মানুষ! মানুষ ! হারায়ে হঁশ কোথায় চলেছ তুমি?

লেখক
প্রফুল্ল কুমার মাহাত

একথা বলেছেন তারকব্রহ্ম, মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী৷ তিনি  মানুষকে চরম হুঁশিয়ারী দিয়ে,আসন্ন মহাসঙ্কটের সাবধান বাণী শুনিয়ে  মহান পরিত্রাতারূপে প্রভাত সঙ্গীতের বজ্রগম্ভীর সুরে তার স্বরে দৃপ্তকন্ঠে একথা বলেছেন৷ বর্তমান মানব সমাজের অধিকাংশ মানুষের  চলার বিসদৃশ গতিবিধি দেখে যার পর নাই অসন্তুষ্ট, ক্ষুদ্ধ, রুষ্ট হয়ে বাধ্য হয়ে এহেন দৈববাণী শুনিয়েছেন৷

হ্যাঁ, আমরা মানুষ হয়ে চলে চলেছি তো নিশ্চয়ই প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে৷ চলমান এ জগতে সবাই সবকিছুই চলে চলেছে কেউ স্থির নয়,  কিছুই স্থির, স্থবির হয়ে থাকতে পারবে তো দেখি, চন্দ্র, সূর্য নক্ষত্র, নিহারিকা,গ্রহ উপগ্রহ বাতাস এমনকি সব জৈব অজৈব সব সত্তাই প্রতিনিয়ত চলে চলেছে সবাই চলে চলেছে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে, পরম স্রষ্টার দুর্বার আকর্ষণে৷ গম্ ধাতুর উত্তর ক্বিপ্ প্রত্যয় যোগে জগৎ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়৷ যার অর্থ এগিয়ে চলাই যার স্বভাব৷ মানুষের লক্ষ লক্ষ জন্ম মৃত্যুর গন্ডী অতিক্রম করে সংঘর্ষ ও সমিতির ধারা বেয়ে, পরম পুরুষের কৃপায়, প্রকৃতির পরিচালনায় মানব শরীর পেয়েছি৷ পরমস্রষ্টা অশেষ কৃপা করে, অনেক আশা নিয়ে , বিশ্বাস রেখে মানুষ কে উন্নত সুন্দর শরীর, সমুন্নত মন, বুদ্ধি মস্তিস্ক, চেতনা, অশেষ গুন ও দায়িত্ব ও কর্তব্য দিয়েছেন সামনের দিকে পরমলক্ষ্যের পানে এগিয়ে চলার জন্য৷ কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়--- এই দুর্লভ মানব শরীর, মানবজীবন পেয়েও আমরা আমাদের হুঁস, সম্বিত হারিয়ে  ফেলেছি৷ আমাদের অধিকাংশই চলছি  উন্মত্ত, উন্মার্গগামীর  মত লক্ষ্যহীন ভাবে নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্য দিয়ে, অন্ধের মত দিশাহীন হয়ে৷ এভাবে চললে যে,মৃত্যু ধবংস  অনিবার্য--- এই হুশ পর্যন্ত আমাদের নেই৷ কিন্তু পরমস্রষ্টা পরমপুরুষ তো আমাদের  সামনে  চলার জন্য চলৎশক্তি সম্পন্ন পা দিয়েছেন, দিয়েছেন বুদ্ধি, বোধি , বিবেক জ্ঞানচক্ষু দিয়েছেন ৷ তৎসত্ত্বেও  আমরা যদি অন্ধের মত অন্ধকারে পথ হাতড়িয়ে চলি তাহলে সে দোষ আমাদের৷ মানুষ আজ  শারীরিক তথা আধিভৌতিক, অর্থাৎ মানসিক তথা আধিদৈবিক এবং আধ্যাত্মিক---ত্রিস্তরেই অন্ধের মত আচরণ করে নিজের পতন, অধঃপতন ও ধবংসের পথ প্রশস্ত করছে৷ প্রচলিত প্রবাদবাক্যে একথাই জানা যায়---‘‘জীব যদি মরে আপন দোষে কী করবে হরিহর দাসে’’৷ মহান দার্শনিক ও ধর্মগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী একথাই বলেছেন, ‘‘যে মানুষ ওপরে ওঠার সাধনা করে না, এমনটা নয় যে সে যেখানে ছিল সেখানেই থেকে যাবে সে নীচে নেবে যাবেই কারণ তাকে চলতে হবে৷ ওপরের দিকে যদি না যায় তবে তাকে নীচের দিকে নাবতে হবে৷ যে মানুষ সাধনা করে না, মানসিক মর্যাদাতে প্রতিষ্ঠিত  হওয়ার চেষ্টা করে না, তার অধঃপতন অনিবার্য৷’’

এ প্রসঙ্গে যুগবতার মহান দার্শনিক শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী, (যিনি মহান সমাজ সংস্কারক রূপে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার) বলেছেন--- মানুষের  শরীর পাওয়াটাই মানুষের পরিচয় বহন করে না৷ তার আচার আচরণ, কার্যকলাপ, দায়িত্বজ্ঞান, কর্ত্তব্যবোধ ধর্মাচরন মানুষকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে৷ বৃত্তি ও প্রবৃত্তি তাড়িত না হয়ে তার মৌলিক বিচারবুদ্ধি, বিবেক, যুক্তিবাদ সর্বাত্মক সংযম দ্বারা পরিচালিত হলে তবেই মানুষ মনুষ্যত্বের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়৷   শাস্ত্রে বলা হয়েছে,--- ‘‘আহার নিদ্রা ভয় মৈথুনঞ্চ সামান্যমেতদ্ পশুভি, নরামাম্৷ ধর্ম হিতেষাং অধিক বিশেষং ধর্মেন হীনা, নরা পশুভিঃ সমানাঃ৷ বলা হয়েছে, আহার করা, ঘুমানো ভয় পাওয়া ও বংশবিস্তার করা পশু ও মানুষের  সাধারণ  বৈশিষ্ট্য৷ কিন্তু মানুষের অতিরিক্ত বিশেষ, বৈশিষ্ট্য বা স্বধর্ম রয়েছে৷ এই স্বধর্মটা হচ্ছে--- মানবধর্ম বা ভাগবত ধর্ম৷ এই স্বধর্ম, মানবধর্ম ও ভাগবতধর্ম আচরণ ও অনুশীলন ছাড়া  মানুষ নিজেকে মানুষরূপে পরিচয় দিতে বা পরিগণিত হতে পারে না৷ তাই আনন্দমার্গের শ্লোগান হচ্ছে ‘‘ধর্মবিহীন মানবজীবন, পশুর চেয়ে অধম জীবন৷’’ ‘‘সাধনা বিহীন মানবজীবন পশুর চেয়ে অধম জীবন৷’’

কিন্তু বর্তমান বিশ্বে  মানব সমাজে সব দেশেই অধিকাংশ মানুষ তার স্বধর্ম অর্র্থৎ মানবধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে সমগ্র মানব সমাজকে ধবংসের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে৷ এহেন পরিস্থিতিতে মহান দার্শনিক ও মহান ধর্মগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী প্রভাত সঙ্গীতের মাধ্যমে মানবজাতিকে সাবধান বাণী শুনিয়ে সতর্ক করতে বলেছেন৷

‘‘ মানুষ৷ মানুষ৷ হারায়ে হঁুস কোথায় চলেছ তুমি?

আকাশ বাতাস বিষিয়ে দিয়ে নরক করে মর্ত্তভূমি?’’

সেই সঙ্গে তিনি মানুষকে আশ্বাস দিয়ে, আশারবাণী শুনিয়ে সামনের দিকে চলার আবহ সঙ্গীত প্রভাত সঙ্গীতে দিয়েছেন৷

 তিনি বলেছেন,---

‘‘চল্ চল্ চল্, গান গেয়ে চল,

আশার আলোক শিখা অতি উজ্জ্বল৷

অবনীকে করে তুলি মুক্তাঞ্চল৷

যত ভাষা যত মত, বহিয়াছে যত পথ,

সবারে শ্রদ্ধা মোরা করি অবিচল৷

পাপের শত্রু মোরা ভালোদের বল

বাঁচাই তাদের মোরা যারা দুর্বল৷৷’’

বিশ্বকবি  রবীন্দ্রনাথ ও মানব সমাজের এই পতনোন্মুখ দুরবস্থা দেখে মর্মাহত হয়ে সেই ভয়াবহ চিত্র বর্ণনা করে বলেছেন,---‘‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস৷ শান্তির ললিতবাণী শুনাইছে ব্যর্থ--- পরিহাস৷ তাই বিদায় নেবার আগে  ডাক দিয়ে যায় সংগ্রামের তরে প্রস্তুত হতেছে যারা ঘরে ঘরে৷’’

রবীন্দ্রনাথ ভগবানের কাছে অভিযোগ দায়ের করে বলেছেন,

‘‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো,

তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি তাদের বেসেছ ভালো৷’’

 তিনি এহেন দুঃসহ পরিস্থিতির প্রতিবিধানের জন্য বিশ্ব স্রষ্টা বিশ্বপিতার  কাছে আবেদন করে, বলেছেন---

‘‘নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি পিত মানুষেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত৷’’ বৈষ্ণব কবি মানুষকে সচেতন করার নিমিত্ত স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘‘কৃষ্ণ ভজিবার তরে সংসারে আইনু মিছে মায়ায় বদ্ধ হয়ে বৃক্ষসম হইনু৷’’ বাউল কবি ও মানুষের হুঁস জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে গেয়েছেন,’’ মানুষ হইয়া জনম লইয়া মানুষের করিলাম কী? গুরু না ভজিলাম, কী ভুল করিলাম ভস্মে ঢালিলাম ঘি৷’’

যাইহোক, মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী মানুষের এগিয়ে চলার পথ দেখিয়েছেন, পাথেয় দিয়েছেন, পথ নির্দেশনা দিয়েছেন চলার পথটিকে আলোকোজ্জ্বল করে দিয়েছেন৷ সুতরাং সে পথ ধরে চলা প্রতিটি মানুষের অবশ্য করণীয়৷ তিনি  বলেছেন, ‘‘তা মানুষ যখন এগিয়ে  যেতে থাকে, মানুষের পরিচিতি সে বহন করতে প্রস্তুত হয়ে যায়, তখন তাকে একসঙ্গে  আধিভৌতিক,  আধিদৈবিক  আধ্যাত্মিক --- তিনভূমিতেই এগিয়ে যেতে হয়৷ এই ত্রিধা যে ভূমি--- এতে একের সঙ্গে অন্যের খুব নিকট সম্পর্ক, অত্যন্ত নিকট সম্পর্ক রেখে চলতে হয়, কারণ অন্ন, বস্ত্র,শিক্ষা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে গিয়ে যেন মানুষের উন্নততর মূল্য বা ইনটেলেকচুয়েল মূল্যবোধ  ভুলে না যায়৷ মানুষের  ফিজিক্যাল স্টেটাস সবচেয়ে বড় নয়৷ তার চেয়ে বড়--- ইনটেলেকচুয়েল স্টেটাস, তার চেয়ে বড় স্পিরিচুয়াল স্টেটাস৷ তাই তিনটেকে যদি মানিয়ে নিয়ে সামঞ্জস্য করে তুলতে না পারি তাহ’লে জীবন আহার নিদ্রা সর্বস্র হয়ে যায়৷ সেটা তো পশুর জীবন৷ পশু কেবল খাবার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে৷

আবার মানুষ যদি অন্ন বস্ত্রের সঙ্গে  সঙ্গে মানসিক উন্নতির চেষ্টা করতে থাকে৷ তাতে তার বৌদ্ধিক  বিকাশ ঘটছে ঠিকই, কিন্তু  সেই বৌদ্ধিক বিকাশের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকছে না৷ সেই উন্নতবুদ্ধি মানুষ শয়তানে রূপান্তরিত তো হতে পারে৷ যার অর্থবল আছে, আর যার বুদ্ধিবলও যথেষ্ট আছে,কিন্তু আধ্যাত্মিক বল নেই সে মানুষ তো শয়তানে পরিণত হতেই পারে৷ সে আরো বড় শয়তান হয়ে যাবে কারণ তার  বুদ্ধিও আছে, অর্থও আছে৷ তা সে রকম শয়তানের হাত থেকে সমাজকে বাঁচিয়ে চলতে হবে ও সমাজে যাতে সে ধরনের শয়তান তৈরী না হয়, সেই জন্য  গোড়ার থেকে, শেষ অবধি, মানুষের সূতিকাগৃহ থেকে শ্মশান পর্যন্ত ধার্মিকতা থাকতেই হবে৷ অর্থাৎ সূতিকাগৃহে  যে পরমব্রহ্মের নাম সে শুনেছিল৷ মৃত্যুকালে ও তার নাম শুনতে শুনতে যাবে৷ তাহলে হবে কী? না তার জীবনটা হয়ে যাবে বিরাট সাধনা৷’’..(ক্রমশঃ)