শিলচরের বাংলা ভাষা শহীদদের স্মরণে

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

১৯৬১ সালের ১৯শে মে শিলচরে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার দাবীতে বাঙালীদের আন্দোলন ও পুলিশের গুলিতে ১১ জনের শহীদ হওয়ার ঘটনাকে আজ ভারতের বাঙালীরা প্রায় ভুলেই গেছে বললে হয়৷ অসমের বরাক উপত্যকা চিরকালই বাঙলাভাষী এলাকা৷ কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের চক্রান্তে ও স্বাধীনতার পর হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ফলে বাঙলাভাষী বিশাল এলাকা অসমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়৷ শুধু তাই নয়, বাঙালীদের মাতৃভাষা–শিক্ষা ও সরকারী কাজে তাঁদের মাতৃভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে যায়৷ এর বিরুদ্ধেই ১৯৬১ সালে বাঙালীরা গর্জে উঠেছিলেন ও তাঁরা এর প্রতিবাদে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন৷ সেই আন্দোলনের জেরেই নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালনা করে ও তার ফলে ১১জন বাঙালীর মৃত্যু হয়৷ তাঁরা হলেন কুমারী কমলা ভট্টাচার্য, সত্যেন্দ্র দেব, বীরেন্দ্র সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, সুকোমল পুরকায়স্থ, কানাইলাল নিয়োগী, শচীন্দ্র পাল, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদরঞ্জন দাস ও সুনীল সরকার৷ এরপর এখানকার বাঙলাভাষীদের দাবী কিছুটা হলেও সরকার মানতে বাধ্য হয়৷ মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকার কায়েম হয়৷ কিন্তু, আজও পুরো অসমে সরকারী কাজে বাংলাভাষা ব্রাত্য হয়েই রয়েছে ও অসমের অধিকাংশ বাঙলা ভাষাভাষী এলাকায় এখনও বাংলা শিক্ষার সুযোগ নেই৷

তৎকালীন পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে নেমে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী পুলিশের গুলিতে রফিক, জব্বর, আব্দুল, সালামেরা প্রাণ দিয়েছিলেন৷ ওপার বাংলার মানুষ এই আন্দোলনকে চরমে নিয়ে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন৷ শেষ পর্যন্ত ওই ২১শে ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াই–এর জন্যে সারা পৃথিবীতে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে ও সারা পৃথিবীর মানুষ ওই মাতৃভাষা শহীদদের সম্মান জানায়৷ কিন্তু ১৯৬১ সালের ১৯শে মে যে ১১জন মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে প্রাণ দিলেন, ভারতের বাঙালীরা তাদের প্রায় ভুলেই গেছেন৷ শিলচরের মাতৃভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান জানানোর তাগিদও ভারতের বাঙালীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না৷ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার তাগিদও তাই দেখছি ভারতের বাঙালীদের মধ্যে প্রায় নেই বললেই চলে৷ তাই তো অসম, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িষ্যা, ত্রিপুরা, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও মাতৃভাষা বাংলা অবহেলিত৷  অসমের কাছাড় জেলা ছাড়াও, ধুবড়ি গোয়ালপাড়া, কামরূপ জেলার বড়পেটা হোজাই, লংকা, লামডিং, মিকির পাহাড়ের সমতল অংশ–এসব বাংলা ভাষী এলাকা৷ অথচ, মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ, সরকারী ও বেসরকারী কাজে মাতৃভাষা ব্যবহারের যে সাংবিধানিক অধিকার–তা থেকে আজও বাঙালীরা বঞ্চিত৷ ঝাড়খণ্ডে প্রায় ৬৫ শতাংশ বাঙালী৷ অথচ স্কুল, কলেজে মাতৃভাষা শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই৷ সরকারী কাজকর্মের ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষা নির্বাসিত৷ বিহার ও ওড়িশার বাংলাভাষী এলাকাতেও বাঙালীরা মাতৃভাষার চর্চা থেকে বঞ্চিত৷ এমনকি পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতেও আজ পর্যন্ত সমস্ত সরকারী কাজকর্ম বাংলাতে হয় নি৷  বাংলায় কাজকর্ম করার ক্ষেত্রে সরকার নানান্ অসুবিধার কথা বললেও বাংলাদেশ যেখানে ৬ মাসের মধ্যে তাদের সমস্ত কাজকর্ম বাংলা ভাষায় করতে সমর্থ হয়েছে, সেখানে সদিচ্ছা থাকলে ভারতের বাঙলাভাষী রাজ্যের সমস্ত সরকারী কাজে বাংলা ভাষা না ব্যবহার করার পক্ষে যুক্তিগ্রাহ্য কোনো অজুহাতই থাকতে পারে না৷

ভাষা মানুষের অভিপ্রকাশের মাধ্যম, তাই কোনো জনগোষ্ঠীর জীবনে ভাষা একটা মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে৷ ভাষার অবমাননা ওই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর অবমাননাকেই সূচিত করে৷ তাই অসমে বাংলা ভাষার প্রতি অবদমন–বাঙালীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে ভাবার প্রবণতা বৃদ্ধি করেছে৷ আজ তাই নানান অজুহাতে ওখানকার বাঙালীদের বৃহদংশের নাগরিকত্বকেও প্রশ্ণ চিহ্ণের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে৷ তাই ডি–ভোটারের তক্মা দিয়ে অসমের হাজার হাজার বাঙালীর ওপর নির্যাতন চলছে৷ অথচ, কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল এ ব্যাপারে যথেষ্ট চিন্তিত নয়৷ বরং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাঙালীদের ওপর নির্যাতনে তারা মদত দিচ্ছে৷ এই সমস্ত এলাকায় বাঙালীদের বিরাট এক অংশ এখানকার স্থায়ী নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিদেশী বলে চিহ্ণিত করা হচ্ছে৷ অথচ এর বিরুদ্ধে বাঙালীদের কোনো উল্লেখযোগ্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন  নেই৷

বাঙালী আজ আত্মবিস্মৃত৷ নিজেদের ঐতিহ্য ভুলে যেতে বসেছে৷ ভুলেছে বর্তমান৷ ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও তারা তত বেশি চিন্তিত নয়৷ নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য হারিয়ে সবাই ব্যষ্টিগত ভাবে যেন তেন প্রকারেণ ভোগবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে৷

বাঙালী জাতি কি এইভাবে ধবংস হয়ে যাবে? বাংলার ভাষা–সংস্কৃতির মধ্যে সমগ্র মানবজাতির সর্বাত্মক প্রগতির বীজমন্ত্র নিহিত রয়েছে৷ বাংলার মনীষীগণ সমগ্র মানবতার গর্ব৷ তাই আজ আত্মবিস্মৃত বাঙালী জাতিকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে৷ আপন ভাষা–সংস্কৃতির গৌরবের পতাকাকে ঊধের্ব তুলে ধরতে হবে৷ আমাদের ভুললে চলবে না, বাংলার সংস্কৃতিই বিশ্ব সংস্কৃতিকে ধবংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে৷