সমাজতান্ত্রিক ভাবনা

লেখক
এইচ, এন, মাহাতো

পৃথিবীতে অধ্যাত্মবাদের মাতৃভূমি ভারতবর্ষ। এখানে বর্ষ মানে দেশ। তবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদুরদৃষ্টির ফলে বর্ষটা পিছনে ফেলে আজ শুধুমাত্র ভারত ভূমি রয়েছে। সেই প্রাচীনকাল থেকে এই দেশটি ছিল সমাজতন্ত্রের প্রতীক। সমাজতন্ত্র ভারতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে। এপ্রসঙ্গে দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন -- " মুনি - ঋষিদের দিব্যজীবনের স্মৃতিচারণও জনগণকে এক সূত্রে গেঁথে দেয়। যখন লোক অতীতের মহান নেতাদের ও পুণ্যাত্মা সাধু-সন্তদের কথা নিজেদের হৃদয়ে লালন করে, তখন সেটা সমষ্টিগত ঐক্যের ভিত্তি গড়ে তোলে । " অর্থাৎ সুদূর অতীতের  মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারায় ও ঋক্ বেদের বাণীতেও সংগচ্ছধ্বং সংবোদধ্বং----- দেখতে পাই।" পরবর্তীতে মহাবিপ্লবী রাজনীতির অনলশিখা নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোসের বাণীতে আমরা দেখেছি--- " এক শতাব্দীর পুরোনো কমিউনিজম আজকের জ্ঞান -বিজ্ঞানের ধোপে টিকছে না। ফ্যাসীবাদ প্রত্যাখ্যাত, প্রাচীনপন্থী গান্ধীবাদও সচল নয়, মানব সভ্যতার জীবন দর্শন এগিয়ে চলেছে ফরাসী বিপ্লব থেকে চীন বিপ্লব নূতন সভ্যতার মর্মবাণী নিয়ে। এযুগের শেষে গণবিপ্লব হবে ভারতে। সমন্বয়ের আদর্শ হবে গণবিপ্লবের দিগদর্শন।"  তিনি আরো বললেন ----" আমরাও সমাজতন্ত্র চাই, কিন্তু ভারতবর্ষের সমাজতন্ত্র আসবেনা কাল মার্কসের পুঁথির পাতা থেকে। ভারতবর্ষের সমাজতন্ত্র আসবে তার প্রাচীন ঐতিহ্য ও মুনিঋষিদের চিন্তা ধারা থেকে।" আজকের ভারতের যারা সমাজতন্ত্রের কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন, তারা কালমার্ক্সের বস্তাপচা অর্থনৈতিক ভাবনা অথবা মনগড়া কিছু অর্থনৈতিক তত্ত্বকে সমাজতান্ত্রিক  ভাবে মানব সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
ভারতের সমাজতান্ত্রিক ভাবনা সেই দিন থেকেই ধ্বংস হতে শুরু করে, আজ থেকে প্রায় সারে তেরশো বছর আগে শঙ্করাচার্যের বৈদিক মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে। সেই সময় মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ ছিলো না। তাই কবির ভাষাতে আমরা দেখতে পাই " জগত জুড়িয়া আছে এক জাতি, সে জাতির নাম মানব জাতি। একই পৃথিবীর স্তন্যে পালিত, একই  রবি শশি মোদের সাথী।" অন্যদিকে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন " মানুষ সবাই আপন---একই মর্মে গাঁথা  সবার হিয়া, সবাকার একই আয়োজন।।"  এই বৈদিক মতবাদ এসে ভারতে জন্ম দেয় জাতি ভেদাভেদ প্রথা, উচ্চ বর্ণ নিম্ন বর্ণ। এরপর কৌলিন্য প্রথার জন্মের পরিনতিতে বর্ণশ্রেষ্ঠরা নিম্ন বর্ণের ওপর নানাপ্রকার গোঁড়ামি কুসংস্কার চাপিয়ে দেওয়ার ফলে সারা বাংলা তথা ভারতে নিম্ন বর্ণের মানুষদের মধ্যে উচ্চ বর্ণের প্রতি ঘৃণা জন্মায়, ঠিক সেই সময় অন্য ধর্ম মতাবলম্বীরা তাদেরকে এই ধর্মীয় শোষণ থেকে মুক্ত করে  তাদের দিকে টেনে নেন। বর্তমান বিজ্ঞান প্রযুক্তির জগতেও আজও সেই ট্রাডিশন সমান ভাবে চলছে। ধর্মভেদের নামে যেমন একপ্রকার শোষণ চলছে, ভেদাভেদ চলছে, তার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে বর্তমান রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পার্টিগত যে  নীতিমালা প্রয়োগ করেছে তাহা শুধু মাত্র রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে। সার্বিকভাবে সকলের হিতের কথা কেউ ভাবেনি বলেই সমাজে নানারকমের বিভাজন তৈরী হচ্ছে। তাই আমরা দেখেছি রাজনৈতিক ভাবে অনেকে সাম্যবাদের কথা বলে কিন্তু সমাজতন্ত্রের ধারেকাছে চলার চেষ্টা করেনি। অনেকে রাজনীতিতে ধর্মীয় মতবাদের মেরুকরণের বিশ্বাসী হওয়ার ফলে ভারতের সনাতনী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে। এই মহাবিভ্রাটের ফলে ভারতের জনসাধারণ আজ সংবিধানিক অধিকার হারাতে বসেছে। এর থেকে মুক্ত করতে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তথা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তীজির আনন্দ মার্গের অবতরণ। তিনি বলেছেন মানুষের সমাজকে বাঁচাতে হলে প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক পরিকাঠামো আগে তৈরী করতে হবে। তাঁর ভিত্তি হবে "সর্ব জন হিতায় সর্ব জন সুখায় বা কল্যানায় "। প্রথম পদক্ষেপে মানুষে মানুষে ভেদ বিভেদের প্রাচীরটা ভাঙতে হবে। আগে সব মানুষের ঈশ্বর প্রাপ্তির  অধিকার আছে এই ভাবনায় ভাবিত করতে হবে। তবেই তাঁর মধ্যে স্বার্থ লোভ লালসা প্রতিহিংসা প্রভৃতি নেতিবাচক ভাবনা গুলো দূর হবে। 'মানুষ মানুষ ভাই ভাই, সকল মানুষের ধর্ম এক' এই ভাবনায় সে ভাবিত হতে শুরু করবে। নারী পুরুষের মানবিক অর্থনৈতিক সামাজিক সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক ব্যাবস্থা জোরদার করা যাবে।
    কিন্তু বর্তমান পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ কাজ সহজ হবে না। রাজনৈতিক গণতন্ত্রের বিস্তার ঘটিয়ে ধনকুবেররা রাজনৈতিক দলগুলোকে হাতিয়ার করে শোষণের যে জাল বুনেছে তা ছিন্ন করে বেরিয়ে আসা আজকের মানুষের পক্ষে সহজ নয়। জনগণ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে কলহ বিবাদে মত্ত, কিন্তু তারা বোঝেনা সমস্ত রাজনৈতিক দলের টিকি  বাঁধা  আছে ওই ধনকুবেরের হাতে। তবে কাজ সহজ না হলেও অসম্ভব নয়। কিন্তু মানুষকে আগে এই শোষণের জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে এসে নতুন ভাবনায় ভাবিত হতে হবে।সে ভাবনা প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের ভাবনা। পরম শ্রদ্ধেয় দার্শনিক শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার তাঁর সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব প্রাউটে (প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব) সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিজ্ঞানসম্মত, যুক্তিসম্মত, সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। এই তত্ত্বের প্রয়োগে অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে মানুষ ফিরে পাবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র যা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্ত। তাই আর দেরী নয়, সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন নীতিবাদী মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রাউটের এর ভাবনায় ভাবিত হয়ে প্রকৃত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজে ব্রতী হউন।