স্নায়ুরোগ–মস্তিষ্ক্ বিকৃতি–স্মরণ শক্তি বৃদ্ধি–মানসিক রোগ

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

প্রাকৃতিক সুগন্ধীর স্নায়ু ও মনের ওপর হিতকর প্রভাব ঃ

কেয়া–(Pandanus fascicularis Lam.)ঃ

পরিচয় ও প্রজাতি ঃ কেত + কন = কেতক (কেতক>কে > কেআ> কেয়া)৷ কেয়াফুল গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বনেজঙ্গলে নদীর ধারে স্বাভাবিক নিয়মে জন্মে থাকে৷ এমনকি রাজস্থানের মরুভূমিতেও আমি কেয়ার গাছ জন্মাতে দেখেছি৷ দেখেছি  হিমালয়ের  কিছু ঊর্ধ্ব  দেশেও৷ দেখেছি  তামিলনাড়ুর  তরঙ্গায়িত রক্ত মৃত্তিকায়, কোঙ্কণ উপকূলের লবণাক্ত সমুদ্র বিধৌত এলাকায়, দক্ষিণ সুন্দরবনের কুম্ভীর শাসিত খাড়ি এলাকায়৷ অতি বৃহৎ অর্থাৎ ৩০–৩৫ ফুট থেকে ছয়–সাত ইঞ্চি পর্যন্ত অজস্র প্রকারের কেয়ার প্রজাতি রয়েছে৷

কেয়ার ঔষধীয় গুণাগুণ ঃ কেয়া ফুলের গন্ধ শুধু তৃপ্তিদায়কই নয় রুচিকারক তথা পরিপাকশক্তি–বর্ধ৷ ঙ্মন ও স্নায়ুর পক্ষে স্নিগ্ধকারক৷ কেয়া থেকে নানান প্রসাধন সামগ্রী প্রস্তুত করা হয়৷ কেয়া থেকে কেয়াবাসিত খদির বা কেয়া–খয়ের প্রস্তুত হয়৷ কেয়াফল হরিণের প্রিয় খাদ্য৷ বৃহদাকার কেয়া গাছের যে ফল তা দক্ষিণ বাংলার মানুষ অম্বল বেঁধে খায়৷ কেয়া পাতার আঁশ থেকে এককালে বস্ত্র প্রস্তুত করা হত৷ ঙ্ম এখনও এই বস্ত্র তৈরী হতে পারে ক্ষ৷

বন রচনায় কেয়া ঃ দেশের ঝোপজঙ্গল শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে কেয়াও নির্মূল হতে চলেছে৷ অথচ নদীতীরে কেয়া থাকা দরকার৷ তাতে ভূমির অবক্ষয় (soil erosion) রোধ করা যায়৷ পশ্চিম রাঢ়ের সেচ খালের পাশে কেয়া গাছ লাগানোর প্রয়োজন রয়েছে৷ যে কোন অরণ্যে কিছু পরিমাণ কেয়া গাছ থাকা খুবই দরকার, কারণ অরণ্যের তৃণভোজী জীব মাত্রেই কেয়া ফলের বীজ খেতে ভালবাসে৷

কেওড়া–জল বা কেওড়া–নির্যাস প্রস্তুত প্রণালী ঃ কেতকরক>কেরকেআর> কেয়ারা> কেওড়া৷ কেয়ারই প্রকারভেদকে [Processed] কেওড়া বলা হয়৷ কেয়ার দ্বারা সুবাসিত জলকে আমরা সাধারণতঃ কেয়া–জল না বলে কেওড়া–জল বলে  থাকি৷

একটি বয়ামে একটি প্রস্ফুটিত কেয়া ফুলের পাপড়িগুলি ভালভাবে ছাড়িয়ে দিয়ে (ছিঁড়ে দিয়ে নয়) ফুলটি শুইয়ে রেখে দাও৷ এবার একটি মিহি বস্ত্র খণ্ডকে জলে সপ্সপে করে ভিজিয়ে সেই ফুলটার ওপরে শুইয়ে রেখে দাও৷ এবার ওই বস্ত্রখণ্ডটির ওপরে আর একটি কেয়া ফুলের পাপড়ি ছাড়িয়ে ফুলটিকে শুইয়ে রেখে দাও৷ তার ওপর আর একটি মিহি বস্ত্রখণ্ড জলে সপ্সপে করে ভিজিয়ে রেখে দাও৷ এরকম কয়েকটা স্তর করতে পার৷ এরপর বয়ামের মুখ বন্ধ করে দাও৷ ওই বয়ামটাকে কোন শুকনো অথচ রৌদ্রহীন জায়গায় রেখে দাও৷ তৃতীয় দিনে ওই বয়াম থেকে কেয়া ফুলগুলি ও ন্যাকড়াগুলি বের করে নাও৷ এবার দেখবে ন্যাকড়াগুলোতে কেয়ার গন্ধ ভুরভুর করছে৷ এবার ওই ন্যাকড়াগুলোকে নিঙড়ে ওই নিঙড়ানো জলকে সযত্নে কোন পাত্রে ঢেলে দাও৷ দেখবে ওই জলেতে কেয়া ফুলের গন্ধ উপচে পড়ছে৷ এই হলো কেয়া ফুলের ঘন নির্যাস৷ এক বোতল সাধারণ পরিশ্রুত জলে কেয়ার এই ঘন নির্যাস কিছু পরিমাণ ঢেলে দিলে, বোতলের সমগ্র জল কেয়া ফুলের গন্ধে ভরপুর হয়ে যাবে৷ ওই বোতলের জলকে বলব কেওড়া জল৷

যেভাবে কেওড়া জল তৈরী হল সেইভাবে কেওড়া আতরও তৈরী করতে পার৷ তফাতের মধ্যে এই যে আতর তৈরী করতে গেলে বস্ত্রখণ্ডগুলি জলে না ভিজিয়ে চন্দন তেলে ভিজিয়ে নিতে হবে৷

(দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য থেকে গৃহীত)

 

পোয়াল ছাতু প্রসঙ্গে

তোমরা অনেকেই নিশ্চয় পোয়াল ছাতু দেখেছ–অনেকেই হয়তো বা খেয়েছ৷ রাঢ়ের এটি একটি জনপ্রিয় সুখাদ্য৷ পোয়াল ছাতুকে কোথাও কোথাও ভুঁইফোঁড়ও বলা হয়৷ ইংরেজীতে বলা হয় mushroom. শীতপ্রধান–গ্রীষ্মপ্রধান নির্বিশেষে বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই এই ছত্রাক বর্গীয় বস্তুটি কোথাও সোজাসুজি খাদ্য হিসেবে, কোথাও বা মাংসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ সংস্কৃতে এর নাম ‘কবক’৷ জিনিসটি নিরামিষ হলেও মাংসের গুণসম্পন্ন৷ তাই সাত্ত্বিক আহার যাঁরা করেন, তাঁদের পক্ষে এটি খাওয়া নিষিদ্ধ৷ রাঁধলে স্বাদও হয় মাংসের মত৷ পৃথিবীর কোথাও কোথাও জিনিসটিকে না জানিয়ে মাংসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷

কাঠ, খড়, কিছুটা পচে যাওয়া উদ্ভিদের ওপর এটা আপনা–আপনি জন্মায়৷ সব ছত্রাকের স্বভাব এই৷ বর্ষার শেষের দিকে ও শরতের প্রাক্কালে পোয়াল অর্থাৎ খড়ে এরা আপনা থেকেই জন্মায়৷ পোয়ালে এরা জন্মায় বলে এদের বলে পোয়াল ছাতু৷ বিচালি ক্ষড় হয়ে পেকে শুকিয়ে যায়, তখন তাকে অল্প ফাঁক ফাঁক করে বিছিয়ে দিয়ে পচবার সুযোগ করে দেওয়া হয়৷ তখন তার ওপরে এই ছাতু বা কবক জন্মায়৷ তাকে বলে বিচালি ছাতু৷ গোবর পচে গেলে তার ওপরেও এই ছাতু জন্মায়৷ তাকে বলে গোবর ছাতু৷ গোবর ছাতু অভক্ষ্য৷ কিছু কিছু বিষ–দোষ যুক্ত বস্তুতে এই ছাতু জন্মায়৷ সেই ছাতুও অভক্ষ্য৷ মানব শরীরে তাদের বিষক্রিয়া হয়৷ যে ছাতুগুলি দুর্বল ও ছোট, আঙ্গুলে ধরলেই গলে যায়, সেগুলিও অভক্ষ্য৷ কথ্য বাংলায় বলি ব্যাঙের ছাতা৷ এগুলি হাতে–পায়ে বেশী লাগলে গরল–ঘা ন্দ্বন্তুম্ভ্রন্দ্বপ্প্ত্র হবার সম্ভাবনা থাকে৷ আশ্বিনে দুর্গাপূজার প্রাক্কালে অর্ধেক পচে যাওয়া উদ্ভিজ্জের ওপর যে বিশেষ ধরনের ছাতু দেখা যায়, বর্দ্ধমানের গ্রামে তাকে দুর্গাছাতু বলে৷ দুর্গাছাতু কেউ খায়, কেউ খায় না৷ যাঁরা খান তাঁরা অল্প তেঁতুল জলে সেদ্ধ করে, তারপর জলটা ফেলে দিয়ে সেটা রান্না করেন ও রান্নায় ঝাল একটু বেশী দেন৷ বর্ষায় শেষে উই–ঢিবির ওপরে যে ছাতু জন্মায়, হুগলী–বর্দ্ধমানে তাকে রুই ছাতু বলা হয়৷

হ্যাঁ, শেষের দিকে আবার বলে রাখি, ছত্রাক জাতীয় সমস্ত খাদ্য (কবক, পোয়াল ছাতু) খাদ্য হিসেবে পুষ্টিকর হলেও, সবদিক দিয়ে মাংসের গুণসম্পন্ন ও মাংসের দোষসম্পন্ন৷ তাই যাঁরা সাত্ত্বিক আহার করতে চান, বা সত্ত্বগুণের অনুধাবন করতে চান, তাঁদের পক্ষে কবক বা পোয়াল ছাতু না খাওয়াই ভাল৷ যদি কোন গৃহস্থের কবকের প্রতি অত্যধিক আকর্ষণ থাকে, তবে দিনের বেলায় (আকাশে যখন সূর্য আছে সেই সময়) কবক খেতে পারেন৷ সূর্য ডোবার পর কিছুতেই খাবেন না৷ সূর্য ডোবার পরে কবক খেলে গলিত কুষ্ঠ হয়–প্রাচীনকালে আয়ুর্বেদের ঋষিদের এই ধরনের ধারণা ছিল৷

(দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য)