‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বি নিত্য-নিঠুর দ্বন্দ্ব’

লেখক
আচার্য সাত্যশিবানন্দ অবধূত

কবিগুরুর এই উক্তি আজ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে৷ সমাজের সর্বত্র---সারা বিশ্বেরই এখন এই ছবি৷ আমেরিকার মত তথাকথিত অধুনিক সভ্যতার ধবজাধারী দেশে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে নিষ্ঠুর ভাবে কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের খুনের ঘটনায় গোটা দেশে বিক্ষোভের অগুন জ্বলছে৷ রাস্তায় পড়ে আছে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড৷ তার দুটো হাত পিছমোড়া করে বাঁধা৷ আর তার ঘাড়ের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে আছে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার৷ কৃষ্ণাঙ্গ যুবকটি চিৎকার করে বলবার চেষ্টা করছে, আমি আর শ্বাস নিতে পারছি না! এই ভাবেই ওই কৃষ্ণাঙ্গ যুবকটিকে নৃশংসভাবে খুন করা হলো৷ মদগর্বী শ্বেতাঙ্গ পুলিশের একজন কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের প্রতি এহেন নির্মম আচরণের ভিডিও সোস্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ হতেই তেতে উঠেছে সারা দেশ৷ করোনা সংক্রমণের ভয়, সামাজিক দূরত্ব এই সব কিছু অমান্য করেই সারা মার্কিন দেশ জুড়ে এই বিক্ষোভ আন্দোলন সামাল দিতে বিশাল সামরিক বাহিনী নামানো হয়েছে৷  তবুও থামানো যাচ্ছে না এই আন্দোলন৷ কোথাও  বাস ভাঙ্গচুর, কোথাও শপিং মলে অগ্ণি সংযোগ, কোথাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট বৃষ্টি সমানে চলছে৷ 

সারা পৃথিবী জুড়ে সর্বত্রই--- কি বাইরের দেশে কি আমাদের দেশে মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিক আচরণ, ঘৃণা, অবহেলা, হিংসা, দ্বেষ, শোষণ মানবতার মুখে কলঙ্ক লেপন করে চলেছে৷  আজকাল পত্র-পত্রিকা খুললেই তো সর্বাগ্রে এই সবই চোখে পড়ে৷ যেমন, বর্তমানেও  এই দেশে  লকডাউনের পরিপেক্ষিতে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের অমানবিক ব্যবহার৷  এও চরম নির্মমতার সাক্ষ্য হয়ে থাকবে৷

আজকাল বড় বড় করে ব্যানার দিয়ে পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান চালানো হয়৷ বাহ্যিক পরিবেশের চেয়ে মানুষের মানসিক পরিবেশের দূষণটাই সবথেকে যে মারাত্মক---এই কথাটা আজকের সভ্যতাগর্বী মানুষেরা বুজছে কই!

আজ মানুষ মানবতাকে ---মানবিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছে৷ মুখে অনেকেই মানবতার বুলি আওড়ান, কিন্তু মনের মধ্যে হীন স্বার্থের কীটগুলোকে পোষণ করছেন৷ তাই, তাদের মানবতাবাদ মেকি-মানবতাবাদে পরিণত হয়েছে৷ মুখে শান্তির কথা বলা হচ্ছে, অথচ তলে তলে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংসৃকতিক, সমস্তক্ষেত্রেই শোষণ চালানো হচ্ছে৷ পশুজগৎ-উদ্ভিদ্ জগৎকে তো আমরা ধবংস করে দিচ্ছি৷ নিজেদের জিভের লালসা মেটানোর জন্যে নিরীহ পশুদের চরম কষ্ট দিয়ে হত্যা করে উদরসাৎ করা হচ্ছে৷ অথচ এই পৃথিবীতে তাদেরও যে বাঁচার অধিকার আছে ---সেটুকু ভাববার অবকাশ নেই৷

তাই তো উন্মার্গগামী এই যুগের মানুষদের চেতনা ফেরানোর জন্যে জগদ্গুরু  শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী নব্যমানবতাবাদ দর্শন দিয়েছেন৷ এতে তিনি বলেছেন, মানুষের দেহ পেয়েছ, মানুষের মত কাজ করো৷ মানুষের কাজে যেন মনুষ্যত্বের প্রকাশ ঘটে৷ সমস্ত মানুষ, পশু-পক্ষী-তরুলতার প্রতি ভালবাসা ও সেবার ভাবনা যদি না থাকে তাহলে সে প্রকৃত মানুষ পদবাচ্য নয়৷

আর মানুষকে যথার্থ মানুষ হতে গেলে তার বুদ্ধি-বিবেকের যথার্থ ব্যবহার করতে হবে৷ তাই তাকে নীতিবাদী হতেই হবে৷ আর নীতিবাদের দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব আসে আধ্যাত্মিকতা থেকে৷ এখানে কোন সংকীর্ণ রিলিজিয়নের কথা বলা হচ্ছে না, সার্বভৌম মানবধর্মের কথাই বলা হচ্ছে৷

মানুষ তার হিংস্র প্রবৃত্তির দ্বারা আজ যথেচ্ছভাবে জীব-বৈচিত্র্য নষ্ট করে চলায় আজ প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিপন্ন হতে চলেছে৷ আজকে নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মারাত্মক করোনা বাইরাস---এই সব কিছুর পেছনে যে প্রকৃতির রোষ কাজ করছে, তা একটু তলিয়ে চিন্তা করলেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে৷

তাই এখনও সময় আছে, মানুষ যদি নব্যমানবতাবাদের পথে না চলে, তাহলে সমাজের বুকে চরমতম বিপর্যয় নেমে আসবে৷ মৃলতঃ এই বার্তাই বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ভাষায় মানুষকে শুনিয়েছেন এই যুগের বিভিন্ন মনীষীরাও, যেমন--- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ, বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন, মহান দার্শনিক বার্ণার্ড শ প্রমুখ৷

  আমরা আশাবাদী৷  এই অন্ধকারের পর নব্যমানবতাবাদের অরুণ ঊষার উদয় হবেই৷ যারা নোতুনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসবেন, জয় তাদের হবেই হবে৷ কেননা তাঁদের সঙ্গেই থাকবে পরমপিতার আশীর্বাদ ৷