কিছু ধবংস করতে চাইছে৷

আজ বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে সমস্ত ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হবে৷ পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িষ্যা সমস্ত রাজ্যের বাঙালীদের আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঙালী বিরোধী চক্রান্তের প্রতিবাদ করতে হবে ও বাঙালীর গৌরব পুনরুদ্ধারে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালাতে হবে৷