সদ্বিপ্রের নেতৃত্ব

লেখক
সংকলন ঃ জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

(প্রাউট প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের রচনা সম্ভার থেকে সংগৃহীত)

প্রতিটি চলমান সত্ত্বাকে নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে প্রয়োজন সার্থক নেতৃত্ব৷ গন্তব্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে নৌকার জন্যে একজন কাণ্ডারী, ট্রেন-বাসের জন্যে ড্রাইভার যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনই মানব সমাজের প্রগতির জন্যেও প্রয়োজন প্রকৃত নেতৃত্বের যাঁরা সমগ্র সমাজকে নির্ভুল দিশায় এগিয়ে নিয়ে যাবেন৷ সমাজ সম্পর্কে আলোচনায় প্রাউট প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---

‘‘নীতিবাদের স্ফূরণ থেকে বিশ্বমানবত্বে প্রতিষ্ঠা, এ’দুয়ের মাঝখানে রয়েছে যেটুকু অবকাশ তা’কে অতিক্রম করার যে মিলিত প্রয়াস তারই নাম সামাজিক প্রগতি৷ আর যারা মিলে’মিশে’ চেষ্টা করে’ এই অবকাশটুকু জয় করবার প্রয়াসে রত হয়েছে, তাদেরই নাম দেব একটা ‘সমাজ’৷’’ (মানুষের সমাজ, প্রথম খণ্ড)

সমাজ শব্দটি বিশ্লষণ করলে পাই---সমানম্ এজতে ইতি সমাজঃ, অর্থাৎ নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যের পানে একসঙ্গে মিলেমিশে চলা৷ এই চলার মূল চালিকা শক্তি হ’ল নীতিবাদ৷

‘‘ ‘নীতি’ শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হ’ল যার মধ্যে নিয়ে যাবার ভাব রয়েছে৷......তাই নীতি হচ্ছে একটাliving force যার সাধনা মানস সত্তাকে অধিকতর মননশীলতার মাধ্যমে চরম সূক্ষ্মত্বে---পরম প্রজ্ঞায় সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে৷ যেখান থেকে মানুষকে আর কোথাও নিয়ে যাবার প্রশ্ণ থাকে না---সেখানে পর্যন্ত নিয়ে যাবার প্রেরণা দিতে পারলে তবেই ‘নীতি’ নাম সার্থক হয়ে ওঠে৷

নীতিবাদ কোনো ভাববাদীর স্বপ্ণবিলাস নয়, কোনো জড়বাদীর প্রয়োজন পূর্ত্তির ব্যবস্থা মাত্রও নয়৷ নীতিবাদ এমনই একটা জিনিস যা’ লোকায়ত বস্তুভাবকে লোকোত্তর প্রজ্ঞাভাবে মিশিয়ে দেবার সকল সম্ভাবনা নিয়েই মানুষের সামনে হাজির হয়ে’ থাকে৷.....মনের রাখতে হবে যে, যে নীতিবাদের উপর মানুষের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত সেই নীতিবাদ শেষ পর্যন্ত মানবতার চরম বিকাশের স্তরে যখন তাকে’ পৌঁছিয়ে দেয়  তখনই তার ব্যবহারিক মূল্যটুকু যথাযথভাবে উপলব্ধ হয়৷’’ (মানুষের সমাজ, প্রথম খণ্ড)

‘‘মনের যে বিশেষ ভাবগত আদর্শ মানুষকে ভূমাভাবে পৌঁছবার প্রেরণা যোগায় তাকেই বলা হয় নীতিবাদ৷ সমাজ জীবনকে এই নীতিবাদ থেকেই যাত্রা আরম্ভ করতে হয়৷ এই যাত্রার গন্তব্যস্থল ভূমা মানবত্বে প্রতিষ্ঠা, অর্থাৎ মানুষের মনের ততখানি বেশী বিকাশ ও বিস্তার যেখানে বিশ্বের প্রতিটি মানুষই তার আওতায় এসে যায়৷ এই যাত্রার পাথেয় হ’ল সাধনা৷ তাই বলা হয়েছে---নীতি হ’ল জীবনের মূল ভিত্তি, সাধনা হ’ল উপায় ও দিব্য জীবন লাভ হ’ল লক্ষ্য৷’’

(কণিকায় প্রাউট, ষোড়শ খণ্ড)

সৃষ্টির ধারাপ্রবাহে প্রথম দিকের অরণ্যচারী, পাহাড়-পর্বতের গুহাবাসী মানুষ ক্রমবিবর্তনের পথ বেয়ে প্রস্তর যুগ, লৌহ যুগ ইত্যাদি পেরিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে উপনীত৷ হাতি বা ভেড়ার মত মানুষও যূথবদ্ধ জীব---একাকী থাকা পছন্দ করে না, অনেকের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে ভালবাসে৷ নিজেদের প্রয়োজনে ও স্বভাবগত ভাবেই মানুষ বিভিন্ন সময়ে গড়ে তুলেছে সমমনোভাবাপন্নদের্ নিয়ে এক-একটা গোষ্ঠী, দল, উপদল৷ প্রত্যেক দল বা গোষ্ঠীর নেতৃত্বে যাঁরা থাকেন তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব অন্য সকলে মেনে নেয়৷ ভেড়ার ক্ষেত্রে দেখা যায় কোন একটি ভেড়া চলতে চলতে কোন গর্তে লাফ দিলে অপরাপর সব ভেড়াগুলিও একইভাবে সেই গর্তে লাফিয়ে পড়ে৷ মানুষের সমাজেও যাঁরা নেতৃত্বে থাকেন তাঁদের নির্দেশেই সমাজের গতি নির্ধারিত হয়৷ সেই কারণে সমাজের নেতৃত্বে যাঁরা থাকবেন তাঁরা যদি যথাযথ নেতৃত্ব না দিতে পারেন তবে সেই সমাজও ভেড়াদের মতই অন্ধগহ্বরে পতিত হবে৷ অতএব মানুষ সমাজের নেতৃত্ব সুযোগ্য ব্যষ্টিদের হাতেই ন্যস্ত থাকা আবশ্যক৷

মানব জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের মানুষ কখনো রাজতন্ত্র, কখনো গণতন্ত্র, কখনো সমাজতন্ত্র---প্রভৃতি শাসনব্যবস্থায় পরিচালিত হয়েছে৷ রাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে রাজা, জমিদার বা সামন্তপ্রভুরাই সমাজের নেতৃত্ব দিয়েছেন৷ তাদের শাসনাধীন মানুষজন তাদের নির্দেশেই পরিচালিত হয়েছেন৷ এই শাসকেরা ছিলেন একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী৷ ফলে সুশাসকের অধীনে জনগণের প্রভূত উন্নতি, সমৃদ্ধি, সুখশান্তি ছিল, আবার উল্টোদিকে স্বার্থপর, অত্যাচারী, দুষ্ট প্রকৃতির শাসকের অধীনে জনগণের দুঃখকষ্ট ও দুর্দশার অন্ত ছিল না৷ পরবর্তী পর্যায়ে দেশে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্ত্তিত হয়৷ গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে জন প্রতিনিধিগণ প্রশাসনের দায়িত্ব লাভ করেন---যা বর্তমান সমাজেও প্রচলিত রয়েছে৷ বিভিন্ন দেশের শাসন ব্যবস্থা সেই দেশের সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয় ও জনপ্রতিনিধিগণও সংবিধান নির্দেশিত উপায়েই নির্বাচিত হন৷ সাধারণতঃ দেশের নাগরিকগণ একটি নির্দিষ্ট বয়ঃসীমার পরেই প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকারী হন ও প্রতিনিধিগণও নির্দিষ্ট বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রাপ্ত হলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন৷ এক্ষেত্রে নির্বাচক বা নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বীদের  নৈতিক মান, সামাজিক-রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সচেতনতার কোনও ভূমিকা থাকে না৷ ফলে নির্বাচনের সময় আমরা বিভিন্ন প্রকারের দুর্নীতি, অর্থশক্তি-পেশীশক্তির প্রয়োগ দেখতে পাই৷ প্রকৃতপক্ষে পুঁজিপতিদের কাছে গণতন্ত্র হচ্ছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা৷ পুঁজিপতিদের স্বভাবই হ’ল জাগতিক সম্পদ কুক্ষিগত করা ও এর জন্যে তারা যে কোন অন্যায় পন্থা বা দুর্নীতির আশ্রয় নিতে কুণ্ঠিত নয়৷ নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি ও মুনাফার জন্যে সাধারণ মানুষের যৎপরোনাস্তি দুর্দশা হলেও তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ থাকে না৷ শুধু তাই নয়, অর্থশক্তির বলে প্রশাসন যন্ত্রকে তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে ব্যবহার করে ও দেশীয় অর্থনীতিকে তাদের অঙ্গুলী হেলনে নিয়ন্ত্রণ করে৷ রাজনৈতিক দলগুলি ও প্রশাসনে তাদের প্রতিনিধিরা সুবোধ বালকের মত পুঁজিবাদীদের নির্দেশিত পথে চলতে বাধ্য হয়৷

এই ব্যবস্থার বিপরীতে বেশ কিছু দেশ ও রাজ্যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে যার নেতৃত্বে রয়েছে কমিউনিষ্টগণ৷ কিন্তু এই সমাজ ব্যবস্থাতেও প্রকৃত নেতৃত্ব থাকে পলিটব্যুরোর গুটিকয়েক নেতৃস্থানীয় ব্যষ্টির হাতে৷ কমিউনিষ্ট ব্যবস্থায় সর্বহারা নেতৃত্বের কথা বলা হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে প্রশাসক হিসেবে যারা নির্বাচিত হন তারা কেউই সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েত নন৷ তাছাড়া কমিউনিষ্ট শাসন ব্যবস্থাও নির্বাচনের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার কারণে সেই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পুঁজিপতিদের প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে থাকে ও প্রশাসকগণ ধীরে ধীরে পুঁজিপতিদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়৷ তাই এই শাসনব্যবস্থাও প্রচ্ছন্ন পুঁজিবাদী শাসনেরই নামান্তর ও পুঁজিবাদের সর্বপ্রকার ত্রুটিযুক্ত৷ ফলে ওপরে বর্ণিত সবক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের ওপর পুঁজিবাদী শোষণের ষ্টীম রোলার সমানেই চলতে থাকে৷ মানুষের সর্ববিধ শোষণমুক্তির জন্যেই প্রাউট দর্শনে সদ্বিপ্র নেতৃত্বের কথা বলা হয়েছে৷ সদ্বিপ্র সম্বন্ধে প্রাউট প্রবক্তা বলেছেন---

‘‘যম-নিয়মে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, সুসংবদ্ধ চিন্তাধারা, সুপরিকল্পিত কার্যপ্রণালীর ভিত্তিতে মানব জাতির দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উত্তরণের জন্যে যাঁরা সর্বদা সচেষ্ট, সেই সব আধ্যাত্মিক বিপ্লবীরাই হচ্ছেন ‘সদ্বিপ্র’৷’’ ....

‘‘সদ্বিপ্র নিষ্ক্রিয় সাক্ষীগোপাল নয়৷ কোন ব্যষ্টি অথবা শ্রেণী যাতে অন্যদের ওপর শোষণ করতে না পারে সেজন্য সদ্বিপ্ররা থাকবে সদা তৎপর৷ এই কারণে সদ্বিপ্রদের হয়তো স্থূলশক্তি সম্প্রয়োগও করতে হতে পারে, কারণ তাদের লড়তে হবে সেই শক্তি-কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যারা শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চলেছে৷ যেক্ষেত্রে ক্ষত্রিয় শ্রেণী শোষক হয়ে উঠেছে, সেক্ষেত্রে সদ্বিপ্রদের স্থূলশক্তির সাহায্য নিতে হতে পারে৷ বিপ্রযুগে যখন বিপ্ররা শোষণের মাধ্যমে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে চলেছে তখন বিপ্লব আনতে হবে বৌদ্ধিক জগতে৷ আর যেহেতু গণতান্ত্রিক সংরচনা বৈশ্যদের পুঁজির পাহাড় সৃষ্টি করতে সাহায্য করে সেজন্যে গণতন্ত্রের সাহায্যেই বৈশ্য শ্রেণীর শাসন চলতে থাকে৷ আর তাই এই বৈশ্য শোষণের যুগে সদ্বিপ্রদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হওয়ার কৌশল অর্জন করার প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিতে পারে৷’’ --(কণিকায় প্রাউট, ৩য় খণ্ড     (ক্রমশঃ)