নব তালিবানি উত্থান ঃ কী বলছে বিশ্ব বিবেক!

লেখক
সুকুমার সরকার

এ কোন্‌ তৃতীয় বিশ্বে বাস করছি আমরা? প্রায় মধ্যযুগীয় কায়দায় আফগানিস্তান নামক একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দখল করে নিল তালিবান নামক এক জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী৷ রাষ্ট্রসংঘ সহ সমগ্র আন্তর্জাতিক বিশ্ব নিজের নিজের দেশে বসে আত্মসমীক্ষা ছাড়া কিছুই করছে না৷ সেদেশের নির্বাচিত রাষ্ট্র প্রধান প্রায় দস্তখৎ লিখে দেবার মতো তালিবানদের হাতে সাধারণ মানুষের ভাগ্য ছেড়ে দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন৷ পালানোর সময় ট্রাকভর্তি টাকা নিয়ে পালিয়েছেন৷ এতেই বোঝা যায়, তাঁর পালানো ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা৷ অর্থাৎ বিগত কুড়ি বছর ধরে বন্ধুক হাতে মেরুদণ্ডহীন এই ধরণের আফগান সরকারদের যাঁরা পাহারা দিয়েছেন তারা আসলে এই সব সরকারদের অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়ে  নিজেদের দেশের জন্য ফায়দা লুটেছেন৷ সে ফায়দা আমেরিকার কাছে কী ছিল তা সময়ের নিরীক্ষা বলবে৷ কিন্তু আমেরিকা যে মুহূর্তে থেকে সরে যেতে শুরু করলো, সেই মুহূর্ত থেকে তালিবানদের এই নব উত্থানের পিছনে আমেরিকারই অঙ্গুলি হেলন নেই- তো? নইলে বিগত বিশ বছর আমেরিকা আফগান প্রশাসনের জন্য একটি মজবুত  সামরিক বাহিনী তৈরী করল না কেন, যারা আফগানিস্তানে যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারত? আসলে এটা হয়তো আমেরিকাই একটি চাল৷

আমেরিকা কোনোদিনই চায় না কোনো রাষ্ট্র মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর শক্তি নিজেরা অর্জন করুক৷  আমেরিকা চরম একটি পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র৷ যাদের রাষ্ট্রীয়  পলিসি সর্বদা পুঁজিকেন্দ্রিত৷ তাদের যে কোনো বিনিয়োগ বিনিময়ের ওপর নির্ভর করে৷ তা সে অর্থ বিনিয়োগই হোক অথবা সামরিক বিনিয়োগই হোক৷ মধ্যযুগীয় বা অষ্টাদশ শতাব্দীর দেশ দখলের  সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা এখন আর ধনী দেশগুলোর  নেই৷ ধনীদেশগুলোর লক্ষ্য এখন বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ৷ অর্থাৎ লাভের বিনিময়৷ লাভ না হলে ছেড়ে দাও৷ লাভ নেই বলে অপরাপর ধনী দেশগুলিও নিশ্চুপ৷ আর বর্তমানের জাতিসংঘ তো পুঁজিবাদীদের নপুংসক সন্তান৷ সুতরাং কোনো একটি রাষ্ট্র অন্যায়ভাবে কোনো একটি রাষ্ট্রের দখল নিয়ে নিলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের প্রাক্কালের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি এগিয়ে এসে সাহায্য করবে না৷ অবশ্য বাণিজ্যিক ফায়দা থাকলে তখন কী করতো সেটা ভিন্ন কথা৷ প্রতিবেশি উন্নয়ণশীল দেশগুলির যে তৎপরতা তা প্রতিবেশির ঘরে আগুন লাগলে যে উত্তাপ লাগে তার মতো৷ অর্থাৎ প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলির ভয় তাদের  ঘরেও না আগুন লাগে বা আগুনের আঁচ না আসে৷ আফগানিস্তানের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারত, পাকিস্তান বা চীনের সেই অবস্থা৷  তাই ভারত, পাকিস্তান ও চীন অবস্থান নিতে চলেছে নিজেদের মধ্যে কে কীভাবে অন্যের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে তার হিসেব কষে৷ হিসেব কষে৷ এরা কেউই আফগানিস্তানের গণতন্ত্র বাঁচাতে বা জনগণকে বাঁচাতে এই মুহূর্তে এগিয়ে আসবে না৷ বিগত কুড়ি বছরের সরকারগুলিকে আর্থিক সহায়তা দিতে যাওয়া ভারতের অবস্থানও ছিল এই পরিপ্রেক্ষিতেই৷ আর যাদের ভরসায় এতদিন শাসকের কুর্সিতে বসে শুধু আখের  গুছিয়েছেন যারা তাদের অবস্থানও কী নির্মম! জনগণকে অন্ধকারে ফেলে পালিয়ে গেল৷ ফলে সে দেশের নিরীহ  শান্তিপ্রিয় জনগণ ও সেদেশে বিভিন্ন সূত্রে থাকা বিদেশি নাগরিকগণের কী অবস্থা তা তো গোটা বিশ্ব দেখছেন৷ পালিয়ে বাঁচার জন্য প্লেনের চাকায় উঠে বসেছেন৷ বিমানবন্দরে কোলের শিশুকে একা ফেলে রেখে  মা পালিয়ে গেছেন৷ ভাবতে পারা যায়? এতদিনের পাহারাদার আমেরিকা তার দায় নেবে না? আফগানদের সাবালক না করে এই যে আমেরিকা সেদেশের  দুর্বল সরকার ও সাধারণ মানুষকে তালিবানদের বন্দুকের নলের মুখে ফেলে চলে গেল তার কী জবাব আছে বিশ্ব বিবেকের কাছে? রাষ্ট্রসঙ্ঘ যদি কোনো দুর্বল রাষ্ট্রের এহন পরিস্থিতিতে এগিয়ে  না আসে তাহলে সেই সংস্থা থাকার কোনো অর্থ আছে কি? এটা তো মধ্যযুগ নয়! চাইলেই কোনো দেশ বা কোনো দেশের জঙ্গীগোষ্ঠী জোর করে একটি দেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে সরিয়ে এভাবে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারে না! পারতে দেওয়া উচিত নয়৷ আর যদি নেয় বা নেওয়ার চেষ্টা করে, আর তাতে যদি রাষ্ট্রসংঘ হস্তক্ষেপ না করে তাহলে আধুনিক ও উন্নত তৃতীয় বিশ্বের বড়াই কীসের?

আফগানিস্তান একটি উদাহরণ৷ এই উদাহরণের উত্তরণের ওপর কিন্তু ভবিষ্যতের অনেক কিছুরই উত্থান পতন নির্ভর করবে৷ হোক তা দেশ দখলের লড়াই কিংবা দেশের অর্থনীতি দখলের লড়াই৷ হোক কোনো বিদেশি শক্তির দ্বারা অথবা দেশের মধ্যের কোনো জঙ্গীগোষ্ঠীর দ্বারা৷

তালিবানরা তাঁদের অবস্থান বদলাবেন, না আগের মতোই জঙ্গিবাদী ও কট্টর ইসলামপন্থী থেকে দেশ চালাবেন সেটাও সময়ের নিরীক্ষা৷ তালিবান শব্দের অর্থ ‘শিক্ষার্থী’ হলেও আজ তালিবান শব্দের অর্থ দাঁড়িয়ে গেছে ‘বিশ্বত্রাস’! ‘তালিবান মানে ‘ভয়’! তৃতীয় বিশ্বের মানুষ মহাকাশ জয় করে ভিন্ন গ্রহে পাড়ি দিচ্ছেন, তালিবানি ভয়কে কবে   তালিবানরা তালিবান শব্দের প্রকৃত ‘শিক্ষার্থী’ অর্থকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে? প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি তা না করতে পারে, নোতুন পৃথিবীর মানুষকে নোতুন কোনো আর্থ-সামাজিক দর্শনের সহায়তা নিতে হবে৷ কারণ আজকের বিশ্ব একক কোনো রাষ্ট্র শক্তির বিশ্ব নয়৷ আজকের বিশ্ব  ‘‘আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির  পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদ প্রতিষ্ঠার বিশ্ব৷ আর তা প্রতিষ্ঠার জন্য এসেছে ‘প্রগতিশীল উপযোগ  তত্ত্ব’’৷ প্রয়োজনে মানুষকে তার খোঁজ করতে হবে৷ তা সে  আফগানিস্তানই হোক অথবা যেকোনো স্থান৷