কুসংস্কার, ধর্ম ও সমাজ

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

সুস্থ বিচারবুদ্ধি তথা বিবেকের প্রেরণাতে মানুষ এগিয়ে চলে’ শ্রেষ্ঠ জীবের শিরোপা লাভ করেছে ও ক্রমশঃ সভ্যতার পথে এগিয়ে চলেছে৷

কিন্তু ধর্মের নামে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ভাবজড়তা বা ডগ্‌মা মানুষের সেই সুস্থ বিচারবুদ্ধি-তথা বিবেবকে আচ্ছন্ন করে,ঢেকে দেয়,প্রকাশ হতে দেয় না৷ তখন মানুষ ধীরে ধীরে পশুত্বের পর্যায়ে নেমে যায়৷

প্রকৃত ধর্মের সহায়তায় কিন্তু মানুষ পশুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়, আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতাকে বিশ্বকেন্দ্রিক করে মানুষকে দেবত্বের মহিমায় ভাস্কর করে তোলে৷ তাই ধর্মের প্রধান শত্রু এই অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার তথা ও ভাবজড়তা৷

সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তুরে এক শিক্ষক দম্পত্তি ভয়ানক কুসংস্কারগ্রস্ত হয়ে তাঁদের দুই মেয়েকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে৷ তাঁদের মনে এই অন্ধবিশ্বাস ছিল কলির শেষ হয়ে নাকি সত্যযুগ শুরু হচ্ছে৷ এই যুগসন্ধিলগ্ণে মেয়েদের যাগযজ্ঞ করে হত্যা করলে তারা সত্যযুগে সবাই জন্মলাভ করবে৷ তাই যজ্ঞ করে দুই মেয়ের মাথায় ডাম্বল মেয়ে তাদের হত্যা করল তাঁদেরই গর্ভধারিনী মা৷ তাঁকে সাহায্য করেছেন তার বাবা৷ মা আর বাবা দুজনেই কিন্তু  তথাকথিত শিক্ষিত৷ মা আই-আই-টি’র প্রশিক্ষক আর বাবা রসায়নের অধ্যাপক৷ অর্থাৎ দু’জনেই বিজ্ঞানের শিক্ষক৷ কিন্তু অন্ধবিশ্বাসের কবলে পড়ে দু’জনেই পশুর মত কাজ করল, না-পশুর মতন বলব না, পশুর চেয়ে এরা একেবারে অধম৷ পুলিশ এই দুজনকে  গ্রেফতার করেছে৷ তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ‘মানসিক রোগগ্রস্ত’ হওয়ার কোনও লক্ষণই দেখছেন না চিকিৎসকবৃন্দ৷

স্রেফ অন্ধবিশ্বাসের দ্বারা গ্রস্ত হয়েই তারা এধরণের কাজ করেছে৷ অন্ধবিশ্বাসের দ্বারা গ্রস্ত হয়ে এ রাজ্যেও এর আগে শিশুবলি ও ডাইনি হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে৷ এধরণে বীভৎস ঘটনা খুব বেশি না হলেও অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার বা ডগমার প্রভাব কিন্তু আজও সমাজে ব্যাপকভাবে চলেছে৷ বর্তমানে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের বিরাট অংশ, অধুনা শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক-যুবতীও অন্ধবিশ্বাসের দ্বারা কম গ্রস্ত নন৷ তারা নিরুদ্বিগ্ণভাবেই এইসব কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে৷

যেমন, জাত-পাত-সম্প্রদায় বিভেদ---এসবও তো চরম কুসংস্কার৷ ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগটাই হয়েছে সাম্প্রদায়িক বিভেদের মতো কুসংস্কারের ভিত্তিতে৷ আজ তার আজস্র কুফল এই উপমহাদেশের মানুষকে ভুগতে হচ্ছে৷ এখনও ভারতের শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের মতো ভয়ঙ্কর কুসংস্কারকে লালন করে চলেছেন---যা ভারতের সংহতি ও শান্তি বিনষ্ট করে দিয়েছে৷

অনেকে আবার সাম্প্রদায়িক বিভেদকে কুসংস্কার বলে জানেন ঠিকই, কিন্তু জাত-পাতের বিভেদের মত কুসংস্কার নিরুদ্বিগ্ণ চিত্তে মেনে চলেছেন৷ আমাদের নেতা-নেত্রীরাও অনেকেই নিজেদের ব্রাহ্মণ বা উচ্চকুলজাত মনে করেন ও তার জন্যে বিশেষ চিহ্ণও ধারণ করেন৷ ছোটজাত বা বড় জাতের ভাবনা থেকে নিজেরাও মুক্ত নন অথচ মঞ্চে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা ভাষণ দেন৷

জাত-পাতের ভিত্তিতে তো বর্তমানে বোট ব্যাঙ্ক তৈরী করা হয়, নির্র্বচনে হার জিতের অংক কষা হয়৷

সরকারীভাবেই এত বড় একটা কুসংস্কারকে সযত্নে লালন করা হয়৷ জাত-পাতের ভিত্তিতে সংরক্ষণ তার সবচেয়ে উজ্বল নিদর্শন৷ এই ব্যবস্থায় সরকারীভাবে জাতপাতের ব্যবস্থাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে৷ এটা তো বাস্তব যে তথাকথিত নিম্নবর্ণীয় অর্থনৈতিকভাবে ও শিক্ষাগতভাবে সবদিক থেকে পিছিয়ে৷ তাদের জন্যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করলে তো তারা চিরকালই পিছিয়ে থাকবে৷ তাই তাদের উন্নতির জন্যে এই ব্যবস্থা জরুরী৷

যদি যথার্থ কুসংস্কারমুক্ত  প্রগতিশীল মানসিকতা নিয়ে পরিকল্পনা করা হয় তাহলে সমাজে জাত-পাত নির্বিশেষে যে জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক ভাবে ও শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে--- তার ব্যাপক সমীক্ষা করে, সেই অনুসারে তাদের উন্নয়নের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে৷ তাতে জাত-পাত নির্বিশেষে সমস্ত পিছিয়ে পড়া মানুষের  উন্নতি ঘটানো যাবে৷ আসলে  বোটের স্বার্থেই রাজনৈতিক দলগুলি জাত-পাত ব্যবস্থাকে  জিইয়ে রেখেছেন, এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷

আবার ধর্মীয় ক্ষেত্রে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ভাবজড়তা বা ডগ্‌মাকে প্রশ্রয় দেওয়া সমাজের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক৷ সমাজের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার প্রভৃতির ক্ষতিকারক দিক দেখে অনেক শিক্ষিত ব্যষ্টিও ধর্মকেই কাঠগড়ায় তোলেন৷ তারা ধর্মের থেকে সবাইকে দূরে থাকারও পরামর্শ দেন৷ সমাজে জড়বাদ ও ভোগবাদের প্রাবল্য এ থেকেই৷

এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যার দিকে আমরা  এক্ষেত্রে  সঙ্গতভাবে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে চাই৷ বর্তমান সমাজে করোনা বাইরাসের চেয়েও মারাত্মক যে ব্যাধি ভয়ঙ্করভাবে ছড়াচ্ছে ও গোটা সমাজব্যবস্থাকে ধবংস করে দিচ্ছে তা হ’ল ব্যাপক নীতিহীনতা তথা দুর্নীতি৷ মানুষের ব্যষ্টিজীবন ও পারিবারিক জীবন বা সমাজজীবন সর্বত্রই আজ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ছে এই সমস্যা৷ টিকা আবিষ্কার করে করোনা বাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় বের করলেও সমাজের এই ব্যাপক নীতিহীনতা ও দুর্নীতি রূপ মারাত্মক ব্যাধির সমস্যার কথা বলা হ’লো এর নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় সম্পর্কে ভেবেছেন কি কিছু? না--- হয়তো এর উপায় খুঁজেই পাচ্ছেন না৷

এই সমস্যারই একমাত্র সমাধান হল--- (১) প্রকৃত ধর্ম কী জানা (২) ধর্ম থেকে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে পৃথক করা (৩) সমস্ত  রকমের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারাৎ ভাবজড়তা বা ডগ্‌মা বর্জন করা ও এর বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করা৷ (৪) প্রকৃত ধর্ম বুঝে তার সাহায্যে মনুষ্যত্বের তথা মানব অন্তরের দেবত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটাবার সাধনায় ব্রতী হওয়া৷

এক কথায় চাই প্রকৃত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার৷ এজন্যে দেশের শিক্ষানীতির সংস্কার ঘটাতে হবে, সমস্ত গণমাধ্যমগুলিকে এই প্রকৃত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার কাজে ব্যবহার করতে হবে৷ অবশ্যই তদানুসারে দেশের প্রশাসনকেও উদ্যোগী হতে হবে৷