নোতুন পৃথিবীর দিশারী–প্রাউট

লেখক
সৌমিত্র পাল

(এক)

ইতিহাস বলে যে, আজ থেকে দশ লক্ষ বছর পূর্বে মানুষ পৃথিবীতে এসেছিল৷ সেটা ছিল আদিম বন্য অবস্থা৷ পশুর মতোই সে জীবন–যাপন করত৷ ক্রমে ক্রমে মানব সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে৷ আজ জ্ঞান–বিজ্ঞান প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি হয়েছে গোটা বিশ্বকে মানুষ ঘরে বসে দেখতে পাচ্ছে৷ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এক মুহূর্তে সে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যোগাযোগ করছে৷ বস্তুজগতের বিস্ময়কর সমৃদ্ধি ঘটালেও ব্যর্থ হয়েছে সে তার অন্তর্জগৎ (মনোজগৎ)–কে সমৃদ্ধ করতে৷ শান্তির পিয়াসী মানব মন বস্তুজগতের ভোগ সাধনায় মত্ত হয়ে মনোজগতে চির কাঙাল–ই থেকে গেছে৷ আর মনের নানান স্থূল বাসনাকে চরিতার্থ করতে দলগত, জাতিগত, সম্প্রদায়গত প্রভৃতি নানান ব্দন্দ্বুব্ধন্প্পন্দ্বুব্ধ্ বা  ভাবাবেগ সৃষ্টি করে মানব সমাজ তথা সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখে এনে হাজির করেছে৷ সত্যদ্রষ্টা কবি তাই যথার্থই মন্তব্য করেছেন ঃ

‘‘মানুষ মানুষ হারায়ে হুঁশ

কোথায় চলেছো তুমি

আকাশ বাতাস বিষিয়ে দিয়ে

নরক করে মর্ত্যভূমি....’’৷

সমাজে শোষণ–দুর্নীতির মাত্রা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে৷ মানুষ হারিয়ে ফেলেছে তার নৈতিকতা তথা মূল্যবোধকে৷ কতিপয় স্বার্থান্বেষী চরম প্রাচুর্য আর বিলাসিতার মধ্যে থাকলেও সমাজের একটা ব্যাপক অংশ আজ চরম দারিদ্র্য ও অভাবের শিকার, তাদের জীবনের নূ্যনতম চাহিদাও মিলছে না৷ লক্ষ লক্ষ মানুষ অন্নাভাবে কাতরাচ্ছে৷ সুসন্তুলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও তার পরিকাঠামো সমাজের কোথাও নেই৷ তাছাড়াও নানান রাজনৈতিক দৈন্য, সামাজিক অসংগতি, সাংসৃক্তিক বেলেল্লাপনা, নেতৃত্বের চরম সংকট আজ সমাজকে অক্টোপাশের মতো বেঁধে দিয়ে তার সামগ্রিক অগ্রগতিকে অস্তমিত করে দিয়েছে৷ সমাজের এই সর্বাত্মক চূড়ান্ত অবক্ষয়ের মুখে মানব অস্তিত্ব আজ বিপন্ন .... দিশাহীন৷

ইতোপূর্বে সমাজের বুকে শতাব্দীর আহ্বানে বহু মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছে৷ তাঁরা সমাজের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সংকট নিরসনের জন্যে পথ দেখিয়েছেন৷ তাঁদের মতাদর্শ মানব জীবনের প্রভূত কল্যাণ করেছে...সমাজ জীবনকেও অনেক পরিপুষ্ট করেছে৷ তথাপি দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, মানুষের সার্বিক বিকাশ তথা সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ আজও সাধিত হয়নি৷ কেননা রোগটা যেহেতু আজ সমাজের সর্বদেহেই (রাজনীতি, ধর্মনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, সমাজনীতি প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রেই) ছড়িয়ে পড়েছে, তাই আজকের সংকট নিরসনের জন্যে চাই একটা–পূর্ণাঙ্গ দর্শন, যা সার্বিকভাবে ব্যষ্টিজীবন (মানুষ) ও সমাজজীবন (সমাজ)–কে সমৃদ্ধ করবে .... সর্বাত্মকভাবে মানুষকে তার সংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখাবে৷ বলা বাহুল্য, ‘প্রাউট’বা প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব–ই হ’ল সেই পূর্ণাঙ্গ দর্শন৷ আজকের যুগের সর্বাত্মক প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে প্রাউটের বিশ্বমানবতার উদ্বোধনের পথকে উন্মোচন করলেন বিশ্ববন্দিত যুগপরিত্রাতা ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ মানুষের সার্বিক তথা বহুমুখী ক্লেশ–দুঃখের জগদ্দল পাষাণকে সরিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে সর্বাত্মক শোণণমুক্ত নোতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ণ দেখালেন–কালজয়ী দর্শন প্রাউট৷ প্রাউটের গান তাই অসহায় নিপীড়িতের একমাত্র মুক্তি সঙ্গীত৷ তাই প্রতিক্ষারত ধূলির ধরণীর মানবতা যেন যুগপরিত্রাতা প্রাউট প্রবক্তার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাবনত হয়ে বলছে–

তুমি যে এসেছো আজ

ব্যথিত জনের কথা ভাবিতে

সবার মনের কালো নাশিতে

সকল জীবেরে ভালোবাসিতে৷

প্রাউটের আলোকে জীবন দর্শন ঃ জীবনের উৎস ও তার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যদি কোন সুস্পষ্ট ধারণা না থাকে, তবে কোন দর্শনই নির্ভুলভাবে রচিত হতে পারে না ও তা জীবনের সামগ্রিক দিশাও দেখাতে পারে না৷ জগৎ ও জীবনের উৎপত্তি ও তাদের ক্রমিক বিকাশকে বিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন প্রাউট–প্রবক্তা ও একই সাথে বস্তুজগতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ব্যষ্টি মনের ভাবজগৎকে সমৃদ্ধ ব্দব্ভত্ব্ন্দন্দ্বন্তুব্ধ্ হ্মহ্মব্জপ্স্ত্রন্তুড় ব্ধড়ব্জপ্সব্ভন্ধড় প্সত্ব্ন্দন্দ্বন্তুব্ধন্ল্ স্তুন্দব্ভব্দব্ধপ্পন্দ্ করেছেন তিনি–যা বিশ্ব ইতিহাসে এক বিরলতম অধ্যায়ের সূচনা করেছে৷ এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব৷ সৃষ্টিচক্র ন্তুব্জন্দ্ব্ত্রব্ধন্প্সু প্সন্দ্র ন্তুম্ভন্তুপ্তন্দ্বগ্গ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রাউট প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন যে, এক অনাদি অনন্ত চৈতন্যসত্তা (ব্রহ্ম) থেকেই এই সৃষ্টির ধারাপ্রবাহে ভূমামানস তারপর ক্রমান্বয়ে সূক্ষ্ম থেকে স্থূল পঞ্চভূত (ক্ষিতি– অপ–তেজ–মরুৎ–ব্যোম্)–এর সৃষ্টি৷ এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড৷ একে বলে ‘সৃষ্টির সঞ্চরধারা’৷ এই সঞ্চরধারায় গতি সূক্ষ্ম থেকে স্থূলের দিকে.....চেতন থেকে জড়ের দিকে৷ এরপরই ‘প্রতিসঞ্চর ধারা’–যার গতি স্থূল থেকে সূক্ষ্মের দিকে.... জড় থেকে আবার পরমচৈতন্যের দিকে অর্থাৎ ঘরে ফেরার পালা৷ যাইহোক সৃষ্টির প্রতিসঞ্চর ধারায় জীবনের উৎপত্তি–এককোষী জীব থেকে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে৷ এই পথে মনের ক্রমবিকাশ হয়ে চলেছে৷ তার শরীরে কোষ, স্নায়ূগ্রন্থি সহ মস্তিষ্কের গঠন প্রণালী অন্যান্য জীবের থেকে অনেক বেশী উন্নত৷ দেহের পূর্ণ বিকাশ যেখানে হয়েছে, মনের বিকাশ সেখান থেকেই শুরু হয়৷ তাই দেহগত সংরচনার কারণে মানুষের মনের বিকাশ অন্যান্য জীব থেকে অনেক বেশী৷ কিন্তু এই বিকাশই যথেষ্ট নয়৷ এরপর কী? প্রতিটি মানব মন চায় আরো আরো ব্যাপ্তি... সীমাহীন বিস্তার৷ এটাই মনের ধর্ম৷ স্বামীজীও বলতেন ‘‘ড্রপ্রব্ধন্দ্বুব্ধন্প্সু ন্ব্দ প্তন্ন্দ্রন্দ্ব’’ অর্থাৎ বিস্তারই জীবন৷ মন চায় তার এই ব্যাপ্তিকে চরম স্তরে.... পরিপূর্ণতায় এনে জীবনকে সার্থক করতে....তৃপ্ত করতে৷ কেউ এর ব্যতিক্রমী নয়৷ মনের চরম বিকাশ (ব্যাপ্তি) তখনই সম্ভব যখন মনকে আত্মায় প্রতিষ্ঠিত করা যাবে৷ এর জন্যে চাই আত্মানুশীলন– যা মনের অন্তর্নিহিত সুপ্ত সম্ভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে তাকে শুভভাবনা ও শুভপ্রচেষ্টার দ্বারা প্রেষিত করে তার মনুষ্যত্বের সম্যক বিকাশ ঘটাবে৷ ক্রমান্বয়ে মনুষ্যত্বের পূর্ণতায় দেবত্ব আর দেবত্বের পূর্ণতায় সে অর্জন করবে ব্রহ্মত্ব৷ এই ভাবে জীবত্ব শিবত্বে, বিন্দু সিন্ধুতে আর সসীম অসীমে–ভূমা পরমচৈতন্যে সমাহিত হয়ে যাবে৷ সার্থক হবে মানব জীবন৷ এইভাবে বৃত্ত পূর্ণ হবে৷

মানুষ তার আত্মবিকাশের বিজ্ঞানভিত্তিক পথ অবলম্বন করছে না বলেই মানুষ দেবতা না হয়ে দানবে পরিণত হচ্ছে–মানুষের সেবাভাব শোষণ চিন্তায় রূপায়িত হচ্ছে–মানুষের মধ্যে শুভভাবনার বিকাশ না ঘটে দুর্নীতিমূলক অশুভ ভাবনার জন্ম নিচ্ছে৷ মনের এই আধোগতি রোধ করে মানুষকে আত্মবিকাশের পথ দেখিয়েছেন প্রাউট প্রবক্তা আধ্যাত্মিক যোগসাধনার মাধ্যমে৷

তিনি বলেছেন যে, দেহ–মন–আত্মা–এই ত্রিভৌমিক সত্তা নিয়েই মানব জীবন৷ তাই মানব জীবনকে চরম সার্থকতায় প্রতিষ্ঠিত করার অর্থই হ’ল ওই ত্রিভৌমিক সত্তাকেন্দ্রিক সুসন্তুলিত পরিকল্পনা–যা পরিপূর্ত্তি করবে দেহ–মন–আত্মার ত্রিবিধ চাহিদাকে৷ প্রাউটে–প্রবক্তা ওই ত্রিবিধ চাহিদা পরিপূর্ত্তির কথা মাথায় রেখে এক সুষ্ঠু বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় দেখিয়ে গেছেন৷ মানুষের দেহগত বা আস্তিত্বিক সমৃদ্ধির (অন্ন–বস্ত্র–বাসস্থান্ ব্যবস্থা প্রভৃতির) জন্যে প্রাউট এনেছে এক সুষ্ঠু সামাজিক–র্থনৈতিক তত্ত্ব যেখানে রয়েছে বহুমুখী সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসংগতির সমাধানের বিজ্ঞানভিত্তিক পথ৷ মানুষের মানসিক ঋদ্ধির জন্যে নন্দন ও মোহন বিজ্ঞানের চর্চার উপর তিনি আলোকপাত করেছেন আর আত্মবিকাশের জন্যে তিনি রেখে গেছেন৷ এক অভিনব জৈব–মনস্তাত্ত্বিক অষ্টাঙ্গ যোগানুশীলন পদ্ধতি৷ এইভাবে প্রাউট জীবনের পূর্ণবিকাশের মধ্য দিয়ে মানবতার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়৷