শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

শাস্ত্রীয় নির্দেশ অনুযায়ী মানুষের উন্নতির জন্যে তিনটি তত্ত্ব আবশ্যক৷ তিনটি তত্ত্ব কী?–না, শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন৷ প্রথমে দেখা যাক্শাস্ত্র বলতে কী বোঝায়? ‘‘শাসনাৎ তারয়েৎ যস্তু সঃ শাস্ত্রঃ পরিকীর্ত্তিতাঃ৷’’ এখানে শাসনমানে হচ্ছেঅনুশাসন৷ শাসন ও অনুশাসন একই জিনিস৷ ইংরেজীতে অনুশাসনবলতে Discipline, Code of discipline. কিন্তু সংস্কৃতেঅনুশাসনশব্দের অর্থ হচ্ছে–‘‘হিতার্থে শাসনম্ ইতি অনুশাসনম্’’৷ যখন তুমি কারোর হিতের জন্যে শাসন কর, তখন তাকে বলা হয় অনুশাসন৷ কিন্তু যখন হিতের ভাবনা থাকবে না, তখন তাকে অনুশাসন বলব না৷ এতে শাসন থাকতে পারে, কিন্তু তাতে হিতের ভাবনা নেইতাই তা অনুশাসন পদবাচ্য নয়৷ ‘‘হিতার্থে অর্থাৎ কল্যাণার্থে শাসনম্ ইতি অনুশাসনম্৷’’ তাহলে শাসনের দ্বারা অর্থাৎ অনুশাসনের দ্বারা যা জীবকে ত্রাণের রাস্তা দেখিয়ে দেয়, তাকেই শাস্ত্র বলে৷ শাস ত্রৈ প্রথমার একবচনে হয় শাস্ত্র
তাহলে শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন কথাটিতে শ্রবণ মানে শোণা৷ আমি আমার কাণকে এমনভাবে তৈরী করব যে কাণ সদা পরমপুরুষের কথা শুণবে৷ আর তাঁর কথা শুণলে কী হবে? পরমপুরুষের কথা যদি মানুষ শুণতে থাকে তবে সেই শব্দতরঙ্গ কাণ পর্যন্ত পৌঁছে যায়৷ কাণ থেকে স্নায়ুতন্তু (nerve fibres) ও সেখান থেকে মস্তিষ্ক্ পর্যন্ত [brain cells]  পৌঁছে যায়৷ মস্তিষ্কে পৌঁছে গেলে, তা একইভাবে মস্তিষ্কে শব্দতরঙ্গ উৎপন্ন করে৷ আর এইভাবে তা মনেও পৌঁছে যায়৷ সেই শব্দ যখন মনে পৌঁছে যায়, মন তখন ধীরে ধীরে পরমপুরুষের দিকে চলতে শুরু করে দেয়৷ এই হল শ্রবণ৷... শ্রবণশব্দটা রাখা হয়েছে ধর্মপ্রচারের জন্যে৷ ধর্মৈষণার জন্যে৷ বিশ্ববাসীর মনে সাত্ত্বিক ভাব জাগাবার জন্যে শ্রবণের প্রয়োজনীয়তা আছে বৈকি৷ তুমি যখন কীর্ত্তন কর তখন তুমিই শুধু আনন্দ পাওতা তো হয় না৷ তোমার মুখ থেকে যে কীর্ত্তন হচ্ছে সেটা যার কানে পৌঁছচ্ছে তাদের সকলেরই প্রগতি হবে৷ তাদেরও উন্নতি হবে৷ তাদেরও কল্যাণ হবে৷ এজন্যে শ্রবণশব্দকে রাখা হয়েছে৷...
তুমি বলতে পারঅনেক দুষ্ট লোক আছে যারা অনেক অনুচিত কথা আমাকে বলতে পারে৷ তারা পরমপুরুষের নাম নেয় না, তারা পরমপুরুষের চর্চা করে না৷ কিন্তু তারা যদি আমাকে অনুচিত বাক্য বলে? তার জন্যেও উপায় আছে৷ কেউ অনুচিত কথা বললে তৎক্ষণাৎ গুরুমন্ত্রের ব্যবহারের দ্বারা তাকে শুভ চিন্তায়, তাঁকে পরমপুরুষের ভাবে রূপান্তরিত করে নিতে পার৷ এই জন্যে যখনই অনুচিত কথা শুণবে, মনে মনে পরমপুরুষের জপ করতে থাকবে৷ তখন ওই অশুভ শব্দ শুভ শব্দে রূপান্তরিত হয়ে যাবে৷ এই হল মনন৷
‘‘মনসা সংবরো সাধু, সাধু সব্বত্থ সংবরো৷’’ এইভাবে করলে মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ এসে যাবে৷ কারণ সেই অবস্থায় মন এক বিশেষ পথ (line) অনুসারে চলা শুরু করে দেয়৷ এক বিশেষ পথ ধরে চললেই তুমি মনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে৷ এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই৷
তাহলে এক শ্রবণ, দ্বিতীয় হল মনন৷ মননমানে মনে মনে চিন্তা করা৷ মনের এটাই হল প্রধান কাজ৷ আসলে মনের দুটি কাজ আছেএক চিন্তা করা (চিন্তন), আর দ্বিতীয় স্মরণে রাখা (Remember)৷ সুতরাং চাইলেই মন সর্বদা মননক্রিয়া তথা পরমপুরুষের ধ্যানে রত থাকতে পারে৷ মনে অনেক কিছু জমা থাকে, জগতের অনেক কথা মনে জমা থেকে যায়যা পরিণামে অনেক সমস্যা তৈরী করে দেয়৷ ধর, কারো সাথে বিশ বছর আগে ঝগড়া হয়েছিলসেকথা মনে রাখলে কী হবে?–না, মনের শান্তি নষ্ট হয়ে যাবে৷ তা ভুলে যাওয়াই ভাল৷ ক্ষমা করো ও ভুলে যাও’–এই নীতিই সবচেয়ে উপযুক্ত৷ কিন্তু যেখানে পরমাত্মা বা পরমপুরুষের নাম মনন করার ব্যাপার আছে সেখানে মনন মানে বারে বারে পরমপুরুষের কথা চিন্তা করা৷ এক্ষেত্রে স্মরণে রাখাটা ড় কথা নয়, বারংবার তাঁর কথা চিন্তা করাই হচ্ছে যথার্থ মনন৷
‘‘মননাৎ তারয়েৎ যস্তু সঃ মন্ত্রঃ পরিকীর্তিতঃ৷’’ যে শব্দ মনন করলে, বারবার চিন্তা করলে মানুষের মুক্তি ঘটে, তাকেই মন্ত্রবলা হয়৷ মন+ ত্র+ প্রথমার একবচনে হয় মন্ত্র৷ পৃথিবীতে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ অগুনতি শব্দ আছেযা মন্ত্র নয়৷ যে শব্দের মনন করলেই মন পরমপুরুষের দিকে ছন্দায়িত গতিতে চলতে শুরু করে দেয়তাকেই মন্ত্র বলে৷ প্রত্যেক সাধকের নিজ নিজ মন্ত্র আছে, নিজ নিজ ইষ্টমন্ত্র আছে৷ গুরুমন্ত্রের দ্বারা অশুভ শব্দ শুভে পরিণত করব ও ইষ্টমন্ত্রের দ্বারা তাঁর মনন করতে করতে এগিয়ে যাবএই হল মনন৷
মনন করতে করতে কী হয়? মনের দ্বিতীয় গুণ হমনে রাখা, স্মরণ করা (Remember)৷ মনন করতে করতে এমন হয়ে যায় যে মানুষ আর তাঁকে ভোলে না৷ যখন তুমি ঘুমিয়ে আছ, তখনও মনে বিনা চেষ্টাতেই জপ চলতে থাকে৷ যখন বিনা প্রয়াসে আপনা থেকেই জপক্রিয়া চলতে থাকে, তখন শাস্ত্রে তাকে বলা হয়–‘অজপাজপবা অজপাগায়ত্ত্রী৷ অজপাগায়ত্ত্রী কী?–না, জপসিদ্ধি৷ জপে যখন সিদ্ধি এসে গেল, মনন করতে করতে যখন শেষ পর্যন্ত পূর্ণরূপে তা (ইষ্টমন্ত্র) মনে থেকে গেল, তখন তাকে বলবঅজপাগায়ত্ত্রী, অজপাজপ৷ তারই নাম–‘ধর্মমেঘ সমাধি৷ এই অবস্থায় সাধক কোন কিছুই ভোলে না৷
শ্রবণম্, মননম্, নিদিধ্যাসনম্৷ এই নিদিধ্যাসনম্ শব্দের অনেক অর্থ আছে৷ তবে এর একটি মুখ্য অর্থ হল মনের একতানতা অর্থাৎ আমি চলছি কেবলমাত্র তাঁকে পাবার জন্যে, তাঁরই পেছনে, আমার সমস্ত ভালবাসা কেবল তাঁকে কেন্দ্র করেই৷ এখানে আছে ষোল আনা অকটপতা (sincerity), ষোল আনা আন্তরিকতা৷...