স্বদেশ প্রেমের অপর নাম---তেইশে জানুয়ারী - ২য় পর্ব

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

অবশেষে ১৯৪১ সালের ১৭ই জানুয়ারী রাত্রি প্রায় ১-৩০মিনিটে  ভ্রাতুষ্পুত্র শিশির কুমার বসুর সহায়তায় মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে ইংরেজ শাসকের সদা সতর্ক প্রহরীদের শ্যেন দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে অন্তর্ধান করলেন দেশ জননীর  মুক্তি সংগ্রামের একনিষ্ঠ সাধক সুভাষচন্দ্র৷  হাজারো বিপদ সঙ্কুল যাত্রাপথের কষ্টকে  বরণ করে অকুতোভয়, অসমসাহসী সুভাষচন্দ্র কাবুল হয়ে পৌঁছে গেলেন মস্কো থেকে বার্লিন৷ তিনি সফর করলেন  ইটালি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়াও৷ পরবর্তী পর্র্যয়ে পাড়ি দিলেন টোকিও, সেখান থেকে সিঙ্গাপুর৷ শুরু হল সুভাষচন্দ্রের মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্যে চূড়ান্ত সংগ্রামের প্রস্তুতি--- পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, সমস্ত বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে৷

১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর হঠাৎ রেডিওর ইথার তরঙ্গে ভেসে এল সেই পরিচিত কন্ঠ, তেজোদ্দীপ্ত ভঙ্গিমায়---

‘‘আজাদ হিন্দ রেডিও, বার্লিন৷ আমি সুভাষ বলছি---

এত কাল আপনাদের আমার বক্তব্য বিষয় শোণানোর সুযোগ ছিল না৷ শত্রু যে অপবাদই দিক, আমি জানি আপনারা তা বিশ্বাস করেন না৷ আমি আমার কাজ করে চলে যাব, কে কি বলে, না বলে  তাতে আমার কিছু আসে যায় না৷ অক্ষশক্তির আক্রমণ থেকে  নিজেদের সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য যদি ব্রিটেন আজ আমেরিকার দ্বারস্থ হতে লজ্জা না পায়, তাহলে  ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অপর কোন জাতির সাহায্য প্রার্থী হওয়া আমার পক্ষে অন্যায়ও নয়, অপরাধও হতে পারে না৷

আপনারা আন্তর্র্জতিক পরিস্থিতির দিকে  লক্ষ্য রেখে প্রস্তুত থাকুন৷ আমি যেভাবে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টকে বিভ্রান্ত করে ভারতবর্ষ থেকে চলে এসেছি, ঠিক তেমনি করেই যথাসময়ে  আপনাদের  কাছে গিয়ে উপস্থিত হব৷

যে সুযোগ আসছে সেটা সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হবে৷ সেজন্য নিজেরা জাতি ও ধর্মনির্বিশেষে  অবিলম্বে সংঘবদ্ধ হন৷  চাই ঐক্য ও একাগ্রতা৷’’

সুভাষচন্দ্রের এই বেতার ভাষণ শুণে সমগ্র দেশবাসীর মনে  স্বাধীনতা প্রাপ্তির একটা আশা ও আবেগের সঞ্চার হল৷

বাংলার আর এক কৃতী সন্তান বিপ্লবী রাসবিহারী বসু সিঙ্গাপুরে গড়ে তুলেছিলেন ‘আজাদ হিন্দ বাহিনী’৷ রাসবিহারী বসুর অনুরোধে সুভাষচন্দ্র গ্রহণ করলেন ‘আজাদ হিন্দ বাহিনী’র সর্র্বধিনায়কের দায়িত্ব৷ সুভাষচন্দ্রের অমায়িক ব্যবহার, শৃঙ্খলাপরয়ণতা ও তেজোদ্দীপ্ত ব্যষ্টিত্ব সকলকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছিল৷ বাহিনীর সকলে সুভাষচন্দ্রকে ভালবেসে ‘নেতাজী’ নামে সম্বোধন করতেন৷ সেই আজাদ হিন্দ  বাহিনীর ‘নেতাজী’ ক্রমশঃ আপামর ভারতবাসীর ‘নেতাজী’তে পরিণত হলেন৷ নেতাজীকে পেয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনীতে দেখা দিল এক অভূতপূর্ব প্রাণের জোয়ার৷ নেতাজী দৃপ্ত কন্ঠে আহ্বান জানালেন---‘‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো’’৷ নেতাজীর এই উদাত্ত আহ্বান বাহিনীর সৈন্য সামন্ত ও সাধারণ ভারতীয়দের মনে এক বিদ্যুৎ শিহরণ সঞ্চারিত করল--- যার অভিঘাতে দেশের স্বাধীনতার বেদীমূলে আত্মবিসর্জনের জন্যে সমস্ত ভারতবাসীর মধ্যে স্বদেশ প্রেমের প্রেরণা দেখা দিল৷ ১৯৪৩ সালের ৫ই জুলাই সিঙ্গাপুরের টাউন হলেরবিপরীত দিকের বিরাট মাঠে তাঁর সেনাবাহিনীকে সম্বোধন করে তিনি বলেছিলেন---‘‘সশস্ত্র সংগ্রাম করে ও রক্তের বিনিময়ে তোমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে৷ তারপর ভারত স্বাধীন হলে স্বাধীন ভারবর্ষের একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে হবে, যার কাজ হবে চিরকালের জন্য সেই স্বাধীনতা রক্ষা করা৷  আমাদের জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এমন অটল ভিত্তির ওপর গড়ে তুলতে হবে, যাতে ইতিহাসে আর কখনও যেন আমরা স্বাধীনতা না হারাই৷’’....

তিনি আরও বলেছিলেন ---‘‘আমি তোমাদের আশ্বাস দিতে পারি যে অন্ধকারে ও আলোকে,               দুঃখে ও আনন্দে, দুর্র্যেগ ও বিজয়ে আমি তোমাদের সঙ্গে থাকবো৷....

আমি তোমাদের ক্ষুধা তৃষ্ণা,কষ্ট, বিরামহীন সংগ্রাম ও মৃত্যু ছাড়া কিছুই দিতে পারি না৷ কিন্তু তোমরা যদি আমাকে জীবনে ও মরণে অনুসরণ করো, আমি তোমাদের নিয়ে যাব বিজয়ের ও স্বাধীনতার পথে৷’’

তিনি আহ্বান জানালেন--- হে আমার সৈনিক বৃন্দ! তোমাদের রণধবনি হোক -দিল্লি চলো ! চলো দিল্লি৷’’

স্বাধীনতা সংগ্রামে মহিলাদের যুক্ত করার জন্যে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজে গড়ে তুললেন ‘‘ঝাঁসীর রাণী  বাহিনী’’৷ তাঁর এই পদক্ষেপের ফলে নারীগণও দেশ জননীর মুক্তিযুদ্ধে  আরও বেশি করে  অংশগ্রহণ করতে  অণুপ্রাণিত হয়েছিলেন৷

অতঃপর পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত এলাকায় বসবাসকারী ভারতীয় সম্প্রদায়কে  জাতীয়তার নোতুন ভাবাদর্শে ও দেশপ্রেমে উদ্দীপিত করার জন্যে নেতাজী অক্লান্ত পরিশ্রম করতে লাগলেন৷

১৯৪৩ সালের ২১শে অক্টোবর সিঙ্গাপুরে এক ঐতিহাসিক সমাবেশে তিনি সরকারীভাবে ‘‘আজাদ হিন্দ সরকার’’ এর  ঘোষণা করলেন৷ জাপান, জামার্নি, ইটালিসহ নয়টি রাষ্ট্র  এই অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল৷ এটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়৷ এই  সরকার দুর্দমনীয় মনোবল নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করল  ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকার বিরুদ্ধে৷ দুর্গম ও দুর্লঙ্ঘ্য এলাকার মধ্য দিয়ে বীরবিক্রমে আজাদ হিন্দ বাহিনী জাপানি সৈন্যদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলতে লাগল৷ শেষ পর্যন্ত ১৯৪৪ সালের ১৮ই মার্চ ভারতের মণিপুরের মাটিতে  স্বাধীন জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হল৷ এই সময়ে নেতাজী তাঁর সৈন্যবাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেন---           ‘‘রক্ত দিচ্ছে রক্তের ডাক৷ ওঠ, নষ্ট করার মত সময় আমাদের নেই৷ অস্ত্র তুলে নাও৷ ওই তোমাদের সামনে পরে রয়েছে পথ--- যে পথ তোমাদের পূর্বসূরীরা তৈরী করে গেছেন৷ ওই পথ বেয়ে আমরা এগিয়ে যাব৷ শত্রু সেনাবাহিনী ভেদ করে আমরা এগিয়ে যাব৷  তবে, যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা হয়, আমরা শহীদের মৃত্যু বরণ করব৷ আমাদের শেষ নিদ্রায় আমরা সেই পথ  চুম্বন করবো যে পথ দিয়ে  আমাদের মুক্তি ফৌজ দিল্লী পৌঁছাবে৷ দিল্লির পথ স্বাধীনতার পথ! চল দিল্লী৷’’

কিন্তু প্রকৃতির বিমুখতায় দিল্লি অভিযান থমকে দাঁড়াল৷ প্রচণ্ড বৃষ্টি, দ্রুত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পটপরিবর্তন, ইংরেজ বাহিনীর  ব্রহ্মদেশ পুণর্দখল ও ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে জাতীয় নেতৃত্বের  ঔদাসীন্য ও অসহযোগিতায় আজাদ হিন্দ সরকারের পতন হয়৷  দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যেও নেতাজী মনোবলকে ধরে রেখে আবার নোতুন করে  রসদ সংগ্রহের অভিপ্রায়ে প্রাণপণ চেষ্টা শুরু করলেন৷ কখনো  দীর্ঘ পাহাড়ী পথ হেঁটে, কখনো বোমারু প্লেনে চড়ে, কখনো সাবমেরিনে সওয়ার হয়ে তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের পথে এগিয়ে চলতে লাগলেন৷

এই পরিস্থিতিতে ১৯৪৫ সালের অগাষ্ট মাসে আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওপর পারমাণবিক বোমা বর্ষণ করায়  মানব সমাজের ইতিহাসে অভূতপূর্ব ধবংস ও জীবনহানি হলো৷ এর পরেই ১৯৪৫ সালের ১৪ই অগাষ্ট জাপান মিত্রপক্ষের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে৷ পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়দের প্রতি বিশেষ বার্র্তয় নেতাজী জানান---‘‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি  গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সবে শেষ হলো৷ সেই অধ্যায়ে পূর্ব এশিয়ার ভারত সন্তানেরা অমর আসন লাভ করবে৷ আমাদের সাময়িক ব্যর্থতায় হতাশ হইও না৷  পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নাই, যে ভারতবর্ষকে আর শৃঙ্খলিত করে রাখতে পারে৷’’

এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই ১৯৪৫ সালের ২৩শে অগাষ্ট  আচমকাই টোকিও রেডিও থেকে ঘোষণা করা হয়, তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজী মৃত্যুবরণ করেছেন, যা ভারতবাসী তথা আপামর বাঙালী বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেননি৷ তাঁরা এ বিমান দুর্ঘটনাকে  সাজানো ও মিথ্যা প্রচার হিসেবে গ্রহণ করেন৷

পরবর্তীকালে খোসলা কমিশন, শাহনওয়াজ কমিশন, মুখার্জী কমিশন ইত্যাদি বিভিন্ন কমিশনের তদন্তও এই দুর্ঘটনাকে  সংশয়াতীতরূপে প্রমাণ করতে পারে নি৷ প্রকৃত পক্ষে সুভাষচন্দ্রকে দেশের মানুষের কাছে মৃত ঘোষণা করে  তাঁর দেশে প্রত্যাবর্তনের পথ রুদ্ধ করাই ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী  ও দেশীয় শোষকশ্রেণী পঁুজিবাদীদের মুখ্য উদ্দেশ্যে আর  এই ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছিলেন উচ্চাকাঙ্খী, ক্ষমতালোভী, অবিমৃষ্যকারী কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ যাঁরা ইতোপূর্বে সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন৷ তাঁদের আরও উদ্দেশ্য ছিল আজাদ-হিন্দ-বাহিনীর সৈন্য ও নেতাদের মনোবল ভাঙা আর দেশবাসীর মন থেকে নেতাজীকে মুছে ফেলা৷ তাই রেনকোজি মন্দিরে সুভাষচন্দ্রের চিতাভস্ম রক্ষিত আছে বলে যে প্রচার চালানো হয়েছে তা পৃথিবীর ঘৃণ্যতম ভাঁওতা ও ধাপ্পা ছাড়া কিছুই নয়৷ শুধু তাই নয়, স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের সেনাবাহিনীতে অন্যান্য প্রাদেশিক রেজিমেন্ট তৈরী হলেও ‘‘বাঙালী রেজিমেন্ট’’ নামে কোন রেজিমেন্ট নেই বা  আজাদ হিন্দ বাহিনীর ফৌজদের নিয়ে  কোন পৃথক রেজিমেন্টও গড়া হয়নি৷ আজাদ হিন্দ বাহিনীর সম্পত্তি ও অর্থ কোথায়, কিভাবে, কী পরিমানে,কার হেফাজতে রক্ষিত আছে-তারও প্রকৃততথ্য প্রকাশিত হয়নি৷ ভারতবর্ষের ক্ষমতালিপ্সু লোভী নেতৃবৃন্দ  দেশভাগের পরিবর্তে যে স্বাধীনতা হাত পেতে নিয়েছিল, তা শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতা৷  অথচ অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উত্তরাধিকারী পঁুজিপতিদের কব্জায়৷ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না পাওয়ার কুফল ভারতবাসীরা আজও সমানভাবে ভুগে চলেছে৷ শোষণের স্টীমরোলারের তলায়  চিড়েচ্যাপ্ঢা হয়ে৷

স্বাধীনতা সংগ্রামের একনিষ্ঠ সৈনিক ও স্বদেশ প্রেমের অত্যুজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন পর্যালোচনা করে আমরা পাই---         তিনি ছিলেন নৈতিকতার অতন্দ্র প্রহরী, আধ্যাত্মিকতায় দীপ্তিময়,আপোষহীন সংগ্রামী, দৃঢ়চেতা, সুদক্ষ সংঘটক ও উদার মানসিকতার মানুষ৷ তিনি কখনও কোনোরকম কুসংস্কার বা  চাপিয়ে দেওয়া মতবাদকে মেনে নেননি৷  তিনি কোন দয়ার দান বা ভিক্ষা হিসাবে স্বাধীনতাকে গ্রহণ করতে চাননি--- তিনি বিশ্বাস করতেন শত্রু ও শোষককে সম্মুখ সমরে পরাজিত করেই দেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব ও সেই স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা--- আর এই স্বাধীনতা অবশ্যই হতে হবে পূর্র্ণঙ্গ স্বাধীনতা, কোনো শর্র্তধীন খণ্ডিত স্বাধীনতা কখনই কাম্য হতে পারে না৷ এইখানেই অন্যান্য ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ছিল তাঁর পার্থক্য৷  রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে তিনি বৈশ্যতান্ত্রিক পুঁজিবাদকে সমর্থন করেননি, কারণ পঁুজিবাদী শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট দেশবাসী কখনই স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না৷ অবশ্য মার্ক্সীয় বস্তুতান্ত্রিক জড়বাদী সমাজতন্ত্রকেও ভারতীয় পরিবেশে প্রয়োগের তিনি ছিলেন বিরোধী৷ তিনি জানতেন ভারতবর্ষের কৃষ্টি, সংসৃকতি,ঐতিহ্য প্রোথিত রয়েছে সুদীর্ঘ কালের লালিত মৈত্রী,সম্প্রীতি ও আধ্যাত্মিকতার ভিত্তিভূমিতে৷  ভারতবর্ষ জ্ঞান-বিজ্ঞান,ত্যাগ-তিতিক্ষা ও মানবমিলনের দেশ৷ তাঁর সমাজতন্ত্রের ভাবনা সম্পর্কে নেতাজী বলেছেন---‘‘সে সমাজতন্ত্র কালমার্ক্সের পুঁথি থেকে জন্ম নেয়নি, এর উৎপত্তি ভারতবর্ষের আপন চিন্তাধারা ও  সংসৃকতির মধ্যে৷’’ বিবেকানন্দের ভাবশিষ্য আধ্যাত্মিকতার পূজারী নেতাজী উপলদ্ধি করেছিলেন যে অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে মানুষের বস্তুগত প্রয়োজনপূর্ত্তির সুসমন্বয়ই শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ৷ মানুষের জাগতিক, মানসিক, ও আত্মিক ত্রিবিধ উন্নতির মাধ্যমে প্রকৃত সমাজ গড়ে উঠতে পারে৷ বর্তমান পৃথিবীতে  বিশেষতঃ ভারতবর্ষে যে ধরণের সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক শোষণ চলছে-এই পরিস্থিতিতে  নেতাজীর আদর্শ সমানভাবে প্রাসঙ্গিক৷ মানুষে মানুষে হানাহানি, হিংসা, অসম্মান দুর্নীতি,ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাত ইত্যাদি সম্পর্কে অসহিষ্ণুতা ও  বিদ্বেষের পরিবেশ বর্তমানে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে৷ এর ফলে মানুষের পরিবার, সমাজ, দেশ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে৷ মানুষ সামাজিক জীব--- এককভাবে কেউ বাঁচতে পারে না৷ তাই সকলকে মিলে মিশে  সমাজ ও দেশকে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে, যার মূলে থাকবে আধ্যাত্মিকতার চালিকা শক্তি---এই নীতিকেই নেতাজী তার সমাজ গঠনের মূলমন্ত্ররূপে গ্রহণ করেছিলেন৷

নেতাজী তাঁর ‘‘তরুণের স্বপ্ণ’’গ্রন্থে লিখেছেন ---‘‘বঙ্গ জননী একদল নবীন সন্ন্যাসী চান৷ ভাই সকল, কে তোমরা আত্মবলিদানের জন্য প্রস্তুত আছ, তোমরা এসো, তোমাদের সকলের প্রয়োজন আছে৷ মায়ের হাতে পাবে তোমরা দুঃখ-দৈন্য,ক্লেশ, কারাযন্ত্রণা৷ এসব যারা নীরবে নীলকন্ঠের মত সহ্য করতে পার, তারাই এসো৷’’

অর্র্থৎ দেশ জননীর জন্যে নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের সংকল্পই  তিনি তরুণদের সামনে আদর্শরূপে তুলে ধরেছেন৷ নেতাজীর আদর্শে সমাজ নির্র্মণ করতে হলে যেটা সর্র্বগ্রে প্রয়োজন তা হলো প্রকৃত মানুষ তৈরী করা যাঁদের আধ্যাত্মিকতার মান হবে অতি উচ্চ ও যাঁরা ত্যাগ ও নিঃস্বার্থ সেবার জন্যে সদা প্রস্তুত৷ বর্তমানে যেসব নেতা নেত্রীর দ্বারা সমাজ পরিচালিত তাদের সকলেই সুবিধাবাদী, দলসর্বস্ব মানসিকতা সম্পন্ন৷ দল ও নিজের স্বার্থ ছাড়া দেশবাসীর সুখ সুবিধা বোঝার সামর্থ্য, ঔদার্য্য বা বৌদ্ধিক প্রাখর্য্য তাদের নেই৷ রাজনৈতিক দলগুলিও আদর্শহীন, নৈতিকতাহীন ও যেন তেন প্রকারেন ক্ষমতা লাভের অভিলাষী৷ এমতাবস্থায় এমন একটা সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন প্রয়োজন যা শোষিত বঞ্চিত মানুষের দুঃখ দুর্দশা দুর করতে সমর্থ নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের জীবনদর্শনও  এই আদর্শের অনুসারী৷ আর এই আদশই মূর্তরূপ পেয়েছে মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তিত প্রাউট দর্শনের মধ্যে৷

সামাজিক-অর্থনৈতিক দর্শন ‘প্রাউট’ বা ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’ এর ভিত্তিভূমি হলো আধ্যাত্মিকতা যা ছিল নেতাজীর সমাজচিন্তার মূল উপজীব্য৷ প্রাউট দর্শন অনুযায়ী বিশ্বের সমস্ত সম্পদের সৃষ্টিকর্তা পরমব্রহ্ম ও তিনিই সকল সম্পদের মালিক৷ জীব-জড়-উদ্ভিদ-মানুষ সকলেই তাঁর সৃষ্টি ও সন্তান সন্ততি৷ সুতরাং পৃথিবীর সমস্ত সম্পদে সকলের ভোগদখলের অধিকার রয়েছে৷ কেউ যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় করে৷ তবে অন্যেরা বঞ্চিত ও শোষিত হতে বাধ্য৷ প্রত্যেকের নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্তির ব্যবস্থা করতে হবে ও বিজ্ঞান প্রযুক্তির সাহায্যে সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে৷ মানুষের চাহিদা অসীম ও এই অসীম চাহিদা সীমিত জাগতিক সম্পদের দ্বারা মেটানো অসম্ভব৷  তাই মানুষের অনন্ত চাহিদাকে অনন্ত মানসিক ও আধ্যাত্মিক জগতে চালিত করতে হবে বিশেষ আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে৷ আধ্যাত্মিকতার পথেই মানুষের মন হবে শান্ত ও তৃপ্ত-লোভ, হিংসা ও দুর্নীতি ক্রমশঃ কমতে থাকবে৷ ফলে  সমাজে অন্যায় অবিচার ও শোষণ কমে যাবে৷

শুধুমাত্র মানুষই নয়,নব্যমানবতাবাদের প্রয়োগে উদ্ভিদ, প্রাণীজগৎ ও জড়ের উন্নতি বিধানেও মানুষের প্রজ্ঞাকে  কাজে লাগাতে হবে৷  কারণ, মানুষের অস্তিত্ব উদ্ভিদ, অন্যান্য প্রাণী ও জড়ের ওপর নির্ভরশীল৷ বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টি পরমপুরুষের সন্তান---এই আদর্শে উদ্বোধিত হয়ে সমগ্র পৃথিবীর জীব জড় উদ্ভিদকে ভালবাসতে পারলে পৃথিবী থেকে হিংসা, দ্বেষ,ভেদাভেদ,হানাহানি দূর হয়ে প্রকৃত শোষণহীন সমাজ গড়ে উঠবে৷ এই সমাজের নেতৃত্বে থাকবেন আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত, নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত,বলিষ্ঠ চারিত্রিক দৃঢ়তা সম্পন্ন ব্যষ্টিগণ যাঁদের বলা হয় সদবিপ্র৷ নেতাজীর আদর্শও ছিল  এইরকম নীতিবাদী, আপোষহীন, সত্য ও ন্যায়ের উপাসক ব্যষ্টিগণের দ্বারা পরিচালিত শোষণহীন মানব সমাজ গঠন৷ তাই নেতাজীর আদর্শকে অনুসরণ করে শোষণমুক্ত সুন্দর সমাজ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে একমাত্র সমাধান প্রাউট দর্শন ও নব্যমানবতার প্রতিষ্ঠা আর প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে সাধনা সেবা ও ত্যাগের মাধ্যমে এই কাজকে তরান্বিত করতে এগিয়ে আসতেই হবে৷ তখনই দেশনায়ক মহান বিপ্লবী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সম্ভব ও ২৩শে জানুয়ারীতে ‘নেতাজী  জয়ন্তী’ উদ্যাপন সার্থক হবে৷

সহায়তা গ্রহণ ঃ---

বাংলা ও বাঙালী  - শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার,

আমি সুভাষ বলছি - শ্রী শৈলেশ দে,

অনির্র্বণ জ্যোতি  - শিশির কুমার বসু

ও অন্যান্য পুস্তকাদি৷