স্বধর্ম ও পরধর্ম

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

ভক্তের সম্পর্কে, সাধকের সম্পর্কে, পরমপুরুষের প্রতি যার প্রেম রয়েছে তার সম্পর্কে ভগবান কৃষ্ণের কিছু মূল্যবান উক্তি রয়েছে৷ সম্বন্ধে আজ আমি কিছু বলব৷

ভগবান বলছেন,

 ‘‘শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ 

               পরধর্মাৎ স্বানুষ্ঠিতাৎ৷

স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ

              পরধর্মো ভয়াবহঃ৷৷’’

স্বধর্ম হচ্ছে সব থেকে মূল্যবান বস্তু৷ যদি পরধর্মের অনুশীলন করতে খুব ভালও লাগে, পরধর্মের অনুশীলন যদি সহজও হয়, তাহলেও মানুষের উচিত স্বধর্মের অনুশীলনে দৃ নিষ্ঠা রাখা৷ এখন, এই স্বধর্ম কী? প্রতিটি বস্তুর নিজ নিজ  ধর্ম সত্তাগত বৈশিষ্ট্য আছে৷ অক্সিজেনের একটা সত্তাগত বৈশিষ্ট্য বা property আছে, নাইট্রোজেনের একটা সত্তাগত  বৈশিষ্ট্য আছে৷ আর এই সত্তাগত বৈশিষ্ট্যই বস্তুর পরিচিতি বহন করে৷ দুধের রঙ যদি সাদা না হয়, তাহলে মানুষ তাকে দুধ বলে মানবে না৷ জলে যদি তৃষ্ণা নিবারণের ক্ষমতা না থাকে, তাকে জল বলে কেউ মানবে না৷ অগ্ণিতে যদি দাহিকাশক্তি না থাকে, তাহলে কেউ তাকে অগ্ণি বলবে না৷ বস্তুর পরিচিতি তার ধর্মেই৷

ঠিক এইভাবে মানুষেরও স্বধর্ম আছে৷ এই স্বধর্মের জন্যে অন্য জীব থেকে সে পৃথক৷ অক্সিজেন নিজের স্বধর্মের জন্যে নাইট্রোজেন বা হাইড্রোজেন থেকে পৃথক৷ ঠিক এমনিভাবে মানুষও জীব, কুকুরছাগলমুরগী জীব কিন্তু জীব হলেও মানুষের একটা বিশেষত্ব আছে, তা মানবধর্ম৷ এটাই মানুষের জন্যে স্বধর্ম৷ আর মানুষের স্বধর্ম কী? পরমপুরুষকে পাওয়ার জন্যে সচেষ্ট হওয়া৷ পশুজীবন জড়াত্মক৷ খাওয়া মরাএটাই পশুধর্ম৷ মানুষের ক্ষেত্রে তা নয়, মানুষের জীবনটা পশুর মত নয়৷ পশুর ক্ষেত্রে খাওয়াটা মুখ্য ক্রিয়া৷ বিড়ালকে লাথি মার, পাঁচ মিনিট পরে আবার মাছ খাওয়ার জন্যে আসবে৷ কেননা, বিড়ালের জীবনে খাওয়াটাই মুখ্য কাজ৷ খাওয়া, মরণকে বরণ করা জীবনধারণ করা মনুষ্যেতর জীবের এইটাই মুখ্য ক্রিয়া৷ আর মানুষের মুখ্য জীবনবৃত্তি হচ্ছে পরমপুরষের উপাসনা করা, পরমপুরুষকে ভালবাসা৷ মানুষের শরীর, মন আত্মা আছে৷ সাধনা করতে গেলে তাকে বেঁচে থাকতে হবে৷ বেঁচে থাকার জন্যে, অন্নবস্ত্রাদির প্রাপ্তির জন্যে তাকে প্রচেষ্টা চালাতে হবে৷ কিন্তু এটা মুখ্য কাজ নয়৷ যাতে সে সাধনা করতে পারে, তার জন্যেই অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করতে হবে৷ এই কারণে অন্নবস্ত্রাদি মানুষের জন্যে মুখ্য নয়৷ আর এই কথাটাই যখন মানুষ ভুলে যায়, তখনই তার পতন হয়, তার অধোগতি হয়ে যায়৷ সে পরধর্মে চলে যায়, মানব ধর্মে আর থাকে না৷ মানুষের এই যে স্বধর্ম তা ভাগবত ধর্ম, তাই মানবধর্ম৷ এখানে ধর্ম মানে রেলিজিন religion) নয়৷ ধর্ম মানেপ্রপার্টি’–সত্তাগত বৈশিষ্ট্য, ধর্ম মানে স্বভাব৷

 

ভগবান কৃষ্ণ বলছেন, ‘স্বধর্ম পালনে যদি কষ্টও হয়, এমনকি মরণও হয়, তাহলেও স্বধর্মে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকা উচিত৷ স্বধর্মের জন্যে মৃত্যু হয় তো হোক, তাতে কিছু যায় আসে না৷ কিন্তু মনুষ্যত্ব থেকে আমরা দূরে সরে যাব না, মানবধর্ম থেকে দূরে সরে যাব না৷

‘‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ, পরধর্মো ভয়াবহঃ৷’’

এমনকি স্বধর্মে থেকে যদি মৃতুও হয়, হোক, মানুষ রূপেই মৃত্যু হোক, পশুরূপে নয়৷ পাপের সঙ্গে আপোষ করে মরব না৷ তাই, মনে রাখবে, যে ভক্ত, যে সাধক, যে পরমপুরুষকে ভালবাসে, সে কখনও পাপের সঙ্গে আপোষ করবে না৷ সে ষোল আনা আদর্শে দৃ থাকবে৷পনেরো আনা আদর্শে দৃঢ় থাকলুম, এক আনা পাপের সঙ্গে আপোষ করলুম, তা চলবে না৷ তাই কোনদিন এধরনের কাজ করবে না৷

পরধর্মো ভয়াবহ যা পশুর ধর্ম, যা ভাগবত ধর্ম নয়, মানব ধর্ম নয়, তা ভয়াবহ কেন? কারণ এর ফলে নিজের অধোগতি তো হয়ই, অসৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্যে অন্য মানুষের ক্ষতি হয়৷ এটা কুদৃষ্টান্ত৷ মানবধর্ম থেকে বিচ্যুত হওয়া, কেবল পাতকের কাজ নয়, মহাপাতকের কাজ৷ কারণ এর দ্বারা অন্যান্য মানুষও কুকর্ম শিখবে৷ কুভ্যাস শিখবে৷

সমস্ত বস্তু নিজের গতিতে চলে, চলতে চলতে কালের প্রভাবে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ফলে তার গতির দ্রুতি ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে৷The speed is slowly retarded, এই অবস্থায় তাতে আবার দ্রুতি আনবার জন্যে, acceleration আনবার জন্যে, শক্তি সম্প্রয়োগ দরকার৷ শক্তি সম্প্রয়োগ না করলে কাজ হবে না৷ হতে পারে শক্তি সম্প্রয়োগ করলে তার সাময়িক কষ্ট হবে, সাময়িক কালের জন্যে অন্যে ভুল বোঝাবে, তবুও তা করতে হবে৷ যখন মানুষ দেখবে সমাজের গতিতে দ্রুতি নেই, তখন দ্রুতি আনবার জন্যে যারা শক্তি সম্প্রয়োগ করবে, তারাই ' সদ্বিপ্র৷ তারা সমাজের বরেণ্য, পূজনীয়, সমাজের পথপ্রদর্শক৷ আর সদ্বিপ্রদের প্রেরণা দেওয়ার জন্যে, অনেক যুগের পরে, যখন দেখা যায়, সদ্বিপ্রদের গতিও হ্রাস পেয়ে গেছে তখন সদ্বিপ্রদের মজবুত করে গড়ে তোলবার জন্যে পরমপুরুষকে নিজেকে আসতে হয়৷

এইজন্যে ভগবান বলেছেন,

‘‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত৷

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনং সৃজাম্যহম্৷৷’’

যখন ধর্মের গ্লানি আসে, গতি রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন সমাজে গতি আনবার জন্যে, গতিতে দ্রুতি আনবার জন্যে পরমপুরুষকে তারক ব্রহ্মরূপে অবতীর্ণ হতে হয়৷