সৈদ্ধান্তিক তত্ত্ব ও প্রয়োগভূমি তত্ত্ব

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

পূর্ব প্রকাশিতের পর

চতুর্থটি হচ্ছে পরিবেশগত বাঁধা (এনবায়রণমেন্টাল ডিফিকাল্টি)৷ এখানে ভণ্ড মনস্তত্ব, তাত্ত্বিক মনস্তত্ব ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে অক্ষমতা কাজ করে না, কিন্তু যখন সিদ্ধান্ত প্রবর্তিত হয় তখন প্রবক্তা এক বিশেষ মানসিক পরিবেশে থাকে৷ সে মনের মধ্যে এক জগৎ সৃষ্টি করে সিদ্ধান্তকে নিজের মনেই প্রয়োগ করে, উদাহরণ স্বরূপ মার্কসবাদ৷ প্রবর্তকের প্রচেষ্টার কোন ত্রুটি নেই৷ তাঁর মানসিক পরিবেশে তিনি যে সিদ্ধান্ত গড়ে তুলেছেন--- একদিক থেকে ঠিক ৷ কিন্তু পৃথিবীর কঠিন মৃত্তিকা ও মানসিক পরিবেশে এক নয়৷ পৃথিবীর মাটি অত্যন্ত কঠিন৷ সুতরাং যখন সিদ্ধান্তকে প্রয়োগ ভূমিতে আনা হ’ল--- তখনই তা অসফল হ’ল৷ বৌদ্ধিক পরিবেশে সিদ্ধান্ত অবশ্যই যথার্থ৷ কিন্তু প্রয়োগভূমিতে বাস্তব পরিবেশের সঙ্গে তা মিল খায় না৷ উদাহরণ স্বরূপ তোমার মানসিক ক্ষেত্রে তুমি ধরে নিতে পার গঙ্গানদীতে জল নেই --- তার পরিবর্তে রয়েছে দুধ৷ তখন তুমি সুস্বাদু মিষ্টি তৈরীর পরিকল্পনা করতে পার৷ আর এই মিষ্টি নিজেও খাওয়া যাবে ও বাইরেও রপ্তানি করা যাবে৷ কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে গঙ্গানদীতে মোটেই দুধ নেই৷ রয়েছে জল৷ সুতরাং এক বিশেষ বৌদ্ধিক পরিবেশে তৈরী সিদ্ধান্ত প্রয়োগভূমিতে সম্পূর্ণ অসফল৷ সেখানে প্রথমে সিদ্ধান্ত আসে, তারপর আসে প্রয়োগের দিক সেখানে সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন খুবই কঠিন৷

এখন সেই দিকটা দেখা যাক--- যেখানে সিদ্ধান্ত প্রয়োগ-ভূমিকে অনুসরণ করে৷ প্রথমে প্র্যাক্টিকাল বা রূপায়ণের দিক--- তারপর সিদ্ধান্ত বা থিওরী৷ প্রথমে বাস্তব জগৎকে পর্যবেক্ষণ করে তাকে অনুধাবন করা হ’ল--- তারপর সিদ্ধান্ত তৈরী হ’ল৷ উদাহরণ স্বরূপ আপেল মাটিতে পড়ার পর সিদ্ধান্ত তৈরী হ’ল--- সিদ্ধান্ত তৈরী হবার পর আপেল মাটিতে পড়ে নি৷ এইসব ক্ষেত্রে যেখানে সিদ্ধান্ত প্রয়োগভূমিকে অনুসরণ করে--- সেখানে তা বাস্তবায়নযোগ্য হয়৷ সদাশিব এইটা প্রথমে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন৷ ভগবান সদাশিব ছোট ড় সব ঘটনা লক্ষ্য করেছিলেন৷ যেসব ঘটনার আমরা গুরুত্ব দিয়ে থাকি --- ঘটনার পেছনে কী কারণ রয়েছে --- সে সম্পর্কে আমরা কমই জানি৷ তিনি প্রতিটি ঘটনার কারণ নির্ণয় করলেন, আর একটি সিদ্ধান্তের প্রবর্তন করলেন৷ তিনি--- শিল্প, ভাস্কর্য, সাহিত্য, নৃত্য, সঙ্গীত, বিজ্ঞান সবকিছুকে পর্যবেক্ষণ করে এদের পেছনে কী তত্ত্ব রয়েছে তা খঁুজে বের করলেন৷ যেমন, তিনি একটা বিশেষ নৃত্যের ধারাকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন৷ তারপর তিনি একটা তত্ত্ব দিলেন৷ তন্ত্রের ক্ষেত্রে তাঁর প্রদত্ত তত্ত্ব প্রকৃত পক্ষে হাতে কলমে কর্মরত একজন বৈজ্ঞানিকের ল্যাবরেটারী-নোট কের মত৷ একটা বিশেষ নৃত্যের উদাহরণ নেওয়া যাক৷ তিনি দেখলেন, এই নৃত্য মানুষের লিম্ফ্যাটিক গ্রন্থিগুলিতে স্পন্দন সৃষ্টি করে মানুষের পৌরুষ াড়িয়ে দেয়৷ সুতরাং নৃত্যটা যথাযথ লে বিবেচিত হ’ল৷ এর নাম রাখা হ’ল ‘তাণ্ডব’৷ তাণ্ডব শব্দটি এসেছে ‘তণ্ডু’ থেকে---মানে লাফানো৷ যেহেতু এর দ্বারা ‘তণ্ডু’ অর্থাৎ লম্ফ সাধিত হচ্ছে--- তাই এর নাম ‘তাণ্ডব’৷ ঠিক এমনিভাবে, একধরণের নৃত্য মানুষের লিম্ফ্যাটিক গ্ল্যাণ্ডগুলিতে কোমল স্পন্দন সৃষ্টি করে সেগুলিতে সংকোচন এনে মনে কোমল ভাব (লাস্য) সৃষ্টি করে৷ লাস্যের তত্ত্ব অনুসারে তাই এটা যথার্থ৷ এই নৃত্যের নাম হ’ল ললিত নৃত্য৷

মানুষের নানান ক্রিয়াকলাপের পেছনে যে মূল ভাব রয়েছে সদাশিব তা উপলদ্ধি করে একটা তত্ত্ব দিলেন আর সেই তত্ত্ব মানুষের সামনে হাজির করলেন৷ সুতরাং, প্র্যাক্টিসের পর যে তত্ত্ব আসে তাই যথার্থ৷

এখন যদি দু’টো তত্ত্বের যথাযথ ফলকে মিশ্রিত করা যায়, তাতে তার পরিণামে একটা নূতন সিদ্ধান্ত তৈরী হয়৷ এইভাবে একটা বিশেষ পরিণামভুক্ত ফলের সঙ্গে আর একটা সিদ্ধান্তকে মিলিত করা হলে আবার একটা বিশেষ প্রকারের সিদ্ধান্তের সৃষ্টি হয়৷ এইভাবে বিশ্লেষন-সংশ্লেষনের মধ্য দিয়ে ছয়-রাগ ছত্রিশ রাগিনী তৈরী করা হয়েছে---সৃষ্টি হয়েছে সঙ্গীত-বিজ্ঞানের৷ এটা সফল হয়েছে কারণ এক্ষেত্রে তত্ত্ব বা সিদ্ধান্ত (থিওরী) গ্রহণ করা হয়েছে প্রয়োগের (প্র্যাকটিস) পর৷ অপরপক্ষে তার্কিেেকর সিদ্ধান্তের (থিওরী) পর আসে তার প্রয়োগ (প্র্যাকটিস)৷ সদাশিব প্রবর্তিত তাণ্ডব-নৃত্যের ‘তা’ ও পার্বতী-প্রদত্ত ললিত নৃত্যের ‘ল নিয়ে তৈরী হ’ল নূতন সিদ্ধান্ত --- যার নাম রাখা হল ‘তাল’৷

এইভাবে চলতে থাকে৷ তোমরা এই ব্যাপারে স সময় নিশ্চয়ই লক্ষ্য রাখর্ে কোন্টা আগে আসছে কোন্টা পরে আসছে৷ যদি সিদ্ধান্ত পরে আসে তাহলে তা বাস্তবায়িত হবেই৷ কেবল প্রচেষ্টা ও কেমনভাবে হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করর্ে কতটা সময়ে তা বাস্তবায়িত হবে৷ চেষ্টা অধিক হলে অল্প সময়েই বাস্তবায়িত হবে৷

আমি তোমাদের আগেই বলেছি, সভ্যতা সংকটজনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে৷ আর এই সংকটের প্রধান কারণ, আগে সিদ্ধান্ত (থিওরী) তৈরী করে নেওয়া হচ্ছে, প্রয়োগের (প্রাকটিস) দিকটা আসছে তার পরে৷ এইটাই প্রধান কারণ৷

এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ভণ্ড মনস্তত্ব যা কপটদের বৌদ্ধিক অমিতাচারমাত্র intellectual extravaganza) --- তা থেকে অবশ্যই দূরে থেকো৷