নিপীড়িত মানবতার কল্যাণে আত্মনিবেদিত সদবিপ্রগোষ্ঠীর প্রতীক্ষায় শোষিত জনগণ

লেখক
প্রভাত খাঁ

বাঁচার লড়াই করে সকলকেই এই মাটির পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হয়৷ যখন মানুষ এই পৃথিবীতে আসে তখন সে বা তারা বড়ই অসহায়৷ প্রকৃতির চরম খামখেয়ালীর কারণে সে বা তারা প্রচণ্ড ভাবেই বিধবস্ত ও অস্তিত্ব রক্ষায় কাতর হয়৷ একত্রে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের একনাগাড়ে লড়াই করতে হয়৷ মানুষ তখন জানতো না কেমন করে ঘর বাঁধতে হয়, কেমন করে চাষাবাদ করতে হয়৷  তারা তখন পর্বত গুহায়, বড়ো বড়ো গাছের কোটরে বা গাছের ডালে আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষা করতো৷ কোনটা খাদ্য আর কোনটা অখাদ্য তা তারা জানত না৷ তাই খাদ্য ও অখাদ্য বুঝতে কতো মানুষ যে প্রাণ হারিয়েছে তার ঠিক ঠিকানা নেই৷ যখন খাদ্যাভাব হলো নিরাপত্তার অভাব হলো তখন মানুষ যাযাবর হয়ে জীবন অতিবাহিত করতো৷ গাছের ফল মূল খেতো৷ আর গাছের পাতা ও নরম ছাল দিয়ে লজ্জা নিবারণে শরীর ঢাকতো৷ এর সঙ্গে খাদ্য হিসাবে পশুপক্ষী ধরেও খেতো৷ আগুনের ব্যবহার যখন জানতে পারে তখন তারা খাদ্য ঝলসে বা সিদ্ধ করে খাওয়া শুরু করে৷

তারপর যখন ভূমিকর্ষণ করে ফসল ফলাতে শিখল, ঘর বানাতে শিখলো তখন তারা নির্দিষ্ট,সমতল ভূমিতে ঘর বাড়ি বানিয়ে বাস করতে শুরু করলো৷

রাঢ়ের সভ্যতা পৃথিবীর আদিমতম সভ্যতা৷ এখানকার যে মানুষগুলি গবাদি পশু পালন করে সেই পশুদের সাহায্যে ভূমিকর্ষণ করে ফসল ফলাতে শুরু করল৷ তারাই কৃষি ব্যবস্থার আদি জনক, তাই অন্যান্য সবাই তাদের ‘মহাত্মন্’ বলে শ্রদ্ধা জানায়৷ সেই মহাত্মন্রাই হল বর্তমান কালের মাহাত৷ সে যাই হোক্ , তখন মানুষ নির্দিষ্ট ভূমিতে কৃষিকার্য করার তাগিদে যাযাবর বৃত্তি ত্যাগ করে নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস করতে শুরু করে৷ এভাবে গড়ে ওঠে এক এক জায়গার মানব সভ্যতা৷

আজ বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে৷ কৃষিজাত সম্পদের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে মানুষের সমাজে অনেক কলকারখানা৷ সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে বিভিন্ন দিকে৷ সেখানে যারা শ্রমদান করে থাকে তাদের বলা হয় শ্রমজীবী অর্থাৎ শ্রমিক৷ যারা কায়িকশ্রম দান করে বাঁচার লড়াই করে তাদের বলা হয় শ্রমিক৷

আর বুদ্ধিকে খরচ করে যারা জীবিকা নির্র্বহ করে তারা হ’ল বুদ্ধিজীবী৷ তবে মনে রাখতে হবে যে বুদ্ধি কিন্তু সকলকেই খরচ করতে হয়৷ বুদ্ধির প্রয়োজন চাষীর কর্মে ও শ্রমিকের কর্মেও৷

তবে জাগতিক নানাকাজে বর্ত্তমানযুগে বুদ্ধির অবদানটা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে দ্বিমত নেই৷

এই বুদ্ধির ফলেই মানুষ আজ অতিজাগতিক ক্ষেত্রে ও আধ্যাত্মিকক্ষেত্রেও দ্রুততালে এগিয়ে চলেছে৷ ঠিক তেমনই এই বুদ্ধির অপপ্রয়োগে জগতের ভয়ংঙ্কর ক্ষতিও সাধিত হচ্ছে৷

এটা খুবই অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বর্তমান জগতে কূটবুদ্ধির ফলে জগতের অকল্যাণও হয়েছে অনেক৷বলা চলে, এই কূটবুদ্ধি মানুষের সমাজে শোষণের প্লাবন ঘটিয়ে সমাজকে ধবংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷

ভৌতবিজ্ঞানকে লোভী কূটবুদ্ধি সম্পন্ন বুদ্ধিজীবীরা মানবহিতের কাজে না লাগিয়ে ধবংসের কাজে বেশী করে লাগিয়ে চলেছে৷ তারাই পৃথিবীর কোটি কোটি হতভাগ্য নরনারী ও শিশুর অভিশাপ কুড়ুচ্ছে অহঃরহ৷ তারা লুটেপুটে খাচ্ছে পৃথিবীর সম্পদের সিংহভাগ৷

এই পৃথিবীতে প্রতিটি জীব, জন্তু, গাছপালা, পশুপক্ষীর যিনি স্রষ্টা, তিনিতো একসূত্রে বেঁধে দিয়েছেন সকলকে৷ আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাছে উপকৃত ও দায়বদ্ধ৷ একথাটা একজন সরল মানুষ যতটা অন্তরের সঙ্গে অনুভব করে থাকে, ঠিক তেমনটা কূটবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা কিন্তু অনুভব করে না৷ তাই তারা সেই ঐক্যসূত্রকে অস্বীকার করে রাষ্ট্রীয় শাসনের ক্ষেত্রে, ধর্মমতের দোহাই দিয়ে, জাতপাতের ভেদাভেদ সৃষ্টি করে, এমনকি নারী ও পুরুষের মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে বিভেদের অত্যুচ্চ প্রাচীর গড়ে তুলে সমাজে শোষণ ব্যবস্থা কায়েম করে চলেছে৷

আজ পৃথিবী থেকে রাজতন্ত্র লুপ্ত প্রায়৷ তবে নামকেওয়াস্তে কোথাও কোথাও রাজতন্ত্র রয়েছে আর তাদের প্রশ্রয় দেয় কূটকৌশলী বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে৷

বর্তমান গণতন্ত্রের যুগে প্রশাসকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধনতন্ত্রের সেবাদাস হয়ে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে নানা ছলবল কৌশলে হতভাগ্য কোটি কোটি সাধারণ মানুষকে নির্মমভাবে শোষণ করে চলেছে ৷ তাদের মতাদর্শই হলো ‘‘শোষণের উপর সমৃদ্ধি’’৷ নানান ক্ষেত্রে, ‘ডিভাইড এ্যাণ্ড রুল’ পলিশি নিয়ে রক্তচোষা বাদুরের মতো অসহায় জনগণের রক্তমোক্ষণ করে চলেছে৷

তবে একথা অনস্বীকার্য তা হলো জগৎকল্যাণে সেইসব বুদ্ধিমান মানুষ চিরস্মরণীয় যাঁরা আজীবন সত্যের পূজারী ও মানবতার সেবক৷ এইভাবে যাঁরা ‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ আদর্শে সেবায় নিবেদিত প্রাণ---সেই ‘সদবিপ্র’ গোষ্ঠীর প্রতীক্ষায় শোষিত মানুষ কাতরভাবে দিন গুণছে৷