গান্ধী, নেহেরু, ব্রিটিশরা একযোগে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতেই সুভাষ বসুকে কংগ্রেস থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছিলেন

লেখক
মানস দেব

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের জন্য জেলে৷ সেই সময় কংগ্রেসের গয়া অধিবেশন চলছে৷ সভাপতি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ৷ সেই অধিবেশনে দেশবন্ধু বললেন, ব্রিটিশের সঙ্গে লড়াইয়ে নতুন ফ্রণ্ট খোলা হবে৷ সেই ফ্রণ্ট হবে আইনসভার ভেতরে৷ ভোটে জিতে ভেতর থেকে সরকারকে অচল করে দেওয়াটাই হবে নতুন কৌশল৷

কিন্তু গান্ধী গোষ্ঠী ভোট বয়কট, অধিবেশন সভা বয়কটের চিল চিৎকার জুড়ে দেশবন্ধুকেই বয়কট করে দিলেন গয়া অধিবেশন থেকে৷

তারপর দেশবন্ধু মতিলাল নেহেরুকে সঙ্গে নিয়ে দল গড়লেন ‘স্বরাজ পার্টি’ নাম দিয়ে ১৯২৪ সালে৷ কংগ্রেসেরও অধিকাংশের সমর্থন পেয়ে গেল স্বরাজ পার্টি৷ আপাততঃ নো-হোয়ার হয়ে গেলেন গান্ধী৷

নির্বাচনেও স্বরাজ পার্টির বিপুল সাফল্য এল৷ কয়েকটি প্রাদেশিক বিধানসভা ও কেন্দ্রীয় আইন সভায় তারা দলে ভারী হয়ে ঢুকলেন৷ পদে পদে ব্রিটিশ সরকারকে তারা নাস্তানাবুদ করে ছাড়লেন৷ জাতীয়তাবাদ আন্দোলন পুনরায় জীবিত হ’ল৷

গান্ধীজীও জেল থেকে ছাড়া পেলেন৷ তিনি দেখলেন তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত৷ তিনি আপাতত ভাবে রাজনৈতিক বানপ্রস্থে যাওয়াটাই ঠিক করলেন৷ কিন্তু অকস্মাৎ দেশবন্ধুর মৃত্যু ও মতিলাল নেহেরুর অযোগ্য লীডারশীপের জন্যে পুনরায় রাজনৈতিক ব্যাটন ফিরে পেলেন গান্ধীজী৷ তাঁর ব্যষ্টিত্বহীন নেতৃত্ব একদিকে স্বরাজ পার্টিকে শেষ করে দিল, অন্যদিকে গান্ধীজীও এর পূর্ণ সুযোগ নিয়ে মতিলালকে কংগ্রেসের সভাপতি করে দিলেন এক বছরের জন্যে৷

এরপর যথারীতি ১৯২৯ সালে কংগ্রেসের সভপতির আসন অঙ্কৃত করলেন জওহরলাল নেহেরু৷ কিন্তু আসনে বসেই তিনি উন্নত বামপন্থার প্রচার শুরু করেন৷ এতে রুষ্ট গান্ধী ও তাঁর অনুগত লোকেরা৷ ফলে পরের বছরেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হ’ল৷ যদিও গান্ধী নেহেরুকে কিছু সময়ের জন্য সরিয়ে দিয়ে তাঁকে শুধরে নেওয়ার সময় দিয়েছিলেন৷ কারণ এরপরও অর্থাৎ ১৯৩৬ ও ১৯৩৭ সালে তাঁকে দু’বার কংগ্রেসের সভাপতির পদ দান করা হয়েছে৷ ইতিহাস বলে নেহেরু ওই দুই বছর কলের পুতুলের মত সভাপতির পদ আলো করে বসেছিলেন৷ কোন উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখাতে পারেননি৷ বাম ও দক্ষিণী কেউই তাঁর ওপর খুশী ছিলেন না৷ কিন্তু বামেরা চুপচাপ থাকলেও গান্ধী গোষ্ঠীর নেতারা প্রতিবাদ শুরু করলেন৷ সর্দার প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ ও রাজা গোপালাচারী সহ ছয় নেতা পদত্যাগ করলেন৷ চলে গেল জওহরলালের কংগ্রেস সভাপতির পদ৷

এরপর গান্ধী সুভাষচন্দ্র বসুকে কংগ্রেস সভাপতির পদে বসালেন (১৯৩৫)৷ দেশবাসী সহ কংগ্রেস দল পেল সত্যিকারের একজন দেশহিতৈষীকে৷ সুভাষচন্দ্র যখন কংগ্রেস সভাপতির পদে বসেন তখন জাতীয় কংগ্রেস দেশের ১১টি প্রদেশের (তৎকালীন সময়) মধ্যে ছ’টি প্রদেশেই ক্ষমতায় ছিল৷ প্রদেশগুলি ছিল---উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, তামিলনাড়ু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বিহার ও অসম৷ অবশ্য দেশ বা কেন্দ্রের সব ক্ষমতা ছিল বড়ালাটের হাতে৷ সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতি হয়েই দু’টি বিষয়ের ওপর জোর দিলেন৷ (১) ইংরেজের বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলনকে আরও তীব্রতর করা৷ (২) স্বাধীন হবার পর দেশের জাতীয় পূর্ণ গঠন বাস্তবায়িত করার স্থির সিদ্ধান্ত৷

১৯৩৮ সালে হরিপুরায় কংগ্রেসের অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র (কংগ্রেস সভাপতি) বলেন---সব সাম্রাজ্যই বিভেদনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত৷ ব্রিটিশরা এদেশে বিভেদনীতিকে শেষ পর্যায়ে নিয়ে গেছে৷ ১৯৩৫ সালের নয়া শাসনতন্ত্রেই ব্রিটিশ ভারত ভাগের সূচনা করে রেখেছে৷ অসাধারণ দূরদর্শী সুভাষ তথাকথিত স্বাধীনতার নয় বছর আগেই বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন, এই দেশকে ভাঙ্গা হবে৷

সুভাষ বললেন, পরীক্ষামূলক ভাবে আমরা বিভিন্ন প্রদেশে সরকার চালাচ্ছি৷ এর মানে এই নয় যে আমরা শাসনতান্ত্রিক পথে আটকে যাব৷ ‘The acceptance of office in the provinces as an experimental, measure should not lead us to think that our future activity is to be confined within the limits of strict constitutionalism’  সুভাষ বললেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে সবরকম সম্পর্ক ছেদ করতে হবে৷ তাদের কোন রকম চিহ্ণ এদেশে থাকবে না৷ এরপর সুভাষচন্দ্র দেশের জাতীয় জীবনের পুনর্গঠন সম্বন্ধেও স্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করলেন৷ তিনি বললেন, ‘শিল্প বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে দেশকে এগোতে হবে৷’ কৃষি সম্বন্ধেও তিনি বললেন, ‘কৃষিকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে এগিয়ে না নিলে দেশের উৎপাদিকা শক্তি বাড়বে না৷’

উপরিউক্ত দুই ক্ষেত্রের যথার্থ উন্নতির জন্যে তিনি তৈরী করলেন জাতীয় প্ল্যানিং কমিশন৷ তারপর তিনি বিভিন্ন প্রদেশ কংগ্রেস সরকারগুলির শিল্পমন্ত্রীদের এক সভাও তিনি বসিয়েছিলেন দিল্লীতে৷ সুভাষচন্দ্রের এই কার্যকলাপ কংগ্রেসের গান্ধী গোষ্ঠীর খারাপ নজরে পড়ে গেল৷ সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেবার চক্রান্ত শুরু হ’ল৷ গান্ধী যে সুভাষচন্দ্রকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেবেন---এই কথা সমগ্র দেশবাসীই জেনে যায়৷ দেশের স্বাধীনতার স্বার্থে দেশের বিখ্যাত ব্যষ্টিত্বরা এগিয়ে এলেন৷ বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহা, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জয়প্রকাশ নারায়ণ সহ বাঙলার জাতীয়তাবাদী মুসলীমদের তরফে হুমায়ূন কবির, নবাবজাদা সৈয়দ হাসান আলি চউধুরী, আবুল মনসুর আহমেদ, আবুল হোসেন সরকার, তৎকালীন বামপন্থীরাও সুভাষ বসুকে কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে দ্বিতীয়বার বহাল রাখার পক্ষেই মত দিয়েছিলেন৷ কিন্তু গান্ধী কিছুতেই সুভাষচন্দ্রকে দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি না রাখার সিদ্ধান্তেই অনড় ছিলেন৷ যদিও সুভাষচন্দ্র পদ চলে যাবার ব্যাপারে একেবারে ভীত ছিলেন না৷ তিনি ১৯৩৯ সালের জানুয়ারী মাসে মুম্বই থেকে বিবৃতি দিয়ে বললেন, ‘দক্ষিণপন্থীরা শাসনতান্ত্রিকতার পথ ধরেছেন৷তারা লড়াই ছাড়াই স্বরাজের চিন্তা করছে৷ কিন্তু আমার দৃঢ় মত হ’ল, পূর্ণ স্বরাজ লাভের লক্ষ্যে আমাদের পৌঁছতেই হবে৷ সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত৷ এ সুযোগ জাতির জীবনে কদাচিৎ আসে৷ এ সুযোগ আমরা হারাতে পারি না৷ ‘All those who honestly believe that Swaraj will not be won without a fight-should consider it their sacred duty to prepare in every way for the coming developments’  যাঁরা স্বরাজ লাভের জন্য সংগ্রামের জন্য তৈরী তাদের আসন্ন পরিস্থিতিতে সর্বতোভাবে প্রস্তুত থাকা পবিত্র কর্তব্য৷

দুরদর্শী অধ্যাত্মবাদী সুভাষচন্দ্র আসন্ন বিশ্ব যুদ্ধ সম্বন্ধেই যে উপরিউক্ত মন্তব্য করেছিলেন তা বলাই বাহুল্য৷ যুদ্ধের আগাম প্রস্তুতি হিসাবে তিনি প্রকাশ্য ও গোপন ব্যবস্থা নিচ্ছিলেন৷

এরপর গান্ধীজী আর সহ্য করলেন না৷ নেমে পড়লেন সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে৷ কারণ ব্রিটিশদের সঙ্গে  গান্ধীজীর বোঝাপড়ায় সুভাষ কংগ্রেস সভাপতি থাকার জন্য অত্যন্ত অসুবিধে হচ্ছিল৷ আবেদন-নিবেদনের নীতির জন্যে ব্রিটিশদের পুরোপুরি বিরুদ্ধে যেতে পারছিলেন না গান্ধী৷ ফলে এবার তিনি আদাজল খেয়ে নামলেন সুভাষের বিরুদ্ধে৷ প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, জয়রাম দাস, জ্যোতি কৃপালনী, যামনলাল বাজাজ, শঙ্কর রাও দেও, ভুলাভাই দেশাইরা ছিলেন একেবারে গান্ধীগোষ্ঠীর নেতা৷ তারা তখন প্রবল বিক্রমে সুভাষকে সরাবার চক্রান্তে লিপ্ত হলেন৷ প্রথমে তারা আবুল কালাম আজাদকে কংগ্রেস সভাপতি করতে চাইলেন৷ তিনি রাজী হলেন না৷ এরপর তারা আর কোন প্রার্থী না পেয়ে পট্টভি সীতারামাইয়াকে প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করালেন৷ এ ব্যাপারে গান্ধী গোষ্ঠীর নেতারা যুক্তি দিলেন, ‘কংগ্রেস সভাপতি কংগ্রেসের নীতি ঠিক করেন না, ওয়ার্কিং কমিটি নীতি ঠিক করেন৷ সভাপতি ওই কমিটির চেয়ারম্যান মাত্র৷ তাঁকে সকলের মতামতকেই গুরুত্ব দিতে হবে৷ পট্টভিই যোগ্যতম ব্যক্তি৷’

সভাপতি নির্বাচনের আগে সুভাষচন্দ্র বললেন, ‘ওরা চাইছেন এমন একজন কংগ্রেস সভাপতি যিনি হবেন ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের হাতের পুতুল৷ একটা গ্রুপ চালাচ্ছে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিকে৷ ’‘The working committee is really controlled by a group within it.’’ অন্য সদস্যরা ওই গ্রুপের দয়ার ওপর নির্ভরশীল৷

তারপর ১৯৩৯ সালের ২৯শে জানুয়ারী ভোট নেওয়া হ’ল৷ সুভাষচন্দ্র পেলেন ১৫৮০টি ভোট৷ পট্টভি পেলেন ১৩৭৭টি৷ পট্টভি হারের পর গান্ধীজী বললেন, ‘পট্টভির হার আমার হার’৷ তারপরও গান্ধী বললেন, ‘যে প্রতিনিধিরা ভোট দিয়েছেন তাঁরা বোগাস, তাদের ভোটে যে পক্ষ হেরেছেন তাদের কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসুক ---’‘They must come out of the Congress’ তারা সভাপতির সঙ্গে সহযোগিতা করতে অক্ষম হলে দূরে সরে যাওয়াই উচিত৷(Those who feel uncomfortable in being in the Congress may come out) গান্ধীজী তাঁর অনুগামীদের প্রকাশ্যেই এই নির্দেশ দিলেন৷

এরপর ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে ত্রিপুরীতে হ’ল কংগ্রেসের অধিবেশন৷ সভাপতির ভাষণে সুভাষ বললেন, ‘সময় এসেছে ব্রিটিশ সরকারকে আলটিমেটাম দেওয়ার’৷ স্বরাজই আমাদের জাতীয় দাবী৷ ‘The item has come for us to raise the issue of Swaraj and submit our rational demand to the British Government as an ultimatum’

তারপর ইয়ূরোপে বাজল যুদ্ধের দামামা৷ ইংরেজরাও জড়িয়ে পড়ল যুদ্ধে৷ কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে সুভাষ থাকলে ইংরেজদের মহা বিপদ৷ অতএব অচিরেই মিলন হ’ল গান্ধী কংগ্রেসের সঙ্গে ইংরেজদের৷ ১৮৩৯ সালের মে মাসে সুভাষচন্দ্র পদত্যাগে বাধ্য হলেন৷ ভারতের ইতিহাসও বিপরীত দিকে ধাবিত হ’ল৷ শুরু হ’ল দুর্নীতি, মানবতা বিরোধের ইতিহাস---যা একবিংশ শতাব্দীতে আরও প্রসারিত৷