প্রভাতী

বেগুণ গাছও বিরিক্ষি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘‘যত্র বিদ্বজনো নাস্তি শ্লাঘ্যস্তত্রাল্পধীরপ্৷

নিরস্তে পাদপে দেশে এরণ্ডহপি দ্রুমায়তে৷৷’’

যেখানে সত্যিকারের বিদ্বান নেই সেখানে অল্পজ্ঞ ব্যষ্টিও শ্লাঘ্য অর্থাৎ বরণীয় রূপে গণ্য হন৷ যেমন যে দেশে বৃক্ষ নেই সে দেশে এরণ্ড (রেড়ির গাছ) বৃক্ষরূপে সম্বোধিত হয়ে থাকে৷ ওপরের কথাটির কী জুৎসই বাংলা হবে একদিন আমি তা ভাবছিলুম৷ ভাবতে ভাবতে চলেছি হুগলী জেলার বেলুন গ্রামের পাশ দিয়ে৷ সবে সন্ধ্যে হয়েছে৷ হঠাৎ দেখি দীর্ঘকায় দুই নারী নাকি সুরে চিৎকার করছে---একজনের হাতে আঁশবটি৷ অন্যের হাতে মুড়ো ঝাঁটা৷ তাদের নাকি সুরে বুঝলুম তারা মানবী নয়---পেত্নী৷ কথা শুণে মনে হ’ল তারা দুই জা৷

ছোট জা বলছে আমার সোঁয়ামীর মাস যেঁতে আয় তিন হাজার টাকা৷ আর ভাঁসুর ঠাঁকুরের মাত্তর দু হাজার টাকা৷ অথচ একবেঁলা আঁমাকে রান্না ঘরে বসে কাঁঠের উনুনে তাঁত সঁইতে হয়৷ তাঁ আঁমি কেঁন কঁরব? আঁমি আঁর হেঁসেল ঠেলতে পাঁরব না৷ ওঁই সঁময়টা হঁয় সিনেমা দেঁখতে যাঁব না হঁয় কোন শ্যাঁওড়া গাঁছে চঁড়ে খানিকটা হাঁওয়া খেয়ে আসব৷ তোঁর সোঁয়ামির আঁয় কঁম৷ তুই দু’বেলা হাঁড়ি ঠেঁলবি৷

বড় জা বলছে---‘কঁথায় বঁলে, যেঁখানে বড় গাঁছ নেই সেখানে বেঁগুণ গাঁছ ও বিরিক্ষি৷ (কথাটা আমি সঙ্গে সঙ্গে নোট বুকে টুকে নিলুম৷ বুঝলুম---এইটাই ‘এরণ্ডহপি দ্রুমায়তে’ কথাটার জুৎসই বাংলা)৷ তুঁই হাঁ-ঘরে হাঁ-ভাতে ছোঁট ঘঁরের মেঁয়ে---বাঁপের জঁন্মে এঁকসঙ্গে তিঁন হাঁজার টাঁকা দেঁখিসনি৷ এঁখানে এঁসে তাঁই দেঁখে ধঁরাকে সঁরা জ্ঞাঁন কঁরছিস৷ আঁজ থেঁকে আঁর পেঁত্নী বঁলে পঁরিচয় দিঁয়ে লোঁক হাঁসাসনি৷ তঁবুও যঁদি তিঁন হাঁজার টাঁকা সঁত্যিকারের আঁয় হোঁত! মাঁইনে তোঁ পাঁয় এঁক হাঁজার টাঁকা আঁর বাঁকীটা পাঁয় চোঁরাবাজারে হাঁসপাতালেঁর চাঁদর, তোঁয়ালে, ওঁষুধ, ফিঁনাইল বাঁইরে পাঁচার করে’৷ আঁজ তোঁর তিঁন হাঁজার টাঁকার শ্রাঁদ্ধ কঁরছি৷ এঁইসব চুঁরি আঁর পঁাঁচারের কঁথা টিঁকটিঁকি বাঁবুদের (ডিটেক্‌টিব্‌ মানে ইনটেলিজেন্স৷ ডিটেকটিব শব্দ থেকেই টিকটিকি শব্দ এসেছে) বঁলে দোঁবে৷ তাঁরা গঁলায় গাঁমছা বেঁধে তোঁর মুঁখপোড়া সোঁয়ামীকে জেঁলে ঠেঁলে দেঁবে’৷

পেত্নীর ছোট জা তখন বললে---‘তোঁর যাঁ ইঁচ্ছে কঁরগেঁ যাঁ৷ আঁমি আঁশ বঁটি দিঁয়ে টিকটিকির ন্যাঁজ কেঁটে দোঁব৷ আঁমার সোঁনার চাঁদ বাঁছাটা এঁকদিনও মাঁছের মুঁড়ো চোঁখে দেঁখতে পাঁয় নাঁ, আঁর তোঁর ভুঁতুম পেঁচা উনুন মুঁখোটা রোঁজ রোঁজ রুঁই মাঁছের মুঁড়ো চিঁবোচ্ছে৷ এঁ আঁর আঁমার সঁহ্য হঁয় নাঁ৷ নাঁরায়ণ! আঁজই এঁর এঁকটা হেঁস্তনেস্ত কঁরে দাঁও৷’

পেত্নী দু’জন এতক্ষণ দেখতে পায়নি৷ আমি আরও কাছে আসায় আমার জুতোর শব্দে তাদের হুঁশ হলো৷ তারা আমার দিকে তাকিয়ে দেখে তাদের দশ হাত লম্বা জিভ দাঁতে করে কেটে তাদের লজ্জানুভুতি জানাল৷ আমি বললুম---‘অত বেশী দাঁতে চাপ দিসনি৷ জিভ কেটে খসে যাবে৷ তখন ঝগড়া করা জন্মের মত বন্ধ হয়ে যাবে---বোবা হয়ে যাবি’৷ তখন তারা জিভ ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে মাথায় প্রকাণ্ড ঘোমটা টেনে দিল৷ ঘোমটা এত লম্বা করে টানলে যে ঘোমটার জেরে পিঠ হয়ে গেল একেবারে ফাঁকা গড়ের মাঠ৷

আমি আবার বললুম---তোদের এত লজ্জার কি আছে রে! এত লম্বা ঘোমটা টানলে যে দেখতে পাবি না৷’

তারা তখন ঘোমটা সরিয়ে ফেললে আর বললে---‘পেত্নী হঁলেও আঁমরা তোঁ মাঁনুষ---আঁমরাও তোঁ তোঁমার মেঁয়ে৷ তাঁই ঘোঁমটা আঁর দিঁলুম নাঁ’৷

আমি বললুম---‘পিঠটা বরং ভালো করে ঢাক৷ শীত কম লাগবে৷

আমি বললুম---‘এই ভর সন্ধ্যেয় তোরা ঝগড়াঝাঁটি করছিস, তোদের বাড়ীর পুরুষ মানুষেরা গেল কোথায়’?

ওরা বললে---‘আঁমরা যঁখন ঝঁগড়াঝাঁটি কঁরি তঁখন ওঁরা এঁকটু তঁফাতে থাঁকে, ধাঁরে কাঁছে আঁসে না৷ লঁড়াই থেঁমে যাঁওয়ার পঁর তাঁরা লাঁঠিসোঁটা নিঁয়ে ইঁউনিফরম্‌ পঁড়ে আঁমাদের কাঁছে এঁসে হঁম্বিতঁম্বি কঁরে বঁলে---আঁগে খঁবর কাঁহে নেঁহি দিঁয়া হ্যাঁয়? ক্যাঁ হুঁয়া? সেঁই জঁন্যেই তুঁমি বাঁড়ির পুঁরুষদের কাঁউকেই দেঁখতেও পঁচ্ছো না’৷ আমি বললুম---‘অনেকক্ষর ধরে চিৎকার করে তোদের গলা শুকিয়ে গেছে৷ খানিকক্ষণ গাছে চড়ে একটু জিরিয়ে নে৷’

ওরা দুজনেই সামনে তালগাছটাতে তরতরিয়ে উঠতে গেল৷ আমি বললুম---‘‘দুজনেই একটা তালগাছে উঠিসনি৷ তাহলে গাছে উঠে ধস্তাধস্তি করে ধাক্কাধাক্কি করে দুজনেই নীচে পড়ে হাড়গোড় ভেঙ্গে প্রাণ হারাবি৷ মানুষ ছিলি---একবার ম’রে পেত্নী হয়েছিস আর একবার যদি মরিস তোদের কী গতি হবে আমি ভেবে কুল-কিনারা পাচ্ছি না৷

তাই শান্তিতে যদি জিরিয়ে নিতে চাস তবে তোরা দুজনেই দুটো আলাদা আলাদা গাছে উঠে বস’৷ ওরা তখন দুটো আলাদা গাছে উঠে বসল৷ আমার জরুরী কাজ ছিল৷ ট্রেন ধরবার জন্যে তাড়াতাড়ি পাণ্ডুয়া স্টেশনের দিকে চলে চলেছি৷ পথ চলতে চলতে অনেক দূর থেকে কাণে ভেসে আসছিল তালগাছের ওপর থেকে পেত্নী গাওয়া রাশব রাগীনিতে ‘ফিল্মী গানেঁ’

যাইহোক, শিখলুম নোতুন কথা ঃ যেখানে বড় গাছ নেই সেখানে বেগুণ গাছও বিরিক্ষি৷

রবীন্দ্রনাথের এপ্রিল ফুল

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

 অক্ষয় চৌধুরি ছিলেন একাধারে এম এ, বি এল, আ্যাটর্নি এবং কবি৷ তখনকার দিনে সে এক বিরাট ব্যাপার৷ তাঁর বিখ্যাত কাব্য--- ‘উদাসিনী’৷

কবি অক্ষয় চৌধুরির বাড়িতে বোম্বে থেকে বেড়াতে এলেন এক পারসী যুবক৷ সঙ্গে এলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷ পারসী যুবকের মাথায় বিরাট পাগড়ী, গালে পেল্লাই দাড়ি৷ তবে যুবক অত্যন্ত কাব্যরসিক ৷

অক্ষয় চৌধুরি মনের মত লোক পেয়ে তাঁর সঙ্গে জুড়ে দিলেন কাব্যালোচনা৷ চুরুটে টান দিতে দিতে ডুবে গেলেন বায়রন শেলির মধ্যে৷ পারসী যুবক কোন কিছুতেই কমতি নন৷

এমন সময়, অতর্কিতে ঘরে এসে ঢুকলেন পালিত মশাই তারক পালিত৷ কাব্য-চর্চা গেল থেমে৷ পালিত মশাই ঘর ঢুকে পারসী যুবককে দেখেই অবাক৷ কিছুক্ষণ আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করার পর হঠাৎ সোল্লাসে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন--- ‘আরে, এযে আমাদের রবি’!

অক্ষয় চৌধুরি তো হতভম্ব! তারপর পালিত মশাই মাথায় একটা থাপ্পড় মারতেই পারসী যুবকের পাগড়ী গেলো খুলে৷ আলগা হয়ে গেলো গোঁফ-দাড়ি৷ তখন অক্ষয় চৌধুরি সবিস্ময়ে দেখলেন, পারসী যুবকের ছদ্মবেশ ভেদ করে যিনি আত্মপ্রকাশ করলেন তিনি আর কেউ নন--- স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! তখন পালিত মশাই অক্ষয় চৌধুরির কানে কানে বললেন, ‘আজ পয়লা এপ্রিল’!

 

যুগের দাবী

লেখক
কেয়া সরকার

ব্যর্থ হবে না যুগের দাবী

এ দাবী চিরকালের---

গড়ব সমাজ নতুন আদর্শে

এ আশা প্রতি পলের---

ভাব জড়তার প্রাচীর ডিঙিয়ে

শত ভেদাভেদের গণ্ডি এড়িয়ে,

বিশ্ব সমাজ করব রচনা

এ আশা প্রতি জনের৷

 

সব বিদ্বেষ, গ্লানি দূর হয়ে,

ভালোবাসা কে পথ করে দেবে---

শুভ বুদ্ধিতে জাগ্রত জনে,

 

আদর্শকে হৃদে ধরে রবে---

ঐক্যের সুধা পান করে যবে,

মানুষ আবার এক হয়ে যাবে ---

প্রাউট স্থাপনে পৃথিবীতে আর,

মানুষের কোনো দ্বিধা নাহি রবে৷

 

নব্যমানবতার কোমল স্পর্শে,

মানুষের যবে চোখ খুলে যাবে---

হৃদয় নিংড়ানো প্রীতি-ভালোবাসায়

মানুষে মানুষে ভেদ ঘুচে যাবে---

বিশ্ব সংসারে মানুষ আবার

মানুষ বলে পরিচিতি পাবে,

সেই দিন এক নোতুন পৃথিবী

মানুষের তরে গড়ে নেওয়া হবে৷

বসন্তোৎসব

লেখক
আচার্য প্রবুদ্ধানন্দ অবধূত

আকাশে আজ রঙের মেলা

কে যেন সব রাঙিযে দিল,

বিশ্ব ভূবন মন মাতান হাসি

কৃষ্ণ মনে দোলা দিলো৷

দোদুল্যমান সৃষ্টির উল্লাসে

কেউ বা কাঁদে কেউ বা হাসে,

মনের কোণে কৃষ্ণ হাসে

সব লীলা খেলা তাঁরই সাজে৷

রাখো তাঁরে হৃদয় ভরে

সিংহাসন তো তাঁরই গড়া,

সকল হৃদয়ে তিনি আছেন

সমর্পিয়া হও আত্মহারা৷

ব্রাউনশোয়ায়েগ, জার্মানী৷

ধরা আর সরা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

দেশজ শব্দে ‘ট’ যথাযথভাবেই বজায় থাকে৷ আর ‘ড’ বা ‘ড়’ মৌলিক শব্দ হিসেবেই থেকে যায়৷ যেমন, আজ ভুলোর সঙ্গে ভোঁদার আড়ি হয়ে গেল৷ ওরা বলছে, ওরা আর একসঙ্গে মার্ৰেল খেলবে না, একটা পেয়ারাও আর কামড়াকামড়ি করে খাবে না৷ গোপনে কান পেতে শোনাকেও আড়িপাতা বলে৷ এটিও বাংলা দেশজ শব্দ৷ সেই যে একজন মহিলা আহ্লাদে আটখানা হয়ে তার এক ৰন্ধুকে বলেছিল–তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তা ভাষায় বলতে পারছি না৷ ৰন্ধু বলেছিল, তোমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তার একটু আভাস আমায় দাও৷ মহিলাটি বলেছিল, আহ্লাদের আতিশয্যে আমার এখন ধরাকে সরা মনে হচ্ছে৷ সেই সময়  হয়েছে কী, একজন চাষীর গোরু হারিয়ে গেছে৷ সে গোরু খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে যে বাড়ির বারান্দায় বসেছে সেই বাড়িরই ঘরের ভেতর ওই মহিলাটি বলছে– আমি আনন্দের আতিশয্যে ধরাকে সরা মনে করছি৷ চাষী আড়ি পেতে কথাটা শুনে নিলে৷ এবার সেও আনন্দের আতিশয্যে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে ঘরের বাইরে থেকে ওই মহিলাটিকে গড় করে বললে–মা লক্ষ্মী, এই বিরাট ধরাটা যখন তোমার কাছে সরা হয়ে গেছে তখন দয়া করে বলে দাও, ওই সরার কোন্খানটিতে আমার গোরুটা রয়েছে৷ বইয়ের নামেই বিপত্তি ঔষধ রোগকে হত্যা করে৷ তাই হত্যাকারী অর্থে ‘থুর্ব’ ধাতু ড করে যে ‘থ’ শব্দ পাই তার একটি যোগরূঢ়ার্থ হচ্ছে ঔষধ৷ এই ঔষধ যে কেবল শারীরিক রোগের ঔষধ তাই নয়, মানসিক রোগের ঔষধও৷ মানসিক রোগের যতরকম ঔষধ আছে তার একটা নাম হচ্ছে মানুষের মনে রসচেতনা জাগিয়ে তার মনকে হালকা করে দিয়ে ব্যথাভার সরিয়ে দেওয়া–চিন্তাক্লিষ্টতা অপনয়ন করা৷ এজন্যে প্রাচীনকালে এক ধরনের মানুষ থাকতেন যাঁরা মানুষের মনকে নানান ভাবে হাসিতে খুশীতে ভরিয়ে রাখতেন৷ মন ভাবে–ভাবনায় আনন্দোচ্ছল হয়ে উপচে পড়ত৷ এই ধরনের মানুষেরা শিক্ষিত বা পণ্ডিত থেকে থাকুন বা না থাকুন এঁরা মানব মনস্তত্ত্বে অবশ্যই পণ্ডিত হতেন৷ এঁদেরই বলা হত বিদুষক৷ বিদুষকের ভাববাচক বিশেষ্য ত্ব্ব্দব্ধব্জ্ত্রন্তুব্ধ প্সব্ভুগ্গ ‘বৈদুষ্য’ শব্দটির সঙ্গে নিশ্চয়ই তোমরা ভালভাবেই পরিচিত৷ ‘‘বাক্ বৈখরী শব্দঝরী শাস্ত্র ব্যাখ্যান কৌশলম্৷ বৈদুষ্যং বিদুষাং তদ্বৎ ভুক্তয়ে ন তু মুক্তয়ে’’৷ বিদুষকের বিদ্যেৰুদ্ধি থাক্ বা না থাক্ তাঁদের মনস্তত্ত্বের জ্ঞান থাকা দরকার, উপস্থিত ৰুদ্ধি ত্মন্দ্ব্ত্রস্তুম্ভ ভ্রন্ব্ধগ্গ থাকা তো চাই–ই৷ তোমরা অনেকেই নিশ্চয় মুর্শিদাবাদের শরৎচন্দ্র পণ্ডিত মহাশয়ের নাম শুনেছ৷ তাঁর মত উচ্চমানের বিদুষক খুব কমই জন্মেছেন৷ সাধারণের মধ্যে ‘দাদাঠাকুর’ নামে পরিচিত এই মানুষটি ‘বিদুষক’ নামে একটি পত্রিকাও ছাপাতেন৷ সেবার ৰহরমপুরে বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে৷ উপস্থিতদের মধ্যে শরৎচন্দ্রপণ্ডিত মহাশয় তো আছেনই, আর ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ তিনি তখন প্রতিষ্ঠার তুঙ্গে৷ তাঁর লেখা ‘চরিত্রহীন’ পুস্তকটির তখন ‘খোলা থেকে নোলা’ গরমাগরম আলুর চপের মতই ৰাজারে ৰেজায়** কাটতি৷ শরৎ চাটুজ্জে নামকরা কথাশিল্পী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু ভাষণ ভাল দিতে পারতেন না.....মজলিসী গল্পগুজবে ছিলেন ওস্তাদ৷ সবাই তাঁকে ধরে বসল–‘‘আপনাকে এখানে কিছু বলতেই হবে৷’’ শরৎ চাটুজ্জে দু’এক মিনিট দায়সারা গোছের কিছু বলে বসে পড়লেন৷ আর বসার আগে বললেন–‘‘আমি আর এখানে ৰেশী কিছু বলব না–বলবেন বিদুষক শরৎচন্দ্র৷’’ শরৎচন্দ্র পণ্ডিত (দাদাঠাকুর) উঠে খানিকক্ষণ বললেন আর বসার আগে বললেন–আমি আর কতটুকু জানি, আমার চেয়ে ঢ়ের ৰেশী জানেন ওই ‘চরিত্রহীন’ শরৎচন্দ্র৷ (* কুলোকর্ণী,কুলোর সংস্কৃত ‘শূর্প’৷ শূর্পঞ্ছশূপ্পঞ্ছশূপ৷ উত্তর ভারতীয় ভাষাগুলিতে কুলোকে ‘শূপ’ বলা হয়৷ যার নখ শূর্প অর্থাৎ কূলোর মত সে শূর্পণখা৷) (** এটি একটি খাঁটি ৰাঙলা শব্দ৷ ফার্সী ৰজহ্’–এর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই৷ ফার্সী ‘ৰজায়’ শব্দের সঙ্গেও এর কোনো সম্পর্ক নেই৷ শব্দটির অবস্থা কতকটা ৰাঙলা শব্দ ‘পিদীম’–এর মত৷ অনেকে ভাবেন এটি ৰোধ হয় সংস্কৃত ‘প্রদীপ’ থেকে এসেছে৷ না, তা নয়৷ এটি একটি খাঁটি ৰাঙলা শব্দ৷ স্থান বিশেষে ‘পিদ্দিম’ ও ‘পিদ্দুম’ রূপেও উচ্চারিত হয়৷)

আজ বসন্ত

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

দখিন হাওয়ায় তালি বাজে

ডালে ডালে,

আকাশ সাজে পলাশফুলের

লালে লালে!

গুনগুনিয়ে গান শুনিয়ে

মৌমাছিরা

ফুলের বনে দলে দলে

দেয় হাজিরা৷

ডানার শিশির রৌদ্রে মোছে

শঙ্খ চিল

নেই কুয়াশা বিষণ্ণ্তার---

আকাশ নীল!

প্রজাপতি ফুল ফোটানোর

খেলায় মাতে

 

নানা রঙের রঙিন পাখার

আলপনাতে!

কুহুতানে মাতোয়ারা

দিগদিগন্ত---

কী আনন্দ কী আনন্দ

আজ বসন্ত!

আলোর পথে

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

তিমির রাতে একাকী পথে

তোমারই আলোক ধারা,

লক্ষ্যের পানে দেখাইলে পথ

হয়েছি শঙ্কা হারা৷

শঙ্কিত মন অন্ধ নয়ন

জড়তার আহ্বানে,

বস্তু জগতে জড়ায়ে ছিলেম

পার্থিব বন্ধনে৷

মানব জীবন দুর্লভ,

কিন্তু উদ্দেশ্যহীন নয়,

সকল বাধা ছিন্ন করিয়া

আশায় জাগে হৃদয়৷

অন্তরে জাগ্রত পরমপিতা

 

সাহস করি সঞ্চয়,

কালের গতিতে মনের সুমতিতে

শুভ বুদ্ধির উদয়৷

উৎস স্থল গন্তব্যস্থল যবে

মিলিত একই বিন্দুতে,

জলকণাগুলি কেন বয়ে যায়

চিরকাল মহাসিন্ধুতে?

কেন অনুমন প্রতি পলে পলে

ভূমায় মিলিতে চায়,

জেনে বা না জেনে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে

তাঁর পানে শুধু ধায়৷

আপনার হতে তুমি আপনার

এসেছ গহন রাতে,

জ্বালিলে প্রাণের প্রদীপ

অনন্ত আলোর স্রোতে৷

নিরন্তর এই যাত্রাপথে

ক্রমে কমে ব্যবধান,

তোমাতেই হব চির সমাহিত

হারায়ে মন প্রাণ অভিমান!

 

নুকাইঁ নুকাইঁ

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

তৃতীয় ধরনের কপটাচরণও আমরা কম দেখি না৷ শুনেছিলুম, আমেরিকায় এক ভদ্রলোক একটি প্রচণ্ড রকমের মদ্যপান–বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন৷ এক জনসভায় মদের অপকারিতা সম্বন্ধে তিনি ওজস্বিনী ভাষায় ঠায় এক ঘণ্টা বত্তৃণতা করেছিলেন৷ তারপর বললেন–উঃ, উঃ গলা শুকিয়ে গেছে, এক গ্লাস ব্র্যাণ্ডি দাও৷       

* * * * * * * *

সেবার আমি সাহেৰগঞ্জ থেকে দুমকা যাচ্ছি৷ সুদীর্ঘ পথ৷ সাহেৰগঞ্জ শহর পার হবার পরই শুরু হল পাহাড় আর জঙ্গল৷ পশ্চিম রাঢ়ের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি রমণীয়৷ ইচ্ছে হ’ল, এই পাহাড়–জঙ্গলের মধ্য দিয়ে মাইল খানেক পায়ে হাঁটি৷ গাড়ি থেকে নেৰে পড়লুম..........হাঁটতে শুরু করলুম৷ কিছু দূর যাবার পর দেখছি, পায়ে নতুন জুতো–পরা সাত–আট বছরের একটি ন্যাংটো ছেলে কঞ্চি দিয়ে মাঠের একটি গর্ত্তের মধ্যে খোঁচা দিচ্ছে৷ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলুম–তুর নাম কী বটেক

সে বললে–রামকৃষ্ণ তুরী বটেক গো৷

আমি বললুম– কী করছিস বটেক

ছেলেটি বললে–ইন্দুর ধরছি৷

আমি জিজ্ঞেস করলুম–ইন্দুর লিয়ে কী করবি

সে বললে–পুড়াই খাব৷

আমি জিজ্ঞেস করলুম–ব্রাহ্মণ–কায়স্থরাও খায়

সে বললে–হঁ, উয়ারা নুকাইঁ নুকাইঁ খায়৷

এই ‘নুকাইঁ নুকাইঁ খাওয়া’ লোকের সামনে নিজের ত্রুটি ঢ়াকার অপচেষ্টা৷ এটাও এক ধরনের কপটতা৷

ধরা আর সরা

দেশজ শব্দে ‘ট’ যথাযথভাবেই বজায় থাকে৷ আর ‘ড’ বা ‘ড়’ মৌলিক শব্দ হিসেবেই থেকে যায়৷ যেমন, আজ ভুলোর সঙ্গে ভোঁদার আড়ি হয়ে গেল৷ ওরা বলছে, ওরা আর একসঙ্গে মার্ৰেল খেলবে না, একটা পেয়ারাও আর কামড়াকামড়ি করে খাবে না৷ গোপনে কান পেতে শোনাকেও আড়িপাতা বলে৷ এটিও বাংলা দেশজ শব্দ৷

সেই যে একজন মহিলা আহ্লাদে আটখানা হয়ে তার এক ৰন্ধুকে বলেছিল–তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তা ভাষায় বলতে পারছি না৷ ৰন্ধু বলেছিল, তোমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তার একটু আভাস আমায় দাও৷ মহিলাটি বলেছিল, আহ্লাদের আতিশয্যে আমার এখন ধরাকে সরা মনে হচ্ছে৷ সেই সময় হয়েছে কী, একজন চাষীর গোরু হারিয়ে গেছে৷ সে গোরু খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে যে বাড়ির বারান্দায় বসেছে সেই বাড়িরই ঘরের ভেতর ওই মহিলাটি বলছে– আমি আনন্দের আতিশয্যে ধরাকে সরা মনে করছি৷ চাষী আড়ি পেতে কথাটা শুনে নিলে৷ এবার সেও আনন্দের আতিশয্যে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে ঘরের বাইরে থেকে ওই মহিলাটিকে গড় করে বললে–মা লক্ষ্মী, এই বিরাট ধরাটা যখন তোমার কাছে সরা হয়ে গেছে তখন দয়া করে বলে দাও, ওই সরার কোন্খানটিতে আমার গোরুটা রয়েছে৷

শিবরাত্রির কথা

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

বারাণসীতে এক ব্যাধ ছিল৷ বনে পশু শিকার করাই ছিল তার জীবিকা৷ একদিন একটা হরিণ শিকার করতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল৷ হরিণের পেছনে ধাওয়া করতে করতে সে বনের অনেক গভীরে ঢুকে পড়েছিল৷ ফলে বন থেকে ফিরতে সেদিন তার সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়ে গিয়েছিল৷ সেই বনে ছিল বাঘের উপদ্রব৷ বাঘের ভয়ে ব্যাধ তখন একটি উঁচু বেল গাছের ওপর আশ্রয় নিল৷ রাতটা শেষ হলেই সে বাড়ি ফিরে যাবে৷

সেদিন ব্যাধ অনেক পশু শিকার করেছিল৷ তাই সে বড় ক্লান্ত ছিল৷ রাত গভীর হতেই গাছের ওপর সে ঘুমিয়ে পড়লো৷ সেই গাছের নীচে ছিল শিবলিঙ্গ৷ রাত্তিরে ব্যধ যখন ঘুমোচ্ছিল তখন তার গা থেকে এক ফোঁটা ঘাম শিবলিঙ্গে পড়লো৷ সেদিনটা ছিল শিবরাত্রির দিন৷ আর ব্যধও ছিল সারাদিন উপবাসী৷ মহাদেব ব্যাধের একফোঁটা ঘামেই সন্তুষ্ট হন৷ অজান্তেই ব্যাধ শিবের বরে হয়ে গেল মহাপুণ্যবান৷ তাই যথা সময়ে ব্যাধের মৃত্যুর পর যখন যমদূত এসে তাকে নরকে নিয়ে যেতে চাইল, তখন শিবদূত এসে তাকে বাধা ছিল৷ শিবদূত ব্যধকে নিয়ে গেল শিবলোকে অর্থাৎ কৈলাসে৷

এই আদিম মিথোলজি তথা লোকপুরাণের কাহিনীই শিবরাত্রির ব্রতকথায় রূপান্তরিত হয়েছে৷ এই সব ব্রতকথাকে বলা হয় অলিখিত সাহিত্য৷ এককালে মুখে মুখেই এইসব অলিখিত সাহিত্য আমাদের মা-বোনেদের মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছে৷ ভিন্ন ভিন্ন মুখে একই কাহিনীর রূপান্তর ঘটাও তাই অস্বাভাবিক কিছু নয়৷

যেমন, এই কাহিনীতেই অনেকে বলেন, বেল গাছে যখন ব্যাধ ঘুমিয়েছিল তার নড়াচড়াতে কিছু বেলপাতা খসে গাছের নীচে শিবরূপী পাথরের ওপর পড়েছিল৷ আর পড়েছিল কয়েক ফোঁটা শিশির৷ শিব ভাবলেন, ব্যাধ বুঝি বেলপাতা আর জল ঢেলে পুজো করছে৷ তাই শিব সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিলেন৷

ফাল্গুনী কৃষ্ণা চতুর্দশীতে শিশিরের চাইতে ক্লান্ত ব্যাধের ঘাম ঝরাটাই বেশি বাস্তবসম্মত নয় কি?

দেবকুলে সবচেয়ে জনপ্রিয় দেবতা হলেন শিব৷ বৈষ্ণবধর্ম প্রভাবিত কিছু অঞ্চল বাদ দিলে বাংলার প্রায় সর্বত্রই শিবের রাজত্ব৷ শিব নানা সময়ে নানারূপে পূজিত হন৷ ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে কুমারী মেয়েরা শিবরাত্রি পালন করে৷ ‘‘ক্ষ্যাপার চৌদ্দ ক্ষ্যাপীর আট৷ এ নিয়েই কাল কাট৷’’ ক্ষ্যাপা হচ্ছে শিব, চৌদ্দ অর্থাৎ ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী (শিবরাত্রি)৷ মেয়েরা সেদিন উপোস করে শিবের মাথায় দুধ বা জল ঢালে৷ ওইদিন মেয়েদের রাত জাগতে হয়৷ শিবরাত্রির উদ্যোক্তা মূলত কুমারী মেয়েরা হলেও পুরুষ, বিধবা ও সধবারাও শিবরাত্রি পালন করেন৷

কুমারী মেয়েদের শিবরাত্রি পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য শিবের মতো বরপাওয়া৷ এটাই প্রচলিত ধারণা৷ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের কথায় বলি---‘বিবাহ’ শব্দটির শাব্দিক অর্থ দাঁড়াচ্ছে, বিশেষ এক ধরণের দায়িত্ব নিয়ে নোতুনভাবে জীবনধারাকে প্রবাহিত করা৷...শিব এই দায়িত্ব নিয়েই বিবাহ করেছিলেন৷ তাই আমরা নির্দ্ধিধায় বলতে পারি এই বিশ্বের প্রথম বিবাহ শিবই করেছিলেন৷ (নারীর মর্যাদা)... এই বিশ্বে শিবই ছিলেন প্রথম বিবাহিত পুরুষ৷ তাঁর আগে কোন বিবাহিত পুরুষ ছিল না৷ তাই কোন পুরুষই পারিবারিক দায়িত্ব বলতে যা বোঝায় তা বড় একটা নিত না৷ হয়তো বা পশুদের মতই খুব অল্পসল্প দায়িত্ব নিত৷’’ (নমঃ শিবায় শান্তায়-শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি)৷ তাই আনন্দমূর্ত্তিজী একথাও বলেছেন শিবই প্রথম বিবাহের মধ্যে দিয়ে নারী জাতিকে সংসারে সমাজে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন৷ তাই প্রত্যেক নারীরই উচিত শিবের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা৷

বৃহদাষেণা

লেখক
আচার্য গুরুদত্তানন্দ অবধূত

আমরা দেবশিশু,

বসুধা জননীর কোলে লালিত,

হাতে হাত ধরে চলেছি পথ,

বৃহদভাবে হয়েছি ভাবিত,

ছন্দিত জীবনে এল প্লাবন,

হর্ষ আহ্লাদ ঘিরে চারিধার,

জেগেছে স্পন্দন দেহ মনে

ক্ষণে ক্ষণে শুনছি কিবা ধবনি

যেন হাতছানিতে কেহ ডাকছে

মেতেছে মন অনাবিল আনন্দে...!

মহতি প্রয়াসে হয়েছি ধন্য

ক্ষুদ্রত্ব গেছে সব সরে,

দুঃখ বেদন যেন নাহি আর

চারিধারে আনন্দ পারাবার,

কাণ্ডারী হয়েছে নিজে দ্বারি

শরণাগত মোরা তাঁরই৷

আহা মরি কী আনন্দ!...

এত সুখ রাখি কোথা বলো,

দিই বিলায়ে সব আপন জনে,

মথিত হৃদয় আসে ছুটি

দিতে আর নিতে মিলাতে মিলিতে

আপনার সবে মানি!