পানীয় জলের বাণিজ্যিকরণ নয়

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

বর্তমানে সারা দেশ জুড়ে পানীয় জলের সংকটের সুযোগ নিয়ে জলসম্পদের বাণিজ্যিকরণ জোর কদমে চলছে৷ জল আজ অর্থনৈতিক পন্যে পরিণত হয়েছে৷ কিন্তু জল তো জীবন ধারণের অপরিহার্য বস্তু৷ মানুষের ন্যূনতম চাহিদার মধ্যে পড়ছে৷ পানীয় জল, বিশুদ্ধ বায়ু এসব ন্যূনতমের মধ্যে ন্যূনতম৷ এই চরম ন্যূনতম অপরিহার্য্য বস্তুর বাণিজ্যিকরণ মোটেই কাম্য নয়৷

ব্যবসায়ীরা মুনাফার দৃষ্টি কোণ থেকে সব কিছুকে দেখে৷ মুনাফার কারণ মূল্যবৃদ্ধি ঘটায়৷ অবাধ মুনাফার কারণে ভেজালও দেখা যায়৷ এটাই বাস্তব৷ এই অবস্থায় পানীয় জলকে বেসরকারী ব্যবসাদারদের হাতে ছেড়ে দেওয়া কখনই কাম্য নয়৷

সর্বত্র বিশুদ্ধ পানীয় জলের সরবরাহ জনকল্যাণকামী সরকারেরই করা উচিত৷ অথবা সার্থক ও ব্যাপক সমবায় গড়ে তুলতে পারলে সমবায়ের হাতে এই দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু পুঁজিপতি ব্যবসাদারদের হাতে পানীয় জলের সরবরাহের একচেটিয়া অধিকারকে তুলে দেওয়াটা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়৷

সরকার অন্যান্য নানান ধরণের দান-খয়রাত করছে, কিন্তু পানীয় জল সরবরাহ তো একেবারেই প্রাথমিক কর্তব্য---এর দিকে নজর দেওয়াটা একেবারে গোড়ার কাজ৷ এ ব্যাপারে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে যৌথভাবে চিন্তা-ভাবনা করতেই হবে৷ আর সেটা খুব গুরুত্ব সহকারে৷

১৯৮৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে জলে আর্সেনিক দূষণের কথা জানা যায়৷ এরপর বীরভূমের নলহাটিতে প্রথম ভূগর্ভ জলে ক্লোরাইডের আধিক্য দেখা দেয়৷ ধরা পড়ে পুরুূলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিমমেদিনীপুর প্রভৃতি জেলায়ও ফ্লোরাইড রয়েছে   ---যে ফ্লোরাইড বিষ মানুষের শরীরে নানান রোগের সৃষ্টি করে৷ এদিকে সমুদ্র কিনারার এলাকাগুলিতে ভূগর্ভস্থ জল ও লবণাক্ত৷

এই পরিস্থিতিতে পানীয় জলের সংকট যে কী ভীষণ সংকট তা সহজেই অনুমেয়৷ শুধু যে পানীয় জলের সংকটই ভীষণ সংকট তাই-ই নয়, চাষের জলের সংকটও দারুণ সংকট৷ কেননা ক্রমবর্ধমান লোকসংখ্যায়  মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য মেটাতে গেলেও এক একটি এলাকাকে সেই অনুসারে খাদ্যে স্বয়ম্ভর হয়ে উঠতে হলে যে পরিমাণ চাষের জল প্রয়োজন তা আজ চাষীরা পাচ্ছে না৷

এইসব সমস্যা সমাধানে এত দিন সরকার ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন করে ব্যবহার করার দিকে বেশী করে দৃষ্টি দিয়েছিলেন৷ কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের ক্রমাগত সতর্কবার্তা হ’ল---ভূগর্ভস্থ জলস্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে, এতে অদূর ভবিষ্যতে তীব্র জলসংকট দেখা দেবে ও মানুষের জীবন ধারণ দারুণ সমস্যাজনক হয়ে পড়বে৷ বিপদ আরও ঘনীভূত হবে৷

এ অবস্থায় একমাত্র উপায় বৃষ্টির জলকে ধরে রাখা৷ বর্তমানে বৃষ্টির জলের প্রায় ৭০ শতাংশ সরাসরি নদী বেয়ে সুমুদ্রে চলে যায়৷ এই জলকে ব্যাপকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে৷ ব্যাপকভাবে নতুন নতুন পুকুর, খাল, ছোট ছোট বহু জলাধার, বাঁধ তৈরী করতে হবে৷ পুরোনো নদ-নদী খাল বিলকে সংস্কার করে তাদের গর্ভস্থ মাটি বালি পলি সরিয়ে গভীর করে সেগুলি জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে৷ বর্ষার জলকে ধরে রাখার নতুন নতুন পন্থা আবিষ্কার করতে হবে৷ বৃষ্টির জল থেকেই পানীয় জলের ভাণ্ডার গড়ে তুলে ---তাকে পরিশোধন করেই পানীয় জল সরবরাহের ব্যাপক ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই করতে হবে৷ মুনাফা লোভী ব্যবসাদারদের ওপর মানুষের ভাগ্যকে ছেড়ে দেওয়া  যায় না৷