কর্ষক প্রধান বাঙলার  ইতিকর্তব্য

লেখক
একর্ষি

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

চলছে বিশ্ব উষ্ণায়ন৷ বৃষ্টিপাতের ঘাটতি৷ কৃষির উন্নয়নের নামেবিজ্ঞানের অপপ্রয়োগে মহাজনী ঋণ কৃষির প্রাণরসটুকু শুষে নিয়েছে৷  কৃষিতে সাফল্য আনতে কর্ষকের নূ্যনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা বাঞ্ছনীয়৷ নচেৎ কৃষিতে সর্বাধুনিক উন্নত বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ব্যবহার সম্ভব নয়৷ এ ধরণের ভাবনা দানা বাঁধতে শুরু করেছে৷ চাষীর পরিবারের চাষ সম্পর্কে কেমন একটা নেতিবাচক মানসিকতা গড়ে উঠেছে৷ পাশাপাশি কৃষিকার্য সম্পর্কে আদ্যিকালের ধ্যান-ধারণাও ফিকে হয়ে আসছে৷

ব্রিটিশের শিক্ষা জাত বাবুকালচার, বৌদ্ধিক শ্রমে আসক্তি ও দৈহিক শ্রমে অনীহা ও ঘৃণা তৈরীর ফলে কৃষিটা চাষাভুষোর ব্যাপার হয়েই আছে৷ সেভাবে গুরুত্ব পায়নি৷ বর্তমান ও নিকট ভবিষ্যতে বিপর্যস্ত শস্যহীন বছরের স্থানীয় ও সমগ্র দেশের চাহিদার কথা ভেবে পরিকল্পনা মাফিক উৎপাদন ব্যবস্থা নেই৷ প্রয়োজন অনুযায়ী শস্য নির্বাচন করে উৎপাদনের ভাবনাও গড়ে ওঠেনি৷ সোজা কথা---উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগ্য ব্যবস্থার কোনও বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা মাফিক নিয়ন্ত্রণ নেই৷ কৃষি, কৃষিভিত্তিক ও কৃষি-সহায়ক শিল্প পরস্পরের উন্নয়নের পরিপূরক৷ এই সামঞ্জস্য সেই যে ব্রিটিশ ধবংস করে দিয়েছে---আজও তা পুনর্ঘটিত হয়নি৷ সর্বাধিক উৎপাদন পেতে কোন্ স্থানে কোন্ মাটিতে কোন্ সময় কোন্ ফসল চাষ করতে হবে---কৃষি বিজ্ঞানীদের এই গবেষণার কোন মূল্যই দেওয়া হচ্ছে না৷ যে যার খেয়াল-খুশী মত চাষ করে৷ একজন একটা ফসল চাষ করে অনেক লাভ করল৷ দেখা দেখি ছোঁয়াচে রোগের মত সবাই একই চাষ করে বসল৷ যুক্তি বিচার নেই৷ সবাই লোকসানের কবলে পড়ল৷ কেন্দ্র ও রাজ্য নামেই কৃষি বিভাগ আছে৷ কৃষি ও কর্ষকের উন্নয়নের জন্য এ যাবৎ যা চিন্তা-ভাবনা হয়েছে সবই বিচ্ছিন্ন ভাবে কোনও কম্প্রিহেনসিব্ আউটলুক (সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী) নেই৷ এটা না থাকলে কৃষিতে কর্ষকের প্রকৃত কল্যাণ সম্ভব নয়---এই বোধটাই কৃষি ও কর্ষকপ্রেমীদের জন্মায়নি৷ গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত রাজনৈতিক মাতববররাই একে জটিল করে দিয়েছে, একথা মনে রাখা দরকার৷ আলোচিত সমস্যাগুলি মুদ্রার এপিঠ ওপিঠের মত অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত৷

বাঙলার কৃষির এই সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় প্রাউটের আবির্ভাব এক যুগান্তকারী ঘটনা৷ প্রাউট একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন৷ স্রষ্টা দার্শনিক শ্রেষ্ঠ শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার৷ প্রাউটের কৃষিনীতিই ওপরের কৃষির সমস্যাগুলোকে সার্বিক সুচারু সমাধান করতে পারে৷ এ নীতি বৈবহারিক, বিজ্ঞানসম্মত, মনস্তাত্ত্বিক, প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারী ও কালের গতিধারার অনুবর্তী৷ অর্থশাস্ত্রে দু’ধরণের তত্ত্বের কথা বলা হবে৷ (১) কেন্দ্রিত ও (২) বিকেন্দ্রিত৷ প্রাউট বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক তত্ত্বের কথা বলে৷ বিকেন্দ্রিত অর্থনীতির সারকথা হ’ল প্রতিটি মানুষকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রদান৷ আর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মানে প্রতিটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অর্জন করা৷ অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বয়ম্ভর বা সাবলম্বী হওয়া অর্থাৎ সকল প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার ক্ষমতা বা সামর্থ্য লাভ করা৷ প্রাউটে বিকেন্দ্রিত অর্থনীতির চাবিকাঠি হ’ল সমবায় ব্যবস্থা৷ এর সফল প্রয়োগ ঘটবে ব্লক ভিত্তিক স্বয়ম্ভর অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে৷  প্রাউটের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ক্ষুদ্রতম বা মৌলিক একক হ’ল ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা৷ ওই উন্নয়ন পরিকল্পনার একটা অঙ্গ হ’ল কৃষিনীতি৷ একটা ব্লককে স্বাবলম্বী বা স্বয়ম্ভর করে গড়তে কৃষি, শিল্প ইত্যাদি সব কিছু নিয়ে পরিকল্পনা রচিত হয়৷ সুতরাং কৃষি সংক্রান্ত সবকিছুই পরিকল্পনার নিয়ামক সংস্থার দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত৷ কাজেই প্রাউটের কৃষিনীতি সামগ্রিকতার পরিভূর অন্তর্গত৷

প্রাউটের কৃষিনীতির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক হ’ল কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দান৷ এই নীতির উদ্দেশ্য হ’ল কৃষি ও কর্ষকের সামাজিক-মানসিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা৷ প্রবক্তার ভাষায় ‘এই নীতির উদ্দেশ্য হ’ল---কৃষিকে শিল্পের মত সমান গুরুত্ব দিতে হবে৷ শিল্পে কোনও দ্রব্য সামগ্রীর দর নির্ধারণের সময়ে কাঁচামালের দাম, শ্রমিকের মজুরী, ঋণের সুদ, সমগ্র ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ, সংরক্ষণের মূল্য, লাভের পরিমাণ, উৎপাদন হার ইত্যাদির ভিত্তিতে কোনও জিনিসের দাম নির্ধারিত হয়ে থাকে৷ (ক্রমশঃ)