প্রভাত সঙ্গীতের স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রভাতরঞ্জন সরকার জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯২১ সনের বৈশাখী পূর্ণিমার পূণ্য প্রভাতে, বিহারের জামালপুরে৷ অর্থাৎ আজ থেকে এক শতাব্দী আগে৷ জন্মশতবর্ষে দাঁড়িয়ে বিরল ও বহুমুখী প্রতিভার এক অনন্য উদাহরণ এই ব্যষ্টিত্বের কর্মমূখর জীবনের এক অতি সংক্ষিপ্ত খণ্ড চিত্র তুলে ধরার অপূর্ণ ও অক্ষম প্রয়াস এই নিবন্ধে৷ তিনি একাধারে দার্শনিক, গীতিকার, সুরকার,সমাজবিদ, ভাষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, কৃষিবিদ, প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব বা প্রাউট দর্শনের প্রণেতা, সর্র্বেপরি নব্যমানবতাবাদের উদগাতা৷ আজ আমরা  এই বহুধাপল্লবিত ব্যষ্টিত্বের শুধু সঙ্গীত সৃষ্টির ওপর কিঞ্চিত আলোকপাতের প্রয়াস করব৷ তাই আশা করি সঙ্গীতের গুরুত্ব সম্পর্কে সামান্য ভূমিকা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না৷ বেদ উপনিষদ থেকে গীতা সর্বত্রই সঙ্গীতকে বিশেষ মর্যাদায় মহিমান্বিত করা হয়েছে৷ সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠত্ব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উদেঘাষিত হয়েছে৷ ভারতীয় ধর্মভাবনার আকর গ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবতগীতার দশম অধ্যায়ের  দ্বাবিংশতি শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন ---‘বেদানাং সামবেদোহস্মি৷’’ (বেদ সমূহের মধ্যে আমি সামবেদ৷) আরও অনেক  পরে ভারতে ভক্তি আন্দোলনের যুগে নারদের প্রতি ভগবানের উক্তি---‘‘নাহং তিষ্ঠামি বৈকুন্ঠে যোগীনাং হৃদয়ে ন চঃ মদ্ভক্তা যত্র ‘‘গায়ন্তী’’ তত্র তিষ্ঠামি নারদঃ৷’’ এখানেও সেই সঙ্গীতেরই মহিমা৷

একেবারে আধুনিক যুগে এসে রবীন্দ্রনাথ-এর কন্ঠেও ধবনিত হলো সেই একই আর্তি, ‘‘দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে, আমার সুরগুলি পায় চরণ আমি পাইনে তোমারে৷’’ সঙ্গীতের  শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে অধিক প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য করেছেন ঋষি অরবিন্দের মানসপুত্র শ্রীনলিনীকান্ত গুপ্ত৷ ---সঙ্গীত হইতেছে শূদ্র--- সঙ্গীত সকল শিল্পের গোড়ায় পদমূলে প্রতিষ্ঠায়, উহার ধর্ম আর সকল শিল্পবিদ্যার সেবা করা, সকল শিল্পবিদ্যাকে ললিতকলার একটা মূল ভঙ্গিমা বা সুর দিয়া সে চলিয়াছে৷ ---সঙ্গীতের স্থান সকলের নীচে, কিন্তু অধম বলিয়া নয়--- সে সকলকে ধারণ করিয়া রহিয়াছে বলিয়া৷’’ (নলিনীকান্ত গুপ্ত রচনাবলী, প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ৮৫)

গানের মাহাত্ম্য সম্পর্কে শুধু প্রাচ্য নয় পাশ্চাত্যের মনীষীদের কন্ঠেও একই সুর প্রতিধবনিত হতে শুনি৷ পৃথিবী বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক  আইনস্টাইন বলেছেন, ‘‘যদি আমি একজন পদার্থবিদ না হতাম তাহলে আমি একজন সঙ্গীতজ্ঞ হতাম৷ আমি সঙ্গীতের মধ্য দিয়েই ভাবি আমি আমার জীবনকে সঙ্গীতের  মাধ্যমেই আবিষ্কার করি৷’’

‘‘নৈঃশব্দের পর অপ্রকাশিতকে প্রকাশ করতে যার সান্নিধ্য আমরা অনুভব করি তা হল সঙ্গীত৷’’ (অল্ডার হাক্সলি)

সঙ্গীত মানব সভ্যতার সম্যক বিকশিত হওয়ার অপরিহার্য অঙ্গ৷ তাই প্রভাতসঙ্গীতের স্রষ্টা প্রভাতরঞ্জন সরকার পাঁচ সহস্রাধিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সেই অপ্রকাশিত, অবাঙমনসোগোচর, অধরাকে ছোঁয়ার, সেই চির অচেনাকে চেনার প্রয়াসে যাঁরা রত তাঁদের কাছে আশার বাণী বয়ে এনেছেন৷ যাঁরা সঙ্গীতের মাধ্যমে আলো থেকে অধিকতর আলোয় উত্তরণের সাধনায় ব্রতী তাঁদের হাতে প্রভাত সঙ্গীতের পঞ্চসহস্র প্রদীপটি তুলে ধরেছেন৷

সঙ্গীত, কাব্য, অভিনয়, ভাস্কর্য, সাহিত্য, সংস্কৃতির যা কিছু মহান তার সৃজনমুহূর্তের যন্ত্রণা একমাত্র স্রষ্টা ছাড়া অন্য কারও পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়৷ সঙ্গীতের সৃজনমুহূর্তের অবস্থা অনুধাবন করতে আসুন আমরা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত সৃষ্টির একটি অনন্য স্মৃতিমধুর মুহূর্তের কথা রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য অমল হোম এর স্মৃতি চারণ থেকে শুনে নিই৷’’

---সেই ঝড়ের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ছুটে আসছেন, তাঁর বেশবাস, তাঁর শ্মশ্রু কেশ উড়ছে, জোববাটাকে চেপে ধরেছেন বাঁ হাতে আর ডান হাতে চেপে ধরেছেন চোখের চশমাটা আরও  একটু এগিয়ে আসতে শুনতে পেলাম গলা ছেড়ে তিনি গাইছেন, মেঘমন্দ্রের সঙ্গে তাঁর কন্ঠ উঠছে কেঁপে কেঁপে--- যেতে যেতে একলা পথে/ নিবেছে মোর বাতি/ ঝড় এসেছে, ওরে, এবার /ঝড়কে পেলেম সাথী৷’’

শুধু রবীন্দ্রনাথ নন প্রত্যেকজন সঙ্গীত স্রষ্টার সঙ্গীত সৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য অনুরূপ কাহিনী৷ অর্থাৎ একটা বিশেষ অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ সঙ্গীত সৃষ্টির সহায়ক৷ কিন্তু প্রভাতরঞ্জন সরকার সম্পূর্ণ বিপরীত৷ নিবন্ধের পরবর্তী পর্বে আমরা সে আলোচনায় আসব৷ সঙ্গীত মূলত ভাব প্রধান৷ কবির ভাব সৃষ্টিতে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ভূমিকা অপরিসীম৷

আসুন এবার প্রভাতসঙ্গীতের সৃজন মুহূর্তগুলোর উপর আলোকপাতের চেষ্টায় একটু পেছনে  ফিরে দেখা যাক৷ প্রভাতরঞ্জন সরকারের ইহলৌকিক জীবনকাল ১৯২১ এর ২১শে মে  থেকে ১৯৯০ এর ২১ শে অক্টোবর পর্যন্ত৷ প্রথাগত শিক্ষা বিজ্ঞান শাখায়  ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত৷ আরও অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই পিতার অকাল প্রয়াণে পারিবারিক প্রয়োজনে শিক্ষা অসম্পূর্ণ রেখে সরাসরি কর্মচারী হিসেবে জীবনের অনেকটা সময় তাঁকে ব্যয় করতে হয়েছে৷ ১৯৫৫ সনে আনন্দমার্গ সংঘটন গড়ে তোলার পর ১৯৬০ সনের কাছাকাছি সময় থেকেই মূলত তাঁর বহুমুখী প্রতিভা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হতে থাকে৷ এরই মধ্যে ১৯৭১ থেকে ১৯৭৮ এই সাত বছর ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির দাবা খেলায় তাঁকে কাটাতে  হয়েছে কারাগারে৷ এরই মধ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে দীর্ঘ অনূ্যন পাঁচ বছর কাটিয়েছেন অনশনে৷ এতা প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে সংগ্রাম করার পর প্রকৃত পক্ষে তাঁর সৃষ্টিশীল কাজের সময় ১৯৭৮ এর অগাষ্ট থেকে ১৯৯০ এর অক্টোবর, অর্থাৎ মাত্র ১২ বছর৷ এর মধ্যেই দর্শন, ধর্ম, যোগসাধনা, সমাজ,শিক্ষা,বিজ্ঞান, কৃষি, ইতিহাস, ভূবিদ্যা, নৃতত্ত্ব, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব, ধবনিবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, নারীমুক্তি, নব্যমানবতাবাদ ইত্যাদি বহু বিষয়ের ওপর দুই শতাধিক মৌলিক গ্রন্থের এক বিশাল ভাণ্ডার সৃষ্টি করেছেন৷ এই সমস্ত কাজের ফাঁকে ফাঁকে সঙ্গীত সৃষ্টির জন্য সময় দিয়েছেন মাত্র  আট বছর দু মাস৷ সেটিও জীবনের অন্তিমপর্বে৷ অর্থাৎ ১৯৮২ সনের ১৪ সেপ্ঢেম্বর থেকে ১৯৯০ সনের ২০অক্টোবর  পর্যন্ত৷ তাতেই বাংলা, সংসৃকত, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, অঙ্গিকা, মৈথিলি, মগহী এই আটটি ভাষায় বাউল, কীর্তন, ভাটিয়ালি, ঝুমর, টপ্পা, ঠুংরি, কাওয়ালি, গজল ইত্যাদি বহু বৈচিত্রময় আঙ্গিকে সমৃদ্ধ করেছেন পাঁচ সহস্রাধিক প্রভাতসঙ্গীতের ভাণ্ডারটি, যেখানে যুক্ত হয়েছে বহু অধুনা লুপ্ত ও বিদেশি সুরের সমারোহও৷ (ক্রমশঃ)