হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন রুখতে হবে

কেন্দ্রে আবার বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে৷ এর জন্যে এরা যে বিপুল অর্থশক্তি ও রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়েছে তা বলাই বাহুল্য৷ তার ওপর বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভাজন নীতি সাধারণ মানুষকে যে বিপথে পরিচালিত করেছে, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই৷

মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ সমাজের বা দেশের প্রকৃত উন্নতি ঘটাতে গেলে সমস্ত মানুষকে সঙ্গে নিয়েই এগোতে হয়৷ মানুষে মানুষে আপাত বিরোধ বা পার্থক্য ভুলে সমস্ত মানুষকে ঐক্যের সূত্রে আবদ্ধ করে চলতে হয়৷

কিন্তু বিজেপির নীতি ঠিক উল্টো৷ মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা, এক জনগোষ্ঠীকে অপর জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়া৷ সাম্প্রদায়িক সেণ্টিমেণ্টকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বিশেষ জনগোষ্ঠীকে খুব সহজেই কাছে টানা যায়, কিন্তু তাতে কারোরই প্রকৃতপক্ষে লাভ হয় না৷ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে পুঁজি করে যে কারোর কোনো লাভ হয় না, তা স্বাধীনতার পর ভারত-পাকিস্তান---দুই দেশই সমানভাবে বুঝেছে৷

সাম্প্রদায়িক সেণ্টিমেণ্টকে কাজে লাগিয়ে সহজে ক্ষমতায় আসা যায়, সহজে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়, কিন্তু তাতে তথাকথিত কোনো সম্প্রদায়ের কোনও লাভ হয় না৷

বিজেপির নির্বাচনী প্রচারে বারে বারেই সাম্প্রদায়িক সেণ্টিমেণ্টকে উস্কে দিয়ে বলেছে, ক্ষমতায় এসে তারা এন.আর.সি. লাগু করবে৷ তারা তাদের সাম্প্রদায়িক তাস খেলে প্রচার করে,বাঙলাদেশ থেকে আগত হিন্দু বাঙালীদের তারা সসম্মানে নাগরিকত্ব দেবে৷ কিন্তু মুসলীমদের নয়৷ এই বলে মুসলিম বাঙালীর বিরুদ্ধে তারা হিন্দু বাঙালীদের তাতিয়েছে৷

কিন্তু বাস্তব সত্য কী বলে? অসমে এন আর সি করে ৪০ লক্ষ বাঙালীর নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷ তাদের অনেককেই ‘ডিটেনশন ক্যাম্পে’ পাঠানো হয়েছে, যেখানে তাদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চলছে৷ এই ৪০ লক্ষ বাঙালীর মধ্যে ২২ লক্ষই হ’ল হিন্দু বাঙালী৷ এন.আর.সি.-র কোপে তারা এখন চরম দুর্দশার শিকার হচ্ছে৷ বিজেপি’র যদি এতই হিন্দু প্রীতি---তাহলে এই ২২ লক্ষ হিন্দু বাঙালীর এই দুর্দশা কেন৷ কেনই বা অসমে এন.আর.সি.-র অত্যাচারে অত্যাচারিত হয়ে প্রায় ৩৯ জনকে আত্যহত্যা করতে হয়েছে?

তাহলে কী এটাই পরিষ্কার নয়, হিন্দুত্ববাদও স্রেফ একটা বুলি৷ মূল কথাটা হ’ল ক্ষমতাবাদ৷ যেন তেন প্রকারে মানুষকে বিভিন্ন সেণ্টিমেণ্টের সুরাপান করিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করা৷ তাছাড়া, আর একটা জিনিস বেশ লক্ষ করা যাচ্ছে, যা হ’ল বাঙালী বিদ্বেষ৷ হিন্দু হোক, মুসলমান হোক বাঙালীদের শেষ করে দিতে হবে৷ ‘হিন্দী, হিন্দু, হিন্দুস্তান’ শ্লোগানধারী হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীরা বাঙালী জাতিকে কোনদিন সহ্য করতে পারেনি৷ তাই স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালীর আত্মত্যাগকে অস্বীকার করে ওরা ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করে এসেছে৷ ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তার ভুক্তভোগী৷ তাঁকে দিয়ে বাঙালী বিদ্বেষী কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস থেকে বাঙালীর বৈপ্লবিক আন্দোলনকে বাদ দিতে চেয়েছিল৷ ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তা নিজেই বলেছেন৷ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে কংগ্রেস থেকে হটিয়ে ছিল এরাই৷ আবার স্বাধীনতার পরবর্তীকালেও নেতাজী যাতে ফিরে আসতে না পারেন তারও জন্যে বহু কৌশল ফেঁদেছে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী৷

বিজেপিও সেই হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীদের শিরোমণি৷ তাই বাংলাতে হিন্দু-মুসলিম লড়াই বাঁধিয়ে দিয়ে ওপার বাঙলার উদ্বাস্তু বাঙালী ও পশ্চিম বাঙলার সাবেকী বাঙালীদের মধ্যেও বিরোধ বাঁধিযে ফায়দা লুটতে চাইছে৷ ওরা বাঙলার ভাষা-সংস্কৃতি, বাঙালী জাতি সত্তা---সবকিছুকে ধবংস করে এখানে রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে৷ আর এই বিজেপি তো প্রকৃতপক্ষে পুঁজিপতিদেরই পার্টি, পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষাই এই পার্টির মুখ্য উদ্দেশ্য৷ এদের প্রভাবে পুঁজিবাদের ভিত শক্ত হবে৷ আর তার স্বাভাবিক ফল সাধারণ জনগণের দারিদ্র্য ও বেকার বৃদ্ধি৷ তাই আজ পুঁজিবাদ তথা ডগমার আগ্রাসন থেকে বাঙলা ও বাঙালীদের বাঁচানোর জন্যে সমস্ত বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে৷