স্বদেশ প্রেমের অপর নাম ঃ তেইশে জানুয়ারী

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

(পূর্ব প্রকাশিতের পর )

এই সময়েই শুরু হ’ল সুভাষচন্দ্রের জীবনে এক চরম পরীক্ষা৷ একদিকে উচ্চ বেতনের সরকারী চাকুরীর নিশ্চিত আরামের জীবন, আর অন্যদিকে জীবনের সর্বোচ্চ আদর্শ ও অপরিসীম দুঃখ-কষ্ট সহ দারিদ্র্যের জীবন---এই দু’য়ের দ্বন্দ্বে তাঁর মনোজগতে তোলপাড় চলতে লাগল৷ কিন্তু মাতৃভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্যে যে মহা বিপ্লবীর জন্ম, তাকে সোণার খাঁচায় বন্দী করা কি এতই সহজ? ইংরাজ প্রভুদের গোলামীর দুরন্ত প্রলোভন ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে’ তিনি দেশবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী রূপে জীবনপণ করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভারতের মুক্তি সংগ্রামে৷ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সংযোজিত হ’ল এক নূতন অধ্যায়৷

সুভাষচন্দ্রের পরবর্তী ঘটনাবহুল কর্মজীবন রূপকথার মত রোমাঞ্চকর৷ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে তিনি রাজনৈতিক গুরু হিসেবে পেয়েছিলেন৷ অচিরেই তিনি দেশবন্ধুর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন নিজ স্বভাব ও কর্মগুণে৷ দেশবন্ধুর নির্দেশেই সুভাষচন্দ্র জাতীয় শিক্ষালয়ের অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করেন৷ এছাড়াও তাঁকে কংগ্রেস কমিটির প্রচারসচিবের দায়িত্বও দেওয়া হ’ল৷ জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনে ও জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে তোলায় তাঁর সাংঘটনিক দক্ষতার পরিচয় পেয়ে তাঁকে জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র সংঘটনের বিশেষ দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়৷ তিনি প্রথমে ১৯২১ সালে ‘বাঙ্গলার কথা’, ১৯২২ সালে ‘আত্মশক্তি’ ও ১৯২৩ সালে ‘ফরওয়ার্ড’ পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন৷ ১৯২৩ সালেই তাঁকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়৷ ১৯২৪ সালে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের নির্বাচনে জয়ী হয়ে দেশবন্ধু কলকাতার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন ও তাঁরই অনুরোধে সুভাষচন্দ্র চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার বা প্রধান কর্মকর্তা নিযুক্ত হলেন৷ এইভাবে সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবন দেশবন্ধুর নির্দেশিত পথে উল্কার গতিতে এগিয়ে  চলতে লাগল৷ কিন্তু ব্রিটিশ সরকার-বিরোধী মনোভাবের জন্যে তাঁকে অল্পকালের মধ্যে কারাবরণ করতে হয়৷ শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ শাসকবর্গ সুভাষচন্দ্রের সাংঘটনিক প্রতিভা ও যুবসমাজে গ্রহণযোগ্যতার কারণে তাঁকে বেশীদিন কারাপ্রাচীরের বাইরে রাখতে ভরসা পায়নি৷ তাই স্বাধীনতার অদম্য সৈনিক সুভাষচন্দ্রকে মাঝে মধ্যেই কারাবাস করতে হয়েছে৷ দীর্ঘদিন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কারাবাসের ফলে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে ও বাধ্য হয়ে তাঁকে চিকিৎসার জন্যে ১৯৩৩ সালে ইউরোপে পাঠানো হয়৷ ইউরোপের বিভিন্ন স্থানের চিকিৎসায় স্বাস্থ্যের উন্নতির ফলে তিনি ভারতে ফিরে আসেন৷ অতঃপর তাঁকে আবার অন্তরীণ রাখা হয়৷ প্রদেশ ও কেন্দ্রীয় স্তরে বিভিন্ন পদ অলঙ্কৃত করার পর তিনি ১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন৷ পরের বছর ১৯৩৯ সালেও গান্ধীজী, নেহেরু, প্যাটেল, পট্টভি সীতারামাইয়া প্রমুখদের ষড়যন্ত্র ও বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি ত্রিপুরী অধিবেশনের  সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ কিন্তু বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও দেশীয় পুঁজিপতিদের তল্পিবাহক গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ প্রমুখের ষড়যন্ত্রে শুধুমাত্র বঙ্গ সন্তান হওয়ার কারণে সুভাষচন্দ্রের জয়কে কালিমালিপ্ত করা হয়েছিল৷ সুভাষের জায়গায় অন্য কোনও অবাঙালী নেতার ক্ষেত্রে হয়ত এমনটা ঘটতো না৷ শুধু তাই নয়, পরের দিনই সংবাদত্রে গান্ধীজীর বিবৃতি প্রকাশিত হয়---‘পট্টভি সীতারামাইয়ার পরাজয় আমার পরাজয়’৷ সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে কতটা বিদ্বেষভাব মনে পোষণ করলে তবেই এই ধরণের বিবৃতি দান সম্ভব! সমগ্র ভারতবর্ষ এই বিবৃতিতে স্তম্ভিত হয়ে যায়৷ অথচ এই সুভাষচন্দ্রই গান্ধীজীকে ‘জাতির জনক’ বা‘Father of the nation’ নামে সম্বোধন করেছিলেন৷ উপরের দু’টি উক্তিতেই দুই জনের মনের পরিচয় পাওয়া যায়৷ যাইহোক, গান্ধীজী ও তাঁর অনুগত চেলা-চামুণ্ডাদের চূড়ান্ত অসহযোগিতায় বিরক্ত হয়ে ও আত্মসম্মান রক্ষার্থে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন৷ সুভাষচন্দ্রের দাবী ছিল---‘পূর্ণ স্বরাজ’ ও এই লক্ষ্যে যে কোনও সুযোগ গ্রহণ করতে তিনি ছিলেন অগ্রণী যা গান্ধীজীর সাঙ্গপাঙ্গদের পছন্দ হয়নি৷ এরফলে উভয়পক্ষে সংঘাত অত্যন্ত তীব্র হয়ে ওঠে৷ শেষ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস ত্যাগ করেন৷ ও দেশের মুক্তিসংগ্রামকে নোতুন খাতে বইয়ে নিতে মনস্থ করলেন৷ তিনি ফরওয়ার্ড ব্লককে আরও মজবুত ও গতিশীল করতে শুরু করলেন৷ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজীর ভূমিকা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে প্রাউট প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার জানিয়েছেন---‘‘তিনি (সুভাষচন্দ্র) চেয়েছিলেন অবস্থার সুযোগ নিয়ে, আরও স্পষ্ট বাঙলায়, ঝোপ বুঝে কোপ মেরে প্রতিপক্ষকে বিবশ করে স্বাধীনতা হাসিল করা৷ এইখানেই ছিল তাঁর তৎকালীন নেতৃত্বের সঙ্গে কুলালত্বগত বিরোধ বা বৈষম্য৷ ....... গান্ধীবাদের তথাকথিত অহিংসা মন্ত্রে সরলতার ষোল আনা অভাব না থাকলেও কিছুটা অভাব ছিল৷ বৈয়ষ্টিক জীবনে গান্ধীজী যতটা সরল ছিলেন, হয়তো বা তাঁর অনুগামীরা ততটা ছিলেন না, যার ফলে এই কুলালত্বগত ভেদটা লোকলোচনে আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল৷ ...... সুভাষ বোস দেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন৷ ..... আর তা চেয়েছিলেন উদগ্র ভাবেই৷ তাই তিনি এ ব্যাপারে প্রকৃত সুযোগ সন্ধানীর ভূমিকাতেই নেবেছিলেন৷ এতে কেউ যদি তাঁর নিন্দা করে তাহলে বুঝতে হবে সে রাজনৈতিক জীবনে গায়ে আঁচড়টি না লাগিয়েই সস্তায় কিস্তিমাৎ করতে চেয়েছিল৷’

ইতোমধ্যে পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল৷ আর এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে গতিময় করার লক্ষ্যে সুভাষচন্দ্র হলেন অতিশয় তৎপর৷ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ব্রিটিশ বিরোধী শক্তিগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করতে লাগলেন৷ তাঁর এই তৎপরতার ফলে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪০ সালে  আবার তাঁকে গ্রেফতার করে৷ কিন্তু ভগ্ণস্বাস্থ্যের কারণে তাঁকে স্বগৃহে অন্তরীণ রাখার ব্যবস্থা করা হয়৷ অন্তরীণ অবস্থাতেও তিনি তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে যথাসাধ্য করতে থাকলেন৷ সুভাষচন্দ্র তখন দেশের বাইরে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ৷ হিটলারের হাতে মার খেয়ে ইংরেজ নিজের ঘর সামলাতে ব্যস্ত৷ এই অপূর্ব সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে প্রচণ্ড আঘাত হেনে ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী ক্ষুধাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে চাইলেন সুভাষ৷ এই উদ্দেশ্যে তিনি গোপনে গড়ে তুললেন এক মোক্ষম যোগসূত্র যার সঙ্গে যুক্ত হলেন বিভিন্ন খ্যাত-অখ্যাত বহু অসমসাহসী বীর বিপ্লবীগণ৷

অবশেষে ১৯৪১ সালের ১৭ই জানুয়ারী রাত্রি প্রায় ১-৩০মিনিটে  ভ্রাতুষ্পুত্র শিশির কুমার বসুর সহায়তায় মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে ইংরেজ শাসকের সদা সতর্ক প্রহরীদের শ্যেন দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে অন্তর্ধান করলেন দেশ জননীর  মুক্তি সংগ্রামের একনিষ্ঠ সাধক সুভাষচন্দ্র৷  হাজারো বিপদ সঙ্কুল যাত্রাপথের কষ্টকে  বরণ করে অকুতোভয়, অসমসাহসী সুভাষচন্দ্র কাবুল হয়ে পৌঁছে গেলেন মস্কো থেকে বার্লিন৷ তিনি সফর করলেন  ইটালি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়াও৷ পরবর্তী পর্র্যয়ে পাড়ি দিলেন টোকিও, সেখান থেকে সিঙ্গাপুর৷ শুরু হল সুভাষচন্দ্রের মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্যে চূড়ান্ত সংগ্রামের প্রস্তুতি--- পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, সমস্ত বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে৷

১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর হঠাৎ রেডিওর ইথার তরঙ্গে ভেসে এল সেই পরিচিত কন্ঠ, তেজোদ্দীপ্ত ভঙ্গিমায়---

‘আজাদ হিন্দ রেডিও, বার্লিন৷ আমি সুভাষ বলছি---

এত কাল আপনাদের আমার বক্তব্য বিষয় শোণানোর সুযোগ ছিল না৷ শত্রু যে অপবাদই দিক, আমি জানি আপনারা তা বিশ্বাস করেন না৷ আমি আমার কাজ করে চলে যাব, কে কি বলে, না বলে  তাতে আমার কিছু আসে যায় না৷ অক্ষশক্তির আক্রমণ থেকে  নিজেদের সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য যদি ব্রিটেন আজ আমেরিকার দ্বারস্থ হতে লজ্জা না পায়, তাহলে  ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অপর কোন জাতির সাহায্য প্রার্থী হওয়া আমার পক্ষে অন্যায়ও নয়, অপরাধও হতে পারে না৷

আপনারা আন্তর্র্জতিক পরিস্থিতির দিকে  লক্ষ্য রেখে প্রস্তুত থাকুন৷ আমি যেভাবে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টকে বিভ্রান্ত করে ভারতবর্ষ থেকে চলে এসেছি, ঠিক তেমনি করেই যথাসময়ে  আপনাদের  কাছে গিয়ে উপস্থিত হব৷  (ক্রমশ)