স্বদেশ প্রেমিক কবি

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

হ্যারিসন রোডে ‘বেঙ্গলী’ সাপ্তাহিক পত্রিকার কার্যালয়ে বসে আছেন সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন একজন স্বদেশ প্রেমিক কবি৷

কথা প্রসঙ্গে বললেন সুরেন্দ্রনাথ, ‘জানেন, এবার দেওঘরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হার্ড সাহেবকে খুব জব্দ করেছি৷ সে একজনকে বেআইনী বেত মেরেছিল৷ আমি কাউন্সিলে সে প্রশ্ণ তুলেছি৷ কটন সাহেব এক সপ্তাহ প্রশ্ণটি স্থগিত রাখতে অনুরোধ করেছিলেন৷ তাতে আমি রাজী হইনি৷ আগামীকালই প্রশ্ণটি কাউন্সিলে উঠবে৷ কবি তাতে মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না৷ তাতে সুরেন্দ্র-পক্ষীয়রা খুব চটে গেলেন৷.....

অনেক তর্কবিতর্কের পর কবি শেষে  বিদ্রুপ করে বললেন, ‘বেশ তো, তাহলেই হার্ড সাহেবের ফাঁসি হয়ে যাবে, আর আগামী সপ্তাহের মেলেই সমস্ত ইংরেজ ভারত ছেড়ে পালিয়ে যাবে৷’’

এহেন ব্যঙ্গে সুরেন্দ্র-পক্ষীয়রা আরো উত্তেজিত হয়ে পড়লেন৷ শুরু হলো বচসা---কবির নিন্দা৷

কবিও ছাড়বার পাত্র নন৷ বেশ কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটির পর তিনি বললেন, ‘দেখুন সুরেন্দ্রনাথ বাবু আপনার  গতিবিধি শুধু ব্যারাকপুর টু কলকাতা, আর কলকাতা টু ব্যারাকপুর ৷ দেশের  দুরবস্থা আপনি কখনো চোখে দেখেননি৷ তাই কোথায় কোন হার্ড সাহেব কোন অভাগাকে দু-ঘা বেশী বেত মেরেছেন৷  তাই নিয়ে আপনি তোলপাড় করছেন৷  এরই নাম পলিটিক্যাল এজিটেশন’৷ ধরে নিলাম আপনার এ আন্দোলনের জন্য হার্ড সাহেবের কিঞ্চিত পানিশমেন্ট হবে, তাতে দেশের কতটুকু উপকার? আপনি  ঘোরেন নি---কিন্তু আমি ঘুরেছি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল৷ আমি দেখেছি বাঙালীর ঘরে অন্ন নেই৷ পুকুরে জল নেই৷ চৈত্র বৈশাখ মাসে আমি ছিলাম রানাঘাটে৷

সেখানে দেখেছি, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা এক ঘটি জলের জন্য হাহাকার করছে৷ ঘরের বউরা কলসী কাঁখে নিয়ে দু-তিন মাইল হেঁটে যাচ্ছে পানীয় জল আনতে৷ পুরনো খাল-বিল-পুকুর-ইদারা সংস্কারের অভাবে সব বুজে গেছে৷ যাদের দুটো পয়সা আছে তারা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে কোলকাতা শহরে৷ কি আছে বাঙলার গ্রামে? না আছে অন্ন, না আছে জল৷ বাঙলার গ্রাম আজ ম্যালেরিয়ার চাষ ভূমি৷ রোগ হলে এক কণা ওষুধ পায় না গ্রামবাসীরা৷ কই আপনারা তাদের জন্যে তো কখনো মাথা ঘামান না৷ উলা, সিমলা, মালিপোতা, চাকদহ, গোঁড়-পাড়া,জাগুলি সুবর্ণপুর- কে না জানে এককালে  এইসব গ্রাম  ধনধান্যে পূর্ণছিল৷ কিন্তু আজ সে-সব শ্মশানের মত খাঁ খাঁ করছে৷ বিশ্বাস করুন সুরেন্দ্রনাথবাবু আমি স্বচক্ষে দেখেছি, গ্রামের যুবতী মেয়েরা সব চাইতে  নিকটে যে ‘বাঁওড়া’---তা পাঁচ মাইল দূরে অবস্থিত --- তা থেকে জল আনছে৷ আর সে জল এমন দূষিত যে কলকাতার পশুরাও তাতে মুখ দেবে না৷ আপনারা কি এর কোন প্রতিকার করতে পারেন না?’

এতোগুলো কথা একনাগাড়ে বলে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লেন কবি৷ শেষে দম নিয়ে আবার বললেন, সুরেন্দ্রনাথবাবু এখন কিছুদিন শিকের তুলে রাখনে আপনাদের ন্যাশনাল কংগ্রেস---স্বায়ত্ত শাসনের স্বপ্ণ৷ গরীব গ্রামবাসীদের দুই মুঠো অন্ন আর এক ঘটি জলের ব্যবস্থা আপাতত করুন৷ সুরেন্দ্রনাথের হৃদয়টি যেন ব্যথায় গুমড়ে উঠলো৷ তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠলো দেশের আসল রূপটি৷ সে-রূপ দেখে কে পারে চোখের জল সামলাতে?

সুরেন্দ্রনাথ সকাতরে কবির হাতখানা ধরে বললেন, ‘ঠিক জিনিসটি ধরিয়েছেন আপনি৷ এবার বলুন রানাঘাটের জলের সুব্যবস্থার জন্য কি করতে হবে আমাকে?’

কবি কাউন্সিলে তুলবার জন্য জল সংক্রান্ত প্রশ্ণ লিখে দিলেন সুরেন্দ্রনাথকে৷ ....সুরেন্দ্রনাথ তা যথাসময়েই কাউন্সিলে তুললেন৷

তার আগে কবি নিজেই কলকাতার সব কাগজে রানাঘাটের জলকষ্ট বর্ণনা করে জনগণকে উত্তেজিত করে তুললেন৷ অনেক লেখালেখি ও আন্দোলনের পর ফল শুভই হলো৷ জলকষ্ট নিবারণের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ টাকা ব্রিটিশ সরকার ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের বাজেটে নির্ধারিত করলেন৷ সেই থেকে শুরু হলো রানাঘাটের জলকষ্ট  ‘ নিবারণের কর্মসূচী’৷ কিন্তু যে কবির দ্বারা রানাঘাটের গ্রামবাসীর এতো বড় একটা উপকার সাধিত হলো, সে কবিটির পরিচয় তোমরা জানো? না জানলে জেনে রাখো৷ সে কবিটিই হচ্ছেন আমাদের প্রিয় কাব্য ‘পলাশীর যুদ্ধে’র লেখক নবীনচন্দ্র সেন৷ ১০ই ফেব্রুয়ারী কবি নবীনচন্দ্র সেনের জন্মদিন৷ ১৮৪৭ সালের এই দিন অবিভক্ত  বাঙলার চট্টগ্রামের নয়াপাড়ায় কবির জন্ম৷