‘‘গণিত চর্চায় মহর্ষি কপিল’’

লেখক
শ্রী সমর ভৌমিক (শিক্ষক)

আজকে প্রবন্ধের বিষয় হ’ল মহর্ষি কপিলকে নিয়ে৷ মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণের যুগের সমসাময়িক মানুষ ছিলেন মহর্ষি কপিল৷ যে সময়ে মহর্ষি কপিল জন্মে ছিলেন, সে সময় ছিল আধ্যাত্মিক শিক্ষা, ছিল পুস্তক কিন্তু ছিল না কোন সুসঙ্কলিত দর্শন৷ ঠিক এমনি এক সময়ে সর্বপ্রথম মহর্ষি কপিলই সুসঙ্কলিত দর্শন রচনা করে মানব সমাজকে উপহার দিয়েছিলেন৷ পৃথিবীর প্রথম দর্শন সৃষ্টি হয়েছিল এই ভারতবর্ষের মাটিতেই৷ পৃথিবীর প্রথম ও প্রাচীনতম দর্শন হ’ল মহর্ষি কপিলের দর্শন৷

আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনহাজার বছর আগে মহর্ষি কপিল পশ্চিম রাঢ়ের কংসাবতী নদীর অববাহিকায় পাট ঝালদা গ্রামে জন্মে ছিলেন৷ তারপর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন কপিল পাহাড়ে ও তিনি মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গঙ্গাসাগরে সাগরদ্বীপে৷

মহর্ষি কপিল ছিলেন জ্ঞানের নিধান আদি বিদ্বান ও বিশ্বের প্রথম সাংখ্য দর্শনের  প্রবক্তা৷ এই দর্শন সাড়ে তিন হাজার বছর আগের দর্শন৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় হ’ল মহর্ষি কপিলের কথা আজ পর্যন্ত  জ্ঞানী--গুণী মহলে চর্র্চ নেই বললেই চলে৷ মহর্ষি কপিল যে আমাদের এই রাঢ় বাংলার সন্তান ছিলেন, তিনি যে রাঢ়ীয় সভ্যতার আলো সারা পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন, তা আমাদের অতীব গৌরবের বিষয়৷ এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা সেই বিখ্যাত কবিতা---

‘‘জ্ঞানের নিধান আদিবিধান কপিল সাংখ্যকার৷

এই বাঙলায় রচিল হায় সূত্রে হীরক হার৷৷’’

মহর্ষি কপিলের দর্শনটিকে ‘সাংখ্যদর্শন’ বলা হয়৷ এর কারণ হ’ল তিনি জগৎ সৃষ্টির কারণটাকে গণিত তথা সংখ্যার  দ্বারা বুঝিয়েছেন, অর্থাৎ মহর্ষি কপিল জগৎ সৃষ্টির মূল উপাদানগুলিকে  সংখ্যা দিয়ে বেঁধে ফেলার  চেষ্টা করেছেন৷ যা এর আগে কেউ করেননি৷ এভাবে আধ্যাত্মিকতাকে গণিতের মাধ্যমে বোঝানো যায়, এটা বিশ্বে এই প্রথম ও প্রাচীনতম৷

সাংখ্য দর্শনের মূল কথা হচ্ছে---সৃষ্টির মূল উপাদানগুলি হ’ল পঁচিশটি৷ এই পঁচিশটি তত্ত্ব বা উপাদান হ’ল--- পুরুষ,প্রকৃতি, মহৎ, অহং, পঞ্চতন্মাত্র, একাদশ ইন্দ্রিয় (অর্থাৎ পঞ্চ জ্ঞান ইন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও অতি ইন্দ্রিয় মন) এগুলিকে মহর্ষি কপিল সংখ্যার দ্বারা নিম্নরূপে প্রকাশ করেছেন---

1+1+1+1+5+5+11=25 =52)

আবার, সংখ্যা দর্শনে প্রকৃতি মানেই তিন প্রকার গুণসত্ত্বঃ, রজঃ ও তমঃ এর সাম্যবস্থা৷ এরূপ সাম্য অবস্থায় জগতের সৃষ্টি হয় না৷ পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনে যখন সাম্য অবস্থা ব্যাহত হয়, তখনই হয় সৃষ্টি৷ অর্থাৎ সাংখ্য দর্শনে গাণিতিক আকার দাঁড়ায় নিম্নরূপ---

1+1+1+1+5) = 9 =32

 

কিন্তু ত্রিগুণের তারতম্য অনুসারে, একাদশ ইন্দ্রিয় ও পঞ্চতন্মাত্রের উদ্ভব হয়, অর্থাৎ 11+5) =16 = 42

অতএব, সাংখ্যের পরিণামবাদে এসে হ’ল---32+42=52

 

অর্থাৎ 32+42=52---এটাই হ’ল বর্তমানের বিখ্যাত পিথাগোরীয় উপপাদ্য৷ এইভাবে আজ থেকে সাড়ে তিনহাজার বছর আগে এই উপপাদ্যটির উদ্ভব হয়েছিল৷

বর্তমানে ‘পিথাগোরাসের থিওরী’ বলে যেটি ছাত্র-ছাত্রাদের পড়ানো পড়ানো হয় তা প্রকৃতপক্ষে মহর্ষি কপিলেরই মৌলিক আবিষ্কার৷ তাই অনুমিত হয় যে পিথাগোরাস যে উপপাদ্যটি দিয়েছেন, তা কপিলেরই নকল৷

আনুমানিক585 খ্রীঃ পূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে পিথাগোরাস সামোস দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন ও জ্ঞানার্জনের জন্যে তিনি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে এসেছিলেন৷ এ পর্যন্ত জানা গেছে তিনি মিলেটাস, ব্যবিলন, মিশর প্রভৃতি দেশ ও ভারতেও তিনি জ্ঞান অর্জনের জন্যে এসেছিলেন৷ বিবেকানন্দের লেখায় এ সম্পর্কে উল্লেখ আছে--- ‘Pythagoras came to India and studied this Philosophy (Sankhya); that was the begining of the philosophy of the Greeks.’’

কপিল পাহাড়ের গুহায় বসে তিনি সাধনা করতেন সেই গুহাতেই বসে তিনি জ্যামিতি চর্র্চ করতেন৷ এই গুহার নামকরণ হয়েছে--- ‘জ্যামিতিক গুহা৷’ এই গুহাতেই মহর্ষি কপিল রচিত পাথরের বুকে খোদাই করা জ্যামিতিক নক্সা পাওয়া গেছে৷ বলা বাহুল্য এই গুহার সর্বপ্রথম সন্ধান দেন মহান দার্শনিক ও ঐতিহাসিক  শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার মহাশয়৷ এই সমস্ত পাথরের গায়ে অস্পষ্ট লেখাগুলিকে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার উদ্ধার করেন ও কপিল সম্পর্কে বহু কথা প্রমাণসহ বলেছেন--- যা ইতোপূর্বে আমাদের কারোরই জানা ছিল না৷ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার মহাশয় আরও বলেছেন--- ‘‘কোণ বলতে যা বুঝি--- দুটি বাহু (Side) যেখানে অভিন্ন (Common) বিন্দুতে মিলছে সেখানে ওই অভিন্ন বিন্দুকে ছুঁয়ে  যে ভূম্যংশ (Angle) তৈরী হচ্ছে তা৷’’ জ্যামিতির কোণ-বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছিলেন আদিবিদ্বান প্রথম দার্শনিক মহর্ষি কপিল৷ তিনিই প্রথম বলেছিলেন--- একটি সমকোণী ত্রিভুজে মোট 1800 ডিগ্রী কোণ আছে ও সমত্রিকোণী ত্রিভুজের প্রতিটি কোণ 600 ডিগ্রী হয়ে থাকে, (a+b)2 = a2+b2+2ab  এই সূত্রটির আবিষ্কার কর্তা হলেন মহর্ষি কপিল৷’’

আধ্যাত্মিক দর্শনের মধ্যে জ্যামিতি ও বীজগণিতকে সংযুক্ত  ক’রে পৃথিবীর প্রথম ও প্রাচীনতম দার্শনিক হিসাবে মহর্ষি কপিল মানুষের কাছে যুগের পর যুগ চিরনমস্য হয়ে থাকবেন৷