নীলকণ্ঠ দিবস

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

১২ই ফেব্রুয়ারী ‘নীলকণ্ঠ’ দিবস৷ আনন্দমার্গের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন৷ আজ থেকে ৪৬ বছর আগে ১৯৭৩ সালের ঘটনা৷ পটনার বাঁকিপুর সেন্ড্রাল জেলে মিথ্যা অভিযোগে বন্দী মার্গগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূত্তিজীক্ হত্যার উদ্দেশ্যে ওষুধের নামে প্রাণঘাতী মারাত্মক বিষ প্রয়োগ করা হয়৷ কিন্তু মার্গগুরুদেব সেই বিষকে আত্মস্থ করে তাঁর প্রতিক্রিয়া নষ্ট করে দেন৷

মার্গগুরুদেব এই বিষ প্রয়োগের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবী করেন৷ সরকার তাঁর দাবীতে কর্ণপাত করেনি৷ এরপর ১লা এপ্রিল (১৯৭৩) তিনি এই দাবীতে অমরণ অনশন শুরু করেন৷ এই ঐতিহাসিক অনশন চলেছিল পাঁচ বছর চার মাস দুই দিন৷

সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে রাজী না হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী অমরপ্রসাদ চক্রবর্ত্তীর নেতৃত্বে এক বেসরকারী তদন্ত কমিশন গঠিত হয়৷ ওই কমিশনের তদন্তে এই বিষ প্রয়োগের সত্যতা প্রমাণিত হয়৷

পুরাণ কাহিনীতে আছে, সমুদ্র মন্থনকালে বিষ উত্থিত হলে সেই বিষে মানুষ, দেবতা, অসুর সবাই ধ্বংস হওয়ার উপক্রম৷ তখন ভগবান সদাশিব সেই মারাত্মক বিষ নিজ কণ্ঠে ধারণ করে বিষকে নিষ্ক্রিয় করে দেন৷ তার ফলে তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে যায় ও জগৎ সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা পায়৷ আর সেই থেকে শিব নীলকণ্ঠ নামে জগতে পূজিত হতে থাকেন৷ সেদিনে শিব সমুদ্র মন্থনে উত্থিত বিষ পান করে জগৎকে বিনাশের হাত থেকে উদ্ধার করেন৷

পৃথিবীতে যুগে যুগে বহু মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন৷ তাঁরা তাঁদের শুভ প্রচেষ্টার দ্বারা জগতে বহুবিধ কল্যাণ সাধন করে গেছেন৷ কিন্তু তাঁদের সেই কল্যাণ কাজ অতি সহজে সম্পন্ন করতে পারেননি৷ তাঁদিকে নানাবিধ বাধার সম্মুখীন হতে হয়৷ এমন কি অশুভ শক্তির হাতে তাঁদের বহু কষ্ট যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, অনেক সময় জীবনও দিতে হয়৷ তাই জগতের কোন শুভ কাজ বাধা ছাড়া অতি সহজে হয়নি৷ আর এ যুগে সমগ্র মানব সমাজকে রক্ষার জন্যে, জগতের কল্যাণের জন্যে মার্গগুরু যে মহান আদর্শ প্রচার করেন সেই আদর্শে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পাপশক্তি আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের প্রাণপুরুষকে হত্যা করার জন্যে গভীর ষড়যন্ত্র করে কারাগারে বন্দী করে৷ আনন্দমার্গের প্রবক্তা তথা মার্গগুরুদেব শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী জগৎ–কল্যাণের কারণে এই সমস্যা সঙ্কূল পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন৷ নানা সমস্যায় জর্জরিত মানব সমাজ তথা উদ্ভিদ, পশু–পক্ষী সকলের কল্যাণে তিনি পৃথিবীতে আসেন৷ কিন্তু তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কিত অশুভ শক্তি তাঁকে মারার জন্যে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে থাকে৷ কিন্তু কোন ভাবেই তারা সফল হতে না পেরে অবশেষে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী মিথ্যা অপবাদে  ১৯৭১ সালের ২৯ ডিসেম্বর বন্দী করে বাঁকীপুর সেন্ড্রাল জেলে নিক্ষেপে করে৷ সেখানে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওপর বিষ প্রয়োগ করা হয়৷ সেই বিষ পান করে তাঁর অগণিত ভক্তের কাছে নীলকণ্ঠ রূপে অভিহিত হন৷ পরমারাধ্য মার্গগুরুদেব পাঁচ বছর চার মাস দু’দিন কারাগারে অনশনে ছিলেন৷ ১৯৭৮ সালের ২রা আগষ্ট  হাইকোর্টের রায়ে সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে সসম্মানে তিনি জেলের বাইরে আসেন৷ তারপরই তিনি অনশন ত্যাগ করেন৷

পাপশক্তি মনে করেছিল, সক্রেটিসকে যেমন বিষ প্রয়োগ করে, যীশুকে বিচারের প্রহসনে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করেছিল ঠিক তেমনি করেই শ্রীশ্রীআনন্দমূত্তিজীক্ বিষ প্রয়োগে হত্যা করে তাঁর জগৎ কল্যাণের পরিকল্পনাকে ধ্বংস করে দেবে৷ তা কিন্তু সম্ভব হয়নি৷

আনন্দমার্গের মহান আদর্শ আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে৷ আনন্দমার্গ বর্ত্তমান বিশ্বে এক শক্তিশালী আধ্যাত্মিক ও সেবামূলক সংঘটন হিসাবে স্বীকৃত৷ পরমারাধ্য গুরুদেব শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আদর্শের জন্যে সংগ্রাম ও কষ্ট বরণের যে নজির রেখে গেছেন তা মহান আদর্শের জন্যে যাঁরা নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তাঁদের কাছে এক পরম দিগ্দর্শন৷

‘নীলকণ্ঠ দিবস’ ঘোষণা করছে–ন্লন্দ্ব ন্দ্রপ্সব্জ ন্স্তুন্দ্ব্ত্রপ্তপ্সন্ধম্, স্তুন্ন্দ্ব ন্দ্রপ্সব্জ ন্স্তুন্দ্বপ্সপ্তপ্সন্ধ অর্থাৎ আদর্শের জন্যে জীবনধারণ কর আর আদর্শের জন্যে মরণকে বরণ কর৷

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী প্রবর্তিত আনন্দমার্গ তথা প্রাউট দর্শন চায় এক সর্বাত্মক শোষণমুক্ত আদর্শ মানব সমাজ রচনা করতে৷ আনন্দমার্গীরা সমাজের সর্বক্ষেত্রে–কি আধ্যাত্মিক, কি সামাজিক–অর্থনৈতিক, কি শিক্ষা–সংসৃক্তিক সর্বক্ষেত্রেই চায় সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত ও সর্বাঙ্গসুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে৷ আনন্দমার্গীদের এই বিশ্বজোড়া আন্দোলনের গতি কেউই রুদ্ধ করতে পারবে না৷ ‘নীলকণ্ঠ দিবস’ সমস্ত আনন্দমার্গীদের–সমস্ত আদর্শবাদীদের কাছেই চিরন্তন প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে৷